সবাই মানুষ
লিখেছেন : পুলক ঘটক
আমি যদি হিন্দু পরিবারে না জন্মে একটি বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম নিতাম তবে সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র, প্রথা, বিশ্বাস বা সংস্কৃতির প্রতি আমার কোনো প্রকার দুর্বলতা থাকত না। মানব সভ্যতার প্রতি বৌদ্ধদের যে অবদান তা নিয়েই আমি গৌরব বোধ করতাম; হিন্দুদের বিশ্বাসকে ভুল ভাবতাম। আমি ইচ্ছে করে বা চেষ্টা করে হিন্দু পরিবারে জন্ম নেইনি। বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম না নেওয়ার জন্য কোথাও তদ্বির করিনি।
এই আমি যদি খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নিতাম তবে খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা ও অবদানকে আমার বোধ করতাম এবং তাদের উত্তরসুরি হিসেবে গর্ব করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতাম। বাইবেলের কথাকে নির্ভেজাল সত্য দাবি করে অন্যদের সঙ্গে তর্ক করতাম। খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম না নেয়ার জন্য কোনো চেষ্টা বা তব্দির করার সুযোগ আমার ছিল না।
এই আমি যদি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিতাম, তবে আমার বিশ্বাস ও বোধ-বুদ্ধি ইসলামি জীবনধারার সঙ্গে গেঁথে যেত। মুসলমান পরিবারে না জন্মানোর জন্য আমি কারও কাছে তদ্বির করিনি।
আমার জন্মের পর আমার পরিবারে উলুধ্বনি হয়েছে, শঙ্খধ্বনি হয়েছে। ঠিক সেই সময়ে মুসলমান পরিবারে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিল, তার শুভাগমনে আজান দেয়া হয়েছিল। সেই শিশুটি তখন জানত না, সে একজন মুসলমান। কিন্তু তার পরিবার নিশ্চিত জানত, সে একজন মুসলমান। জন্মের সময় আমি কিছুই জানিনি, অথচ আমার পরিবার জানত আমি হিন্দু।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার মাকে সুর করে রামায়ণ-মহাভারত পড়তে দেখেছি, তুলসী তলায় বাতি দিতে দেখেছি। একই সময়ে জন্ম নেয়া সেই ছেলেটি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তার মাকে সুর করে কোরআন শরিফ পড়তে দেখেছে, নামাজ পড়তে দেখেছে। তাকে মক্তবে পাঠানো হয়েছিল, তার বাবা তাকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটি এখন পাক্কা মুসলমান; ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস নিয়ে সে গর্ব করে এবং ইসলামি বইয়ে যা বলা আছে তাই সত্য বলে বিশ্বাস করে। তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধকে সে তার সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বলে মনে অনুভব করে। ছেলেটি আমেরিকায় কোনো খ্রিস্টান বা ইহুদি পরিবারে জন্ম নিলে বিপরীত ভাবত। হিন্দুর ঘরে জন্ম নিলে গয়া, কাশী, বৃন্দাবনকে তীর্থস্থান ভাবত; মুসলমান পরিবারে জন্ম নেয়ায় মক্কা-মদিনাকে তীর্থ ভাবে। সে চেষ্টা করে বা তদ্বির করে মুসলমানের ঘরে জন্ম নেয়নি।
ম্রো আদিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুটির ক্ষেত্রেও তাই হয়। আফ্রিকার জুলু ধর্মের অনুসারীদের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসগুলো একই প্রক্রিয়ায় তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে যায়।
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ধর্ম এবং তার চেয়েও শত সহস্র বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক সকল মানুষের জন্ম এবং বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনে বিশ্বাসের বীজ বপিত হয়। নিজের জীবনের মধ্যে আরোপিত বিশ্বাসকে সত্য এবং বাকিদের সবাই ভুল বা অসত্য মনে করে। খুব কম সংখ্যক মানুষ পড়াশোনা করে বা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে তার আজন্ম লালিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারে। সবাই মানুষ।

Leave a Reply