মানুষ বনাম ধর্মানুষ
লিখেছেন : মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ
ফারহানা মান্নান এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী দম্পতির কন্যা মধু মারা গেছে। সন্তানের মৃত্যু মা-বাবার জন্য কতটা কঠিন হতে পারে তা আশা করি ওনারা বুঝতে পেরেছেন। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর বিজ্ঞান-আড্ডার আয়োজক (যে আড্ডায় অভিজিৎ রায় ছিলেন) ফারসীমের নির্বিকার থাকার বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে প্রশ্নের উদয় করেছে। এটি নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। ফারসীম বুয়েটের (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষক এবং তিনি নিজেও বিজ্ঞান লেখক। তবে তাঁর লেখায় বিজ্ঞান উঠে এসেছে ধর্মের সাথে সহাবস্থান করেই। রকমারি ডটকমে ফারসীমের ৩০ টি বই আছে। রকমারি ডটকমের মালিক দাড়িটুপিওয়ালা সোহাগ হুজুর সম্প্রতি ধর্মীয় অনুভূতির বিরোধী আখ্যা দিয়ে সজল রোশনের বই রকমারি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, অথচ সজল রোশন কিন্তু ইসলামের পক্ষেরই লোক! তবে হ্যাঁ, তিনি কোরআনকে মানেন কিন্তু হাদিসকে মানেন না। হাদিস মানেন না এমন ব্যক্তির বই রকমারিতে রাখা সমীচীন মনে করেননি দাড়িটুপিওয়ালা সোহাগ হুজুর। ফারসীম মান্নানের প্রায় সব বইই বিজ্ঞান নিয়ে লেখা, কিন্তু সেসব বইয়ের কোনটাই রকমারিতে বাতিল হবে না, কারণ সেগুলি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে না। সত্যিকারের বিজ্ঞান তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেই। যে বিজ্ঞানের বই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে না সেটি বিজ্ঞানের বইই না, কারণ ধর্ম তৈরিই হয়েছে বিজ্ঞান-বিরোধিতার উপর ভিত্তি করে। মুক্তিযুদ্ধের বইয়ে যদি রাজাকার-বিরোধিতা না থাকে তাহলে সেটি কিসের মুক্তিযুদ্ধের বই? মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় যদি রাজাকার-বিরোধিতা প্রসঙ্গ না থাকে তবে সেটি কিসের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা? একইভাবে বিজ্ঞানের বইয়ে যদি ধর্মের বিরোধিতা না থাকে তবে সেটি কিসের বিজ্ঞানের বই?
ফারসীম মান্নানের স্ত্রী ফারহানা মান্নানের ফেসবুক প্রোফাইল দেখলাম। প্রোফাইলে থাকা ছবিসমূহ এবং লেখালেখি দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, তিনি মুসলিম। কিন্তু তিনি স্রেফ মুসলিমই না, জ ঙ্গি বা দীও হতে পারেন, আমি জানিনা। ইসলাম নামক সন্ত্রাসবাদী, ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এমন বহু জ ঙ্গি বা দী ই ছিল এবং আছে যাদের দেখতে-শুনতে, চলনে-বলনে, নামে-পদবিতে মুসলিম মনে হয়নি এবং মুসলিম মনে হয় না। আমার একটা নিয়ম হচ্ছে, আমি কোন বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলি না। কারণ, আমার অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্ত কারোর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি পথ খোলা রাখি – আলোচনার পথ, মতপ্রকাশের পথ, যাচাই-বাছাইয়ের পথ। আমি আজও জানিনা, ফারসীম মান্নান অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কিনা। তবে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর তার স্ট্যাটাস থেকে বোঝা যায়, ‘দেশে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে!’ নিজের সন্তান মধুর মৃত্যুতে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। প্রতিটি মা-বাবাই তাদের সন্তানের মৃত্যুর পর এভাবেই কষ্ট পায়। অভিজিৎ রায়ের মা-বাবাও এভাবেই কষ্ট পেয়েছিলেন।
আপনি যদি কেবল নিজের সন্তানের মৃত্যুতেই কষ্ট পান আর অন্যের সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দ পান কিংবা নির্বিকার থাকেন তবে আপনি হয় জি ha দী, নয়তো মডারেট মু s লি ম (জি ha দি দের সৃষ্টিকর্তা)। এমন কঠিন মুহূর্তে ফারসীম মান্নানকে খোঁচা দেয়া আমার উদ্দেশ্য না, কিন্তু মানুষকে দুটি জিনিস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আমার এই পোস্ট : প্রথমতঃ ই স লা ম নামক ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার স ন্ত্রা সী দে র মুখোশগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া, আর দ্বিতীয়তঃ সন্তানের মৃত্যুতে মা-বাবার কেমন লাগে সে বিষয়ে মাদ্রাসার হুজুর যারা অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে উল্লসিত হয়েছিল তাদের বার্তা দেয়া।
ক্ষোভ মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে এবং পাঠক যখন বিদ্রোহ করে তখন তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পরদিন সকালে আমি যখন আমার পরিচালনাধীন মাদ্রাসায় গেলাম তখন আমার একজন কলিগ বলল, “আর একজন নাস্তিক জাহান্নামে গেছে, অভিজিৎ রায় নাম!” যে বলেছে সে আমার জুনিয়র। আমি কারোর মৃত্যুতে উল্লসিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করলাম, কিন্তু দেখলাম তার কাছে উল্লাস প্রকাশটাই সঠিক মনে হচ্ছে, বিশেষ করে এই নাস্তিক যেহেতু ‘হি ন্দু!’ একইরকম উল্লাস দেখেছিলাম ২০০৪ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার পরপর জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সম্মেলনে। সম্মেলনটি হয়েছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদের কাছের পল্টন ময়দানে। সেখানে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছিলেন। আমি একজন জামায়াতী বন্ধুর সাথে সে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ভাষণের একপর্যায়ে বললেন : “আমি আমার একজন বন্ধুর সাথে কথা প্রসঙ্গে বললাম, কিন্তু হুমায়ুন আজাদ তো উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক! আমার বন্ধু আমাকে বলল, উচ্চাঙ্গের না সে বরং নিম্নাঙ্গের সাহিত্যিক!” আমি নিজের চোখে মতিউর রহমান নিজামীকে দেখেছি সেদিন। তাঁর ভাষণ শুনেছি। তাঁর বিকৃত ইসলামিক মুখভঙ্গি দেখেছি। নিজামীর কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে যখন চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছিল তখন মতিউর রহমান নিজামী আনন্দ পেয়েছিলেন। নিজামীর সন্তানেরাও (যারা কেউই মাদ্রাসায় পড়েনি, বরং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে) আনন্দিত হয়েছিল। তাদের ভালো লেগেছিল, নাস্তিককে কোপানো হয়েছে। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সন্তানদের কাছে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, আপনাদের বাবাকে যখন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তখন আপনাদের কেমন লেগেছিল? ঠিক একইভাবে জানতে ইচ্ছে হয় ইসলামিক ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদের কাছেও – আপনি যখন ইহুদিদের গণহত্যা করছিলেন তখন খুব আনন্দ পেয়েছিলেন, কিন্তু আপনার পরিবারকেও যখন কারবালার ময়দানে গণহারে হত্যা করা হয়েছিল এখন আপনার কেমন লেগেছিল? অবশ্য ততদিনে আপনি তো আর বেঁচে নেই!
পৃথিবীতে এখন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বেঁচে নেই, অভিজিৎ রায় বেঁচে নেই; বেঁচে নেই মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ, বেঁচে নেই বিন লা দে ন, বেঁচে নেই মতিউর রহমান নিজামীও। কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। আমরা দেখতে পাই, একদল মানুষ কাউকে খুব খুন করে আনন্দ পায়, একদল মানুষ কারোর মৃত্যুতে উল্লাস করে। আর অন্য একদল মানুষ, তাঁরা কারোর মৃত্যুতেই খুশি হয় না। তাঁরা মনে করে, প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। যারা অন্যকে হত্যা করে বা অন্যের মৃত্যুতে উল্লাস করে যখন তাদের নিজেদের সন্তান খুন হয় বা মৃত্যুবরণ করে তখন তারাও কিন্তু ভীষণভাবে কষ্ট পায়! চলুন আমরা যারা বর্তমান পৃথিবীতে বেঁচে আছি, যারা ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেছি যারা তাঁরা বদলে যাই। আমরা ধর্মানুষ না হয়ে বরং মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি।
Leave a Reply