লিখেছেন : কবিতা রায়
মানুষের মনের আনন্দ বা দুঃখ আসলে কার্যকারণের উপর নির্ভর করেনা। ব্যাপারটা নির্ভর করে কয়েকটা হরমোনের মাত্রার উপর। সবগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ডাক্তারি বইয়ের মতো দাঁড়াবে। সহজে বলতে গেলে ডোপামিন এবং রিলাক্সিন নামের দুটি হরমোন মানুষকে আনন্দে রাখে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, জোর করে এই হরমোন দুটির মাত্রা বাড়ালেই মানুষ আনন্দে থাকতে পারে।
যখন আমাদের সামনে কোনো সমস্যা নেই। যখন আমাদের শরীর সুস্থ, পেট ভরা এবং কল্পনাতেও অদূর ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছেনা তখন আমাদের মগজে ডোপামিন হরমোন বাড়তে থাকে। এর প্রভাবে মগজ একটা বিশ্রামের অবস্থায় চলে যায়। দেহের পেশীগুলোর ক্ষেত্রে এই অবস্থা তৈরি করে রিলাক্সিন হরমোন। আবার যদি মগজে সম্ভাব্য বিপদের সংকেত আসতে থাকে তাহলেই ডোপামিনের মাত্রা কমে গিয়ে একটা সতর্ক জাগ্রত অবস্থা তৈরি হয়। দেহে এড্রিনালিন হরমোন বেড়ে ওঠে। শ্বাসক্রিয়া, রক্তচাপ, রক্তপ্রবাহ সবকিছুই বেড়ে গিয়ে বাড়তি শক্তি উৎপাদন হয় যাতে আমরা বিপদের সাথে লড়তে কিম্বা দ্রুত পালিয়ে বাঁচতে পারি। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীর এভাবেই কাজ করে।
কিন্তু এই ডোপামিনের মাত্রাকে অন্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওষুধের সাহায্যে করা যায়, খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করা যায়। আবার অভ্যাসের দ্বারাও করা যায়। যেমন ধরুন আপনি যদি বসে বসে পোলাও-বিরিয়ানি খেতে অভ্যস্ত হন তবে একদিন এক ঘন্টা কাজ করতে বললেই আপনার মগজে সঙ্কেত যাবে যে ঘোর দুর্দিন এসে গেছে। ফলে আপনার ডোপামিন লেভেল কমে যাবে। আবার আপনি যদি স্বাভাবিকভাবে রোজ আট ঘন্টা কাজ করেন তবে একদিন এক ঘন্টা কাজ করতে বললে সেটা হবে ছুটির দিন। তখন ডোপামিন লেভেল বেড়ে যাবে।
পোলাও বিরিয়ানিতে অভ্যস্ত আপনাকে একদিন যদি একখানা শুকনো রুটি দেওয়া হয় তবে তার ফলে ডোপামিন লেভেল কমে যাবে। আবার তিনদিন খেতে না পাবার পর সেই একখানা শুকনো রুটি পেলেই ডোপামিন লেভেল বেড়ে গিয়ে আপনি প্রচুর আনন্দ পাবেন।
সহজ ভাবে বললে মগজে ভালো সঙ্কেত এলে ডোপামিন বাড়ে, খারাপ সঙ্কেত এলে ডোপামিন কমে যায়। এরই ফলে আমরা আনন্দ এবং দুঃখ অনুভব করি। এই খারাপ বা ভালো সঙ্কেত বাইরের পরিবেশ থেকে আসতে পারে। দেহেরই বিভিন্ন অংশ থেকে আসতে পারে, আবার মগজেরই অন্য অংশ থেকে অতীতের স্মৃতি বা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কল্পনা থেকেও আসতে পারে।
এখন আমরা যদি কোনোভাবে সজ্ঞানে এই ডোপামিনের পরিমাণ স্থির রাখতে পারি অথবা ডোপামিন রিসেপটরগুলোকে অকেজো করে দিতে পারি তবে কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের মনে সুখ বা দুঃখের কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হবেনা। তখন লেজ নেড়ে-নেড়ে দৌড়ে আসা পোষা কুকুর আর দাঁত বের করে দৌড়ে আসা পাগলা কুকুরকে আমরা সমদৃষ্টিতে দেখতে পারব। পরমান্ন এবং পোড়ারুটি খাবার সময়ে আমাদের অনুভূতি একই রকম থাকবে।
রান্না করা কার্বোহাইড্রেট খাদ্য আমাদের মগজে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ায়। ভেতো বাঙালির ক্ষেত্রে প্রভাবটা আরো বেশি, কারণ বাঙালি যে ভাত খায় সেই চালটা দুবার সিদ্ধ করা হয়। এই ভাত না খেলে বাঙালির পেট ভরলেও মন ভরেনা। তাজা ফল বা সবজি, যাতে জীবিত কোষে কার্বোহাইড্রেট আছে তার প্রভাব এক্ষেত্রে অনেক কম। প্রোটিনের অভাবও ডোপামিন রিসেপটরের ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যাতে সহজে পরিবর্তন ধরা যায়না। মাছ ও মুরগির মাংস ডোপামিন বাড়ায়, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাংসে ততটা বাড়ায়না।
প্রাণায়ামের কয়েকটি পদ্ধতিও ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যখন আমরা লম্বা সময় দম বন্ধ করে রাখি তখন ফুসফুস থেকে বিপদের সঙ্কেত গিয়ে ডোপামিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। লম্বা সময় এই কম ডোপামিনে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে পেরে ডোপামিন লেভেল সামান্য বাড়াকেই বিরাট আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয়। যেমন তিনদিন খেতে না পেলে তারপর একটা পোড়ারুটিও আনন্দ করে খাওয়া যায়।
সমস্যা এই যে এভাবে ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে অনেক রকম কাল্পনিক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেয়ে আনন্দে থাকা গেলেও বাস্তবের সমস্যার কোনো সমাধান এর থেকে পাওয়া যায়না। প্রখর বুদ্ধির এবং সুস্থ-সবল মগজের অধিকারী ব্যক্তিরা প্রকৃত সমস্যাগুলোকে অন্যভাবে গ্রহণ করতে এবং সমাধান করতে পারেন। কিন্তু যাদের মোটিভেশন হিসাবে যুক্তির বদলে আবেগ কাজ করে তারা এই কাজটা করতে পারেনা এবং বাস্তব-অবাস্তব সব সমস্যা আর বিপদের ক্ষেত্রেই “এই বেশ ভালো আছি” বলে আনন্দে কাটিয়ে দেয়। আর এদেরই সংখ্যা সমাজে অতিরিক্ত বেশি। এমনিতেই এরা নিজেরা সমস্যায় না পড়লে নড়তে চায়না, তার উপর যদি সমস্যাকে সমস্যা বলে মনেই না করে তবে তো হয়েই গেল।
এই কারণেই উপযুক্ত শিক্ষা এবং শক্তিশালী দেহমনের অধিকারী ছাড়া নির্বিকার যোগী হবার সাধনা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। যারা এসব লাইনে যেতেন তারাও সমাজ থেকে দূরেই থাকতেন। গৌতম বুদ্ধের বোকামীর কারণে এই সমস্যাটা সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে গেছিল। যার ফল ভারতবর্ষ এখনও ভোগ করছে।
Leave a Reply