রুমানা মনজুর ইস্যুটার কথা আশা করি সবার মনে আছে। পরকীয়ার সন্দেহে স্বামী হাসান সাইদের হাতে নির্যাতিত হয়ে চোখ হারিয়েছিলেন। সব আস্তিক, এমনকি অনেক নাস্তিকও হাসান সাইদের পক্ষে ছিলেন। তাদের বক্তব্য–যেহেতু বউ পরকীয়া করছে, সেহেতু স্বামী তার গায়ে হাত তুলতেই পারে। এর বিপক্ষে খুব অল্প কিছু মানুষের যুক্তি ছিল–পরকীয়া করছে, এমনটা প্রমাণিত নয়…আর পরকীয়া যদি করেও থাকে তাহলেও কেউ তার গায়ে হাত তোলার অধিকার রাখে না।
তখন এই বিয়ে-পরকীয়া নিয়েও অনেক আলোচনা হইছিল… বিয়ের ইতিহাস থেকে শুরু করে একগামিতা, বহুগামিতা, রাধা-কৃষ্ণ–অনেক কিছুই উঠে আসছিল।
বিয়ের প্রচলন ঠিক কবে থেকে সেটা স্পষ্ট না জানা গেলেও হিন্দুধর্মে উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতুর কথা শোনা যায়–একদিন পিতার সমক্ষে এক ব্রাহ্মণ এসে তাঁর মাতাকে হাত ধরে নিয়ে যেতে দেখে তিনি যখন ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তখন উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বলেছিলেন যে, সনাতন ধর্ম অনুসারে সকল স্ত্রীলোকই গরুর তুল্য স্বাধীন। নারীরা সজাতি শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও অধর্ম হয় না। উদ্দালোকের এই কথায় শ্বেতকেতু সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি নিয়ম স্থাপন করলেন যে, যে-নারী পরপুরুষগামিনী হতে পারবেন না, অর্থাৎ তাদেরকে এক স্বামীতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অনেক হিন্দু অবশ্য দাবী করেন, তিনি নাকি পুরুষদের জন্যও একই নিয়ম করেছিলেন–পুরুষরাও অন্য নারীর কাছে যেতে পারবে না। তবে এই নিয়ম করে নারীদেরকে কিছুটা আটকানো গেলেও পুরুষদেরকে যে একেবারেই আটকানো যায় নি, তার অজস্র প্রমাণ ইতিহাস তো বটেই, ধর্মগ্রন্থ-পৌরাণিক কাহিনীতেই স্পষ্ট।
নারীদের আসলে কতটা আটকানো গেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করি এই কারণে যে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে পুরা একটা অধ্যায়ই আছে যেখানে পরের বউদের সাথে কীভাবে ‘প্রেম’ করতে হবে, তা খোলাখুলি ভাবে বলা আছে। তার মানে হাজার দুয়েক বছর আগেও মেয়েরা একাধিক ‘প্রেম’ তো বটেই, বিয়ের পরে ‘পরকীয়াও’ করত। এক হাজার বছর আগেও সমাজ এভাবেই চলছে–তখনকার রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী তো আছেই, সেই সাথে পাঁচশ বছর আগের পদাবলীতেও কবিরা রাধার মুখ দিয়ে আক্ষেপার্থে বলিয়েছেন যে, ব্রজের সব নারীই অন্য পুরুষের কাছে যায়, আর দোষ হয় শুধু রাধার!
অর্থাৎ নারী-পুরুষ উভয়ের বহুগামিতা বা পরকীয়া কেউ কেউ ব্যাপারটাকে ভালো চোখে না দেখলেও সমাজে এটা বেশ ভালোভাবেই চলে আসছিল–সামাজিক বা ধর্মীয় বিধিবিধান দিয়ে এগুলোকে আটকানো যায় নি। বর্তমানে এগুলা সমাজে ‘ব্যভিচার’ হিসাবে গণ্য। কিন্তু এই ব্যভিচার হিসাবে দেখা শুরু হলো কবে থেকে?
ভারতে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারার আইনে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে এবং তাতে ওই নারীর স্বামীর অনুমতি না থাকলে বিষয়টিকে ধর্ষণ বিবেচনা করে ব্যভিচারে লিপ্ত পুরুষের পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল, জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কয়েকদিন আগে সমকামিতা বিষয়ে পুরানো আইন বাতিল করে এটাকে বৈধ করে দিয়েছে। এবার এই ‘ব্যভিচার’ সংক্রান্ত আইন বাতিল করে দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ব্যভিচার আইন ইতোমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে। ব্যভিচারকে অপরাধ বিবেচনা করা হলে তা হবে উল্টো পথে হাঁটা এবং অসুখি মানুষকে শাস্তি দেওয়ার সমতুল্য। আরো বলেছে–“এটি (ব্যভিচার) বিবাহবিচ্ছেদের একটি বড় কারণ হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে এটা কোনোভাবেই অপরাধ নয়। যে আইন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নারীদের সমান অধিকারের দাবিকে খর্ব করে, তা সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবিরোধী।”–এই কথাগুলোই সেই বছর সাতেক আগে বলা হইছিল যে–রুমানা মনজুর যদি পরকীয়া করেও থাকে, না পোষাইলে ডিভোর্স দিয়া দে, কিন্তু পরকীয়া বা বহুগামিতা কোনোভাবেই ক্রাইমের মধ্যে পড়ে না।
আইনটি বাতিল চেয়ে করা মামলায় আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল– ঔপনিবেশিক আমলে এই আইনের মাধ্যমে বিবাহিত নারীদের স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হত; বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এ ধারণা অচল।
সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি আমলে নিয়ে আইনটিকে ‘নারীদের জন্য অপমানজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। আদালত বলেছে, এ আইনে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, স্বাতন্ত্র্য খর্ব হয় এবং নারীকে তার স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমার মনে হয়–শুধু এই আইনে না–বিয়ে প্রথাটার মাধ্যমেই নারীদেরকে স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হয়। যারা ‘স্বামী’ শব্দের মানে জানেন না, তারা জেনে নেন–বিয়ের মানেটা আরো ক্লিয়ার হবে।
অনেক নাস্তিকও আছে, যারা বিয়ে নামক একটা ধর্মীয় প্রথারে বিশাল বড় করে দেখতে চায়, আয়াতের মত মানতে চায়… কথা হচ্ছে একগামী, বহুগামী–যার যেমন ইচ্ছা চলুক– শুধু অন্যের ক্ষতি না করলেই হলো। অন্যের ক্ষতি করা অপরাধ–এমন অপরাধ রোধে আইন থাকুক। আর বাকি সব এথিক্স, আইন, নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান–সোদার টাইম নাই!
=============
আমি মইরা গেলে বউ-বাচ্চা-সংসার রইল কি না রইল তাতে আমার কী যায় আসে! দুইজন নারী-পুরুষ বাচ্চা পালতে চাইলে বাচ্চা নিবে–কার কী বলার আছে! আবার আমার বউ (বিয়া যখন করছি) অন্য কারো সাথে লাগাইয়া বেড়াইলে আমার কী যায় আসে! লাগাইয়া অন্য কারো কাছ থিকা বাচ্চাও যদি নিতে চায় তো নিবে–এইখানে আমি যদি তাদের বাচ্চা পালতে চাই তো পালবো, আর আমার না পোষাইলে আমার পথে আমি দেখব। তাদের বাচ্চা তারা দুজন পালবে। আর বউ যদি চায় সে একলা পাববে, তো একলা পালবে।
এসব নিয়ে তর্ক করতে গেলে–আস্তিকরা যেমন বলে–নাস্তিক হইছেন ভালো কথা, এইবার নিজের বাপ-মা-বউরে আগে নাস্তিক বানাইয়া আসেন। বহুগামিতা-পরকীয়া নিয়া বলতে গেলেও আস্তিকদের পাশাপাশি নাস্তিকদের বাণী–বউরেও পরকীয়া করতে দেন… অর্থাৎ এই নাস্তিকরাও পুরুষদেরকে সব ক্ষমতার উৎস মনে করে… পুরুষরা নারীকে অধিকার দিবে, অনুমতি দিবে, তবেই নারীরা কিছু করতে পারবে! অবাক কান্ড! আমার বউরে অধিকার দেয়ার আমি কে! সে কী করবে না করবে সেইটা একান্তই তার ব্যাপার, তার সিদ্ধান্ত। আমি সেইখানে নাক গলাইতে যাব কোন অধিকারে। আবালের দল!
Leave a Reply