হুজুরের প্রিয় মুভির তালিকায় উপরের দিকে থাকে যুদ্ধবিষয়ক মুভিগুলো–বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর যত মুভি আছে, প্রায় সব তার দেখা। আমার নার্ভ দুর্বল বলে ওসব বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না। এ নিয়ে হুজুরের সাথে একদিন কথা হচ্ছিল। হুজুর বলছিলেন–তিনি আসলে দেখেন মানুষের লোভ ও স্বার্থের বিষয়টা। একজন সৈন্য কীভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়, কীভাবে নিজের স্বার্থ ও লোভ ত্যাগ করে অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটাই দিয়ে দেয়…
ব্যক্তিগত ভাবে নিজে সহজে জাজমেন্টাল হই না। এক কথায় অন্য কাউকে বিচার করি না–অমুকে ‘ভালো’, তমুকে ‘খারাপ’–এ ধরনের বিষয় এড়িয়ে থেকে দৃষ্টিটা খোলা রাখার চেষ্টা করি। কারণ, ভালো-মন্দ মিশিয়েই মানুষ। সবারই যেমন কিছু না কিছু ভালো দিক আছে, তেমনি খারাপ দিকও থাকবে। কিন্তু আবার এই ভালো-মন্দ বিষয়টাও আপেক্ষিক। আজ আমার যা ভালো বলে বিবেচিত হচ্ছে, কাল সেটা খারাপ মনে হতে পারে; আবার কাল যেটা খারাপ, পরশু সেটা ভালো বলেও বিবেচিত হতে পারে কারো কারো কাছে। ফাইনালি দেখে ক্ষতির দিকটা–আমাকে দিয়ে কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা। আর একান্তই কারো ব্যাপারে কিছু বলতে হলে বড়জোর তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বলতে পারি–অমুকে এই করেছে, এই হলো তার প্রমাণ। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া আস্তিকরা কথা বলে। নাস্তিকদেরকেও একই কাজ করতে দেখলে কেমন জানি বমি বমি ভাব হয়।
তবে মাঝে মাঝে শখের বশে অবসর থাকলে মানুষকে অবজার্ভ করি–মানুষটার বিচার-বিবেচনা কেমন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন, সর্বোপরি লোভ স্বার্থ হিংসা ভয়ের বেলায় কেমন। তবে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি বোধহয় সেই চিরাচরিত টেকনিক–টাকা ধার দেয়া। তবে টাকা-পয়সা খুব একটা নাই বলে কাউকে ধার দিয়ে এই পরীক্ষাটা এখনো সেভাবে করে হয়ে ওঠে নি।
টাকার ব্যাপারটা বাদ দিলে মোটা দাগে আর চারটে জিনিস থাকে–লোভ, স্বার্থ, হিংসা, ভয়। আস্তিক-নাস্তিক হিসাবে করলে নাস্তিকদের মধ্যে এই ভয়–পরকালের ভয় জিনিসটা থাকে না। কিন্তু একটা মানুষ যদি শুধু ওই নাস্তিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে ওই ভয় বাদে আর সব দিকগুলোতে আস্তিকদের ওভারটেক করতে সক্ষম হয় না–তাদের মধ্যে লোভ, স্বার্থ ও হিংসা জিনিসগুলো থেকে যায়। লোভ স্বার্থ হিংসা ভয়–এই চারটা জিনিসের শুধু ভয়ের দিকটা বাদে আস্তিক-নাস্তিক তেমন কোনো পার্থক্য দেখলাম না। হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে এই লোভ, স্বার্থ, হিংসা–জিনিসগুলোর তাড়নাতেই। এসব বাদ দিলে জীবনের আর থাকে কী! তাই হয়তো এগুলাই স্বাভাবিক।
২) ৫৭ ধারা চালু হওয়ার পরে যখন একের পর এক নাস্তিকদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে তাদেরকে নানানভাবে হেনস্তা করা হচ্ছিল, তখন দেশের সুশীল সমাজ, বিশেষ করে সাংবাদিকরা নীরব ছিলেন। নাস্তিকরা কিছুটা পিছু হটলে এই আইনের শিকার হতে শুরু করল সাংবাদিকরা। বর্তমানে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারপক্ষের অনেকেই এই আইনের ব্যাপারটা আরো ভেবে দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন। এমনকি আইনটা বাতিলও হতে পারে।
নাস্তিকরা সেই প্রথম থেকেই এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তখন তাদের পাশে আর কেউ ছিল না। কিন্তু যে-ই এই আইনের ফলে সাংবাদিকরা নিজেরাও এক এক করে ভুগতে শুরু করল, অমনি সাংবাদিকরা নড়েচড়ে বসতে শুরু করলেন। তাদের এই আচরণের পেছনে মোটা দাগে একটা জিনিসই কাজ করছে, সেটা হলো স্বার্থ।
৩) ব্লগ-ফেসবুকেও এর-ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া দোষারোপ বা অভিযোগ করার বিষয়টা নতুন নয়। সর্বশেষ যে ব্যাপারটি নিয়ে ফেসবুকে তোলপাড় হয়েছিল সেটা হলো তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ব্লগারদের নাম করে টাকা তুলে সেটা ব্লগারদের মাঝে বিরতণ না করে নিজের নিয়ে নেয়ার অভিযোগ।
নাস্তিকরা নাস্তিক হওয়ারে পরে সমাজে কিছুটা ‘একা’ হয়ে পড়ে। তখন ভার্চুয়াল জগতে অন্য নাস্তিকদের আপন মনে করে। কিন্তু বাস্তবে যে একা হয়ে পড়ার ফলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়, ভার্চুয়ালে ওই সমস্যায় যাতে আবার নতুন করে না পড়তে হয় সেজন্য বেশিরভাগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাস্তিকদের দিকে হেলে থাকে, বিতর্কিত অনেক বিষয় থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখে যাতে অন্য নাস্তিক আবার তাকে আলাদা করে না দেয়। মোটামুটি সবার সাথে তাল মিলিয়ে, নয়তো নিজেদের একটা কমফোর্ট জোনের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে বেশিরভাগ নাস্তিক। তসলিমা নাসরিনের সাথে তখন যেটা হয়েছিল–বেশিরভাগেই স্বার্থ আর লোভের কারণে চোখে বন্ধ করে ‘বিদেশ যাওয়া/এসাইলাম পাওয়ার সুবিধা’র দিকে হেলে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।
ওদিকে তসলিমা নাসরিনের দীর্ঘ সংগ্রামের একটা পথ আছে যে পথে তিনি একা। অনেক কারণেই ওসব অন্যদের পছন্দের নয়। এছাড়া কেউ যদি তসলিমা নাসরিনের ন্যায়ের পক্ষে কোন কথা বলেন, তাকেও তসলিমার মত একা হয়ে গিয়েই করতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম প্রধাণ কারণগুলো হলো লোভ, স্বার্থ এবং হিংসা। যারা উনাকে পছন্দ করেন না তারা কেন পছন্দ করেন না–সেটা ভেবে দেখলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। তাই এই ব্যাপারে দীর্ঘ বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। টপিকে ফিরে আসি–
তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে যখন ওই অভিযোগ আনা হলো, তখন বেশিরভাগ নাস্তিকই অভিযোগের পক্ষে ছিলেন। অনেকেরই এসাইলাম হয় নি, বিদেশে যেতে পারেন নি, দেশের পরিস্থিতি প্রতিকূলে–এমত অবস্থায় কারো উপর দোষ চাপাতে পারলে কিছুটা ভালো লাগে! কিন্তু কারো একবারও তথ্য-প্রমাণগুলো যাচাই করে দেখার কথা মনে আসে নি। কারণ সেটা করতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাস্তিকদের দল থেকে দলচ্যুত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দলচ্যুত হওয়া আর দল ভারী রাখার ব্যাপারে অনলাইনের নাস্তিক সমাজ খুব সচেতন। তাছাড়া তসলিমা নাসরিন যখন বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে উপকারে লাগছে না তখন তার পক্ষে কিছু বললে যারা উপকার করবে তারা উপকার না-ও করতে পারে। যারা তথ্য প্রমাণ চেয়েছিল তারা ঠিকই তনান্ধ, তনার মুরিদ, তনার পা চাটা কুত্তা ইত্যাদি ট্যাগ খেয়েছিল।
৪) সম্প্রতি আলোচিত এক প্রবাসী দম্পতির একজন ফেসবুকে একটিভ হওয়ার শুরুর দিকে মেসেজ দিয়েছিলেন যে তাঁরা পাল্লাকে খুব ভালো পান। অস্বীকার করব না–গর্ববোধ হয়েছিল। লিস্টে আছেন কিনা দেখছিলাম। না থাকলে হয়তো রিকুও দিয়েছিলাম। খুঁটিনাটি মনে নেই।
তো তসলিমা নাসরিনের সেই বিষয়টি নিয়ে উনারা বিপক্ষে বেশ ধুয়ে দিচ্ছিলেন। সেরকম এক পোস্টে গিয়ে কমেন্ট করলাম যে অভিযোগের পেছনে কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে কি না। না থাকলে এরকম একটা বিষয়ে আপনার মত দায়িত্বশীল ব্যক্তির এ ধরনের অভিযোগ করা সঠিক হচ্ছে কিনা। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে তাঁর কাছে প্রমাণ আছে, কিন্তু তিনি আমাকে প্রমাণ দেখানোর যোগ্য মনে করছেন না। অতঃপর তিনি আমাকে ব্লক দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি এই প্রবাসী দম্পতির বিরুদ্ধে এসাইলাম নিয়ে ব্যবসা করার অভিযোগ উঠছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি এই অভিযোগ মিথ্যা। এছাড়া কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণও নেই। অনেকে সরাসরি এটাকে মিথ্যা বলে গ্রহণ না করে, মানে আগেই জাজমেন্টাল না হয়ে তথ্য-প্রমাণ চেয়েছেন। বিষয়টা ভালো লেগেছে।
উনারা যথেষ্ঠ হেল্পফুল–সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সেটা উনারা যে নিঃস্বার্থ ভাবেই করেন, সেটাও মনে করি। বাইরে যাওয়া, এসাইলাম–এসব ব্যাপারে কোথায় কীভাবে এপ্লাই করতে হবে, কী কী করতে হবে–এসব ব্যাপারে উনাদের অনেক ধারণা থাকায় অনেকরেই এসব তথ্য এবং অনেক সময় অর্থ দিয়েও সাহায্য করতে পারেন–এটা মোটামুটি সবার জানা। তাই বলে কি উনাদের কোনো দোষ-ত্রুটি নেই? অবশ্যই আছে। মানুষ হিসাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব দেখে মনে হচ্ছে–যারা উনাদের সাহায্য পেয়েছেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন, যারা পান নাই–তারা সেসব দোষত্রুটি নিয়ে খোঁচাচ্ছেন। দুইটা বিষয়ই হচ্ছে ওই লোভ আর স্বার্থের উপর বেইজ করে।
যা ভাবছিলাম–শুধু নিজের স্বার্থ উদ্ধার হলেই ভালো বলবেন আর দোষ এড়িয়ে যাবেন, আবার স্বার্থে আঘাত লাগলে দোষ বলবেন আর ভালো দিকটা এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু যখন অন্যায় হলে সেটার প্রতিবাদ করবেন না, ন্যায্য কথাটা বলবেন না বা প্রতিবাদ করা না করা নির্ভর করবে নিজের স্বার্থের উপর–এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আস্তিক-নাস্তিকে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে না।
আবার কী জানি–হয়তো লোভ-স্বার্থ-হিংসা আছে বলেই আমরা ‘মানুষ’, আর আস্তিকতা-নাস্তিকতা হয়তো ইহুদি-নাসারদের কোনো ষড়যন্ত্র…
Leave a Reply