বেগম রোকেয়ার ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে পাই–
“নারীকে শিক্ষার দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন। সীতা অবশ্যই পর্দানশীল ছিলেন না। তিনি রামচন্দ্রের অৰ্দ্ধাঙ্গী, রাণী, প্রণয়িনী এবং সহচরী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধাৰ্ম্মিক—সবই। কিন্তু রাম সীতার প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, একটি পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে-সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ। বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসিতে পারে; পুতুল হারাইলে বিরহে অধীর হইতে পারে; পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনী যাপন করিতে পারে; পুতুলটা যে ব্যক্তি চুরি করিয়াছিল, তাহার প্রতি খড়গহস্ত হইতে পারে; হারানো পুতুল ফিরিয়া পাইলে আহ্লাদে আটখানা হইতে পারে; আবার বিনা কারণে রাগ করিয়াও পুতুলটা কাদায় ফেলিয়া দিতে পারে,—কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না, কারণ হস্তপদ থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ। বালক তাহার পুতুল স্বেচ্ছায় অনলে উৎসর্গ করিতে পারে, পুতুল পুড়িয়া গেল দেখিয়া ভূমে লুটাইয়া ধূলি-ধূসরিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে পারে!!”
এখানে ‘পুরুষ’ রামকে অনেক যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে সার্ফ-এক্সেল দিয়ে ধুয়ে দেয়া হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। তবে এখানে “সীতা অবশ্যই পর্দানশীল ছিলেন না।”–এই কথাটা দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন, সেটা বোধগম্য হলো না। বা এখানে এই কথাটা কিভাবে প্রাসঙ্গিক, তা-ও মাথায় ঢুকছে না। এখানে উল্লেখ্য, বেগম রোকেয়া পর্দাপ্রথার পক্ষে…বোরখা-হিজাবের পক্ষে ‘বোরকা’ নামে পুরো একটা প্রবন্ধ পর্যন্ত লিখেছেন।
একই ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে তিনি পরে আবার ‘মুসলমান সমাজ’ নিয়ে বলেছেন–
” মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের ‘অৰ্দ্ধেক’, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্য। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াই জন’ হই! আপনারা ‘মুহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অৰ্দ্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিম্বা জমীদারী পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন কাৰ্য্যতঃ কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।”
যে ‘মুহম্মদীয় আইন’ নিয়ে বাঁকা কথা বললেন, পরের দিকে সেই মুহম্মদকে নিয়েই তিনি বলেন–
“পয়গম্বরদের ইতিহাসে শুনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-একজন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রী-জাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল তখন হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাহাঁর জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন—কন্যা কিরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।”
মুহম্মদের কন্যা মুহম্মদের কাছে আদরণীয়া থাকতেই পারেন, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো মুহম্মদ কি তার নিজের কন্যাদের বেলায় ‘মুহম্মদীয় আইন’ প্রয়োগ করতেন, মানে তার যদি পুত্র সন্তান থাকত, তাহলে তার কন্যারা কি পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্রের সমান অংশ ভাগ পেতেন?
অবশ্য তার আগে আরকটি প্রশ্ন উঠবে। বেগম রোকেয়া পয়গম্বরদের ইতিহাস নিয়ে যে প্রসঙ্গটি টেনেছেন, সেটা ‘শোনা কথা’-এর দোহাই দিলেও দেখা যাচ্ছে–উনি সেসব বিশ্বাস করেই এই অংশটি লিখেছেন। ইসলামকে মহৎ করে দেখাতে চেয়ে মুসলমানরা ইসলামপূর্ব আরবকে ‘জাহিলিয়াতের যুগ’ মানে অন্ধকারযুগ বলে প্রচার করে থাকেন। তারা বলতে চান–দেখেন, ইসলাম আসার আগে তারা কত বর্বর ছিল, ইসলাম এসে এদেরকে সভ্য করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারই একটা প্রসঙ্গ হলো–‘আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল…’। তাই যদি হবে তাহলে মুহম্মদ কন্যাসন্তান প্রসব করলেন কার গর্ভে? ইসলাম আসার পূর্বে আরবরা যদি কন্যাসন্তান হত্যা করে ফেলত, তাহলে মুহম্মদের জন্মই বা হলো কোন কন্যার গর্ভে? তিনি নিজেই বা বিয়ে করলেন কোন কন্যাকে? শুধু একটা বিয়ে নয়… এতগুলো বিয়ে করার জন্য কন্যা পেলেন কই, এত দাসী পেলেন কই? অনেক শিক্ষিত মুসলমানদের মত বেগম রোকেয়ার মনেও এই প্রশ্ন জাগে নাই!
বেগম রোকেয়া ‘মুহম্মদীয় আইন’-এর বিরোধিতা করছেন, আবার একই সাথে একটি ভুল তথ্যকে সত্য বলে মেনে নিয়ে সেই মুহম্মদকেই নারীজাতির পালক হিসাবে দেখাচ্ছেন। এটা কি উনার স্ববিরোধীতা, নাকি মডারেট মুসলমানদের মত দেখেও না দেখার ভান?
Leave a Reply