আমার তো মনে হয়:
শবে বরাত মানে ভাগ্যের লাশ (শব-এ-বরাত)
কিন্তু ইছলাম বলে অন্য কথা।
শবে বরাত মানে ভাগ্যের লাশ (শব-এ-বরাত)
কিন্তু ইছলাম বলে অন্য কথা।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত ইছলামী নিবন্ধ:
মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
কোরান থিকা ধুমা উঠতেসে ক্যান? |
পবিত্র শবে বরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তাৎপর্যময় রজনী। শবে বরাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘শব’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ রজনী বা রাত, আরবিতে একে ‘লাইলাতুন’ বলা হয়। আর ‘বারাআত’ শব্দের অর্থ মুক্তি, নাজাত, নিষ্কৃতি প্রভৃতি। ‘লাইলাতুল বারাআত’ মানে মুক্তির রজনী বা নিষ্কৃতির রজনী (কেন যে তা ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি বা নিষ্কৃতির রজনী নয়!)। এ রাতে আল্লাহর খাঁটি বান্দারা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে মার্জনা লাভ করে থাকেন। তাই এ রাতকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা শবে বরাত বলা হয়। নবী করিম (সা.) এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শাবান’ অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
মুসলমানদের কাছে শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রজনী অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। আল্লাহ পাক মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা এ রাতে খুলে দেন (বছরের বাকি দিনগুলায় আল্লাহ কিপ্টা। রহমতের দুয়ার এক্কেরে বন্ধ কইরা রাইখা দেন।)। পরম করুণাময়ের দরবারে নিজের সারা জীবনের দোষ-ত্রুটি, পাপকাজ ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার রাত। এ রাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ পরবর্তী বছরের জন্য বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে সবার ভাগ্যলিপি লেখেন এবং বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন (বেজায় বিজি একটা রাত কাটায় আল্লাহ। এতোগুলান বান্দার ভাগ্যলিপি তারে লেখতে হয়। এইটা কি সোজা কথা! কেউ তারে একটা ল্যাপটপ কিনা দিলে কপি-পেস্ট মাইরা খাটনি কমাইতে পারতো ব্যাটায়। আরও একটা মজার কথা। ইসলামে গুনাহ মাফ পাওয়া কী সহজ! আগের সব গুনাহ মওকুফ, অতএব পরের বছর ঠাইসা গুনাহর কাম করো! শবেবরাত তো ফি বছরই আসতেসে।)। এ রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, পরবর্তী বছরের যাবতীয় ফয়সালা হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত, আমল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আদেশ-নিষেধসমূহ ওই রাতে লওহে মাহফুজ থেকে উদ্ধৃত করে কার্যনির্বাহক ফেরেশতাদের (ভাবেসাবে মনে হয়, সর্বশক্তিমান ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হইলেও একলা সব কিছু করার মুরোদ তার নাই। তাই বাধ্য হইয়া একখান অফিস চালাইতে হয়) কাছে সোপর্দ করা হয়।
লাইলাতুল বরাতে মুমিন বান্দাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয় (মনে রাইখেন, যেহেতু বর্ষিত হয়, তার মানে অনুগ্রহ ব্যাপারটা তরল। তরল কিন্তু নানান কিসিমের আছে। খিয়াল কৈরা!) মানুষের ভালো-মন্দ কর্মের হিসাব বা আমলগুলো আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় (ঠিক এই রকম একটা দৃশ্য আমার মাথায় আসে: বস তার চেয়ারে বসা এবং অধীনস্থ কর্মচারিরা ফাইল নিয়া আইসা তার টেবিলে সাবমিট করে)।
শবে বরাতে আল্লাহ তাআলা ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের উত্তরণের পথ দেখান। এ জন্য মুসলমানদের কাছে শবে বরাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রজনী উপস্থিত হয়, তখন সেই রাত্রি জাগরণ করে তোমরা সালাতে নিমগ্ন হবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কারণ আল্লাহ তাআলা এ রাতে সূর্যাস্তের পর পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন (লে হালুয়া! না, শবেবরাতের হালুয়া না। সব সময়ই শুনি, আল্লাহ সব জায়গায় আছে। তাইলে সে কেমনে এক জায়গা থিকা আরেক জায়গায় যায়? আর তারে পুথিবীর আসমানে অবতরণ করনের কী কাম? সে নিজের জায়গায় বইসা কাম সারতারে না? না পারলে সে কেমুন টাইপ সর্বশক্তিমান? যদি সে বান্দাগোরে দেখা দেওয়ার লাইগা পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করতো, তাইলে তার এই কাজের যুক্তি পাওয়া যাইতো।) এবং তাঁর বান্দাদের ডেকে ঘোষণা দিতে থাকেন—আছে কোনো ক্ষমাপ্রার্থী (পুরাই ক্যানভাসারের ভাষা: আছেন কোনও ভাই, কারও লাগবে দুই-এক ফাইল?)? যাকে আমি ক্ষমা করব, আছে কোনো রিজিকপ্রার্থী? যাকে আমি রিজিক দেব? আছে কোনো বিপদাপন্ন? যার বিপদ আমি দূর করে দেব? আছে কোনো তওবাকারী? যার তওবা আমি কবুল করব। এভাবে নানা শ্রেণীর বান্দাকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আহ্বান করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজা, মিশকাত)
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শাবানের ১৪ তারিখের রাতে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন (একই কথা আবার! শব্দসংখ্যা বাড়াইয়া লেখাটারে বড়ো কইরা প্রাপ্য সম্মানী হালাল করার সৎ উদ্যোগ বইলাই মনে হইলো।) এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যক্তি ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (বায়হাকি)। পাপী লোকেরা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিজ নিজ পাপকাজ পরিত্যাগ করে তওবা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শবে বরাতেও তাদের জন্য ক্ষমার দ্বার উন্মুক্ত হবে না (একটু আগে পড়লাম, সে মানবজাতির জন্যে দুয়ার খুইলা দেয় এই রাতে! এখন তাইলে এইটা কী শুনি? স্পষ্ট কইরা কিছু কইতেও পারে না এরা। পরস্পরবিরোধী কথা কওনের অভ্যাস পাইসে মনয় কোরান পইড়া পইড়া।)। শবে বরাত মানুষের নৈতিক চরিত্র গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে বান্দা শবে বরাতের তাৎপর্য অনুধাবন করে সর্বক্ষেত্রে অন্যায় পরিহার এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়। এভাবে ধর্মের প্রতি মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা বহু গুণে বেড়ে যায়। খাঁটি দিলে তওবা তথা অতীত অন্যায়ের জন্য অনুতাপ এবং ভবিষ্যতে তা না করার সংকল্প গ্রহণ করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করলে তিনি অবশ্য তাকে মাফ করতে পারেন (আগের প্যারায় পড়লাম, তওবা করলেই সব মাফ। আবার এইখানে পড়তেসি ‘মাফ করতেও পারেন’। এক্কেরে কোরান সিনড্রোম।)। তাই মুক্তির রজনী হিসেবে লাইলাতুল বরাতের আগমন পাপী-তাপী বান্দাদের জন্য এক অনবদ্য নিয়ামতের ভান্ডার।
এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে নিমগ্ন থাকাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রধান কাজ। এ রাতে তওবা-ইস্তেগফার করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমা লাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, কবর জিয়ারত ও পরদিন নফল রোজা রাখার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হয় এবং ব্যক্তিজীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। নবী করিম (সা.) নিজেও এ রাতে কবর জিয়ারত করতেন এবং ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোজা রাখবে, দোজখের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না (এর মানে কী? সে দোজখে যাইতে পারে, তবে আগুন তারে স্পর্শ করবে না? নাকি তার দোজখে যাওয়ারই কুনো চান্স নাই? দ্বিতীয়টা হইলে কইতেই হয়: এইটাই সহজতম বেহেশতগমন তরিকা।)।’ (আবু দাউদ)
শবে বরাতে করণীয় আমলের সঙ্গে কতগুলো বর্জনীয় বিষয়ও সম্পৃক্ত আছে। এ রাতে অপব্যয় না করে এবং আতশবাজিতে অনর্থক অপচয় না করে সে অর্থ মানবতার কল্যাণকর কাজে বা গরিব-মিসকিনের মধ্যে দান-সাদকা করা অনেক সওয়াব ও বরকতের কাজ। শবে বরাতে আতশবাজি নয়, বরং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে দয়াময়ের করুণা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এ রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি শরিয়তগর্হিত কাজ। এতে অপসংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ইবাদতেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্যকর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে শবে বরাত উপলক্ষে এ দেশে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়। ঈমানদার মানুষের মধ্যে অতুলনীয় এক ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনা পরিলক্ষিত হয়। এ রাতে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই বান্দার একমাত্র কর্তব্য। তাই সৌভাগ্য আর রিজিক বরাদ্দের, জীবন-মৃত্যুর দিনক্ষণ নির্ধারণের রজনীতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে সর্বপ্রকার গোঁড়ামি ও শিরক থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ পাক যেন মুসলিম জাহানের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের জন্য তাঁর রহমতের দরজা সারা বছরই খুলে রাখেন—এটাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
Leave a Reply