• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

পাল্লাহু । pAllahu

দাঁড়িপাল্লা ধমাধম-এর বাংলা ব্লগ

  • পাল্লাব্লগ
  • চুতরাপাতা
  • মহাউন্মাদ
  • ধর্মকারী
  • রেফারেন্স
  • ট্যাগস

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ৮)

You are here: Home / ধর্মকারী / সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ৮)
October 19, 2016
লিখেছেন উজান কৌরাগ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭

নাস্তা খেয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আমি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ ক’রে কম্পিউটার চালু করলাম। ইউটিউবে রাকেশ চৌরাশিয়ার বাঁশি ছেড়ে হারিয়ে গেলাম নিজের ভাবরাজ্যের গহীনে। ক্লাস না থাকলে দিনটা আমি নিজের মতো ক’রে উপভোগ করি; সারাদিন সুরের মধ্যে ডুবে থেকে পড়ি কিংবা ব্লগে লিখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাঁচে ফেলা লেখাপড়ার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে, তাই পরীক্ষার তোড়জোর না থাকলে ছুটির দিনে ক্লাসের পাঠ্যবই ছুঁয়েও দেখি না। আজকাল বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ ফিকশন পড়ে আনন্দ পাচ্ছি না। পড়তে পড়তে মনে হয় পাঠককে খুশি করার জন্য, জনপ্রিয়তা পাবার জন্য এসব লেখা হচ্ছে। সবাই জনবহুল তৈরি পথে হাঁটছে; কিন্তু যে পথটা জনবিরল, খানাখন্দ আর লতাগুল্মে ভরা, সেই পথে কেউই পা বাড়াতে চাইছে না; অথচ সেটা একটা নতুন সম্ভাবনাময় পথ। ওই যে বিতর্ক এড়িয়ে সবার কাছে ভাল থাকার যে সুবিধাবাদী চরিত্র, সেটাই মাটি করছে নতুন সম্ভাবনাকে। বেশিরভাগ লেখক মিথ্যাটাকে মিথ্যা জেনেও তা উন্মোচন করতে চায় না, বরং জনপ্রিয়তার জন্য মিথ্যার ওপর একটা আরোপিত চটকদার প্রলেপ লাগায় এরা। অন্ধকার দেখেও সুচিন্তার আলো ফেলে না, বরং না দেখার ভান ক’রে পাশ কাটিয়ে যায়; প্রগতির পথে কোনো কালো পাথর থাকলেও এরা তাতে আঘাত না ক’রে বা সরানোর চিন্তা না ক’রে খাদে নেমে কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে চ’লে যায়! এইসব বৃত্তবন্দী হৃদয়ের লেখা মুক্ত হৃদয়ের খোরাক মেটাতে পারে না। এই সময়ের হাতে গোনা কয়েকজন লেখকের ফিকশন পড়ছি, আজকাল ফিকশনের চেয়ে নন-ফিকশনের দিকে বেশি ঝুঁকেছি। 
সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই, কথা যেন মন ভরাতে পারছে না। মনের কথাটা কেউ বলছে না, বলছে কেবল আরোপিত কথা। ফলে হয় পুরনো দিনের গান কিংবা লোকগান শুনছি, নয়তো শুনছি ক্লাসিক। আজকাল যন্ত্রসঙ্গীতই বেশি শুনছি। মনটাকে সুরের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো ক’রে শব্দ বসিয়ে ভাবতে বেশ ভাল লাগে। 
এই যা, আমার অর্ধেকটা চা আজকেও প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেল! এরকম প্রায়ই হয় কল্পনার গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হ’লে। যদিও বাসায় থাকলে আমি বেশ সময় নিয়েই চা পান করি, কেননা আমি কাপে চা পান করি না, পান করি মগে। সকাল-সন্ধ্যায় এককাপ আদা চা নিয়ে আমি আমার রুমের দরজা বন্ধ ক’রে নিজের জগতে ডুবে থাকি। অবশ্য এটা শুধু ছুটির দিনে, সকালে ক্লাস থাকলে চা পানের সময় কোথায়! তখন তো ঘুম থেকে উঠেই পড়িমরি ক’রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরি, তারপর চা পান করি ক্যাম্পাসে গিয়ে। 
চায়ে চুমুক দিতে দিতেই বাবার উচ্চকন্ঠ কানে এলো। আবার কার ওপর চোটপাট করছেন, মা নাকি ছোটো আপু? নাকি খানিক বিরতি দিয়ে পুনরায় ব্যবসায়ীদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে? আমি বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম, ‘এগুলো মানুষ না, হিংস্র পশু! ইসলামের দুশমন, ইসলামের শত্রু! ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, কতোগুলো মূর্খ কোরান বিকৃত ক’রে মানুষ হত্যায় নেমেছে।’
আমি নিশ্চিত, আজ আবার ইসলামী জঙ্গিরা কাউকে খুন করেছে, জঙ্গিদের হাতে কেউ খুন হলেই বাবা এসব কথা বলেন। তোতাপাখির মুখের শেখানো বুলির মতো এই কথাগুলোও মডারেট মুসলিমের রপ্ত করা মুখের বুলি! 
গত শতকের শেষভাগ থেকেই ইসলামী জঙ্গিরা তাদের শক্তি প্রদর্শন শুরু করেছে; তারা ১৯৯৯ সালে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী’র দ্বাদশ সম্মেলনের শেষদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করেছে, ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করেছে, ২০০২ সালে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করেছে, ২০০৫ সালে একযোগে তেষট্টি জেলায় সিরিজ বোমা হামলা করেছে; এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে এবং প্রগতিশীল ব্যক্তির ওপর তারা হামলা করেছে; বহুবার বাউলদের আখড়ায় হামলা চালিয়ে তদেরকে মারধর করার পর চুল-দাড়ি কেটে দিয়েছে। আর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে প্রগতিশীল অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা শাহবাগে একত্রিত হয়ে গণজাগরণ মঞ্চ গঠন করলে, ফেব্রুয়ারি মাসেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজিব হায়দারকে হত্যার মাধ্যমে ইসলামী জঙ্গিরা তাদের নতুন হত্যা মিশন শুরু করে। রাজিবের পর অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলয় নীল সহ আরো অনেক ব্লগারকেই তারা হত্যা করেছে এবং হত্যার চেষ্টা করেছে। তবে কেবল ব্লগার হত্যায়ই তারা থেমে থাকেনি, একে একে তারা হত্যা করেছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষক, বাউল, সুফী সাধক, মাজারের খাদেম, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিষ্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিদেশী; মোটকথা তারা ইরাক-সিরিয়ার আইএস-এর জিহাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন মতাদর্শী মানুষ হত্যার মিশনে নেমেছে। 
বাবা বলেই চলেছেন, ‘এরা নাকি জিহাদী! জিহাদ ক’রে ইসলাম কায়েক করবে, বিধর্মী হত্যা ক’রে বেহেশতে যাবে, বেহেশতে যাওয়া এতো সোজা! নবীজী (সঃ) তোদের মানুষ হত্যা করতে বলেছেন! ইসলাম শান্তির ধর্ম, নবীজি (সঃ) শান্তির কথা বলেছেন। আহাম্মক-ইবলিশের দল কোরান বিকৃত ক’রে ইসলামকে বিতর্কিত ক’রে খুন-খারাবিতে মেতেছে।’ 
আমি বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তার এই মুহূর্তের মুখাবয়ব আমি কল্পনা করতে পারছি। এই মুখগুলো চিতই পিঠার ছাঁচের মতো! চিতই পিঠার ছাঁচ থেকে যেমন বারবার একই রকম পিঠা তৈরি হয়, তেমনি আমার বাবার মতো আরো অসংখ্য মানুষের মুখ থেকে ইসলাম সম্পর্কে বারবার একই রকম কথা বের হয়! কথাগুলো এরকম – ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম; ইসলাম শান্তির কথা বলে, ধ্বংসের কথা নয়; ইসলাম মানবতায় বিশ্বাসী, ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না; জঙ্গিরা বিকৃত ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, ওরা সহি ইসলামের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে; জঙ্গিরা মুসলমান নয়, জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই; ইসলাম ভিন্ন মতাবলম্বীদের সম্মান দিতে বলেছে, ইসলাম নারীদেরকে সম্মান দিতে বলেছে ইত্যাদি।’ 
দেশে সুন্নি ইসলামী জঙ্গিদের হাতে ভিন্ন ধর্মের কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের কোনো মানুষ খুন হলেই উপরোক্ত কথা ব’লে জিগির তোলে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, কবি-কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক, নাট্যকর্মী, চিত্রপরিচালক, চিত্রকর, ভাস্কর, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়ার, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, বিজ্ঞানী, মাদ্রাসার কিছু হুজুর, মসজিদের কিছু ইমাম ইত্যাদি নানা শ্রেণী-পেশার মধ্যপন্থী মুসলমান। আমি ভাবি, এরা কি কখনও কোরান-হাদিস পড়েছেন? কেউ কেউ নিশ্চয় পড়েছেন, আবার কেউ কেউ পড়েননি। যিনি পড়েছেন, তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন, আবার যিনি পড়েননি, তিনিও উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। বংশ পরম্পরায় এভাবেই চ’লে আসছে। 
এই দেশের বেশিরভাই মানুষই অশিক্ষিত, তারা কোরান পড়েননি; এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষও কোরান-হাদিস তেমন পড়েননি; এরা ইসলাম ধর্ম সস্পর্কে যতটুকু জেনেছেন, তা পড়ে নয়, শুনে। জেনেছেন জুম্মাবারে খতিবের মুখের জ্বালাময়ী খুতবা শুনে, ইমাম কিংবা মাদ্রাসার হুজুরের কথা শুনে, কোরান-হাদিস পড়া পাড়ার কোনো মুরুব্বীর মুখ থেকে আর ওয়াজ মাহফিলে মওলানাদের মুখে বিপদজনক-বিধ্বংসী ওয়াজ শুনে! ফলে এরা যা শোনেন, তা-ই বিশ্বাস করেন এবং বলেন, নিজেরা পড়ে কোরান-হাদিসের সত্য জানার সামর্থ্য বা তাগিদ এদের মধ্যে নেই। এদেরকেই বোধহয় বলে- ‘শুনে মুসলমান’! 
কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু ক’রে নানা শ্রেণী-পেশার যে সকল শিক্ষিত মধ্যপন্থী মুসলমান কোরান হাদিস পড়েছেন বা পড়েন, তারা স্পষ্টভাবেই কোরান-হাদিসের অর্থ বোঝেন, তারপরও তারা কোরান-হাদিসের প্রকৃত সত্য গোপন ক’রে সচেতনভাবেই কোরান-হাদিসের অশান্ত আকাশে অবিরাম শান্তির পায়রা ওড়াতে থাকেন। এই মধ্যপন্থী মুসলমান দুই রকম চিন্তায় দুটি অংশে বিভক্ত – ছদ্ম মধ্যপন্থী এবং প্রকৃত মধ্যপন্থী। মধ্যপন্থার খোলসে চরমপন্থায় বিশ্বাসী ছদ্ম মধ্যপন্থীরা ছোটবেলায় মনের ভেতর প্রোথিত হওয়া কোরান-হাদিসের শিক্ষা উপেক্ষা করতে পারে না, প্রকাশ্যে শান্তির পায়রা ওড়ালেও ভেতরে ভেতরে এরা জঙ্গিদের সমর্থক, কেননা কোরান-হাদিসলব্ধ বিশ্বাস তারা বুকে লালন করে; তবে এরা কখনোই অস্ত্রধারণ ক’রে ময়দানে নামে না, এরা কেবলই জঙ্গিবাদের নীরব সমর্থক। আর প্রকৃত মধ্যপন্থীরা ভেতরে ভেতরে জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়, তারা সত্যিই জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে; যদিও এদের অন্তরের গুপ্ত কোটরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কিছুটা বিদ্বেষ থাকে আর এরা চায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের পদানত হয়েই থাকুক, তবে তাদেরকে নির্যাতন করার কোনো প্রয়োজন নেই। কোরান-হাদিস পড়ে-বুঝেও এরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তার সঙ্গে, শিক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করে ইসলামের আকাশে শান্তির পায়রা উড়িয়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর মনোচারণা এই অংশে। এই কাজটি এরা ক’রে সমাজে টিকে থাকার স্বার্থে। অন্য অনেক বিষয়ে এদের অগাধ জ্ঞান, বিস্তর পড়াশোনা, তত্ত্বের উপস্থাপন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ; কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে বক্তৃতায় এবং গণমাধ্যমে তারা কথা বলেন অকাট মূর্খের মতো! অথচ ব্যক্তিগত আড্ডায়, ড্রয়িং রুম কিংবা ডাইনিং টেবিলের পারিবারিক আলোচনায় কোরান-হাদিস কিংবা ইসলামের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য ঠিকই আলোচনা করেন। নিজের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েকে সতর্ক করেন যাতে তারা ধর্মান্ধ না হয়, জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট না হয়। 
কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমার বাবা মোটামুটি প্রকৃত মধ্যপন্থীর পর্যায়েই পড়ে, কিন্তু চাচা শতভাগ ছদ্ম মধ্যপন্থী। 
প্রায় ঠাণ্ডা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে বাবার মুখোমুখি সোফায় বসলাম যাতে বাবার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাই। বসেই বললাম, ‘কী হয়েছে, বাবা?’
বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘জঙ্গিরা ঝিনাইদাহে একজন হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা করেছে।’ 
‘বাহ্, রোজার প্রথম দিনেই হত্যার উদ্বোধন ক’রে চাপাতিবাজরা সোয়াব কামিয়ে নিলো!’
বাবা আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় টিভির দিকে তাকালেন। আমি টিভি স্ক্রলে চোখ রাখলাম, ঝিনাইদাহে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নামে একজন পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। গত পরশুদিনও নাটোরের মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসলামী জঙ্গিরা। একের পর এক নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে, খুনিরা খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে আর সরকারের স্টুপিড স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আশার বাণী শুনিয়েই চলেছে, কিন্তু খুনিদের টিঁকিটিও ছুঁতে পারছে না। 
বাবার উদ্দেশে বললাম, ‘যখন জঙ্গিরা একের পর এক ব্লগারদের খুন করতে থাকলো, তখন তোমরা বলতে, ব্লগাররা ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করেছে, ব্লগারদের দোষত্রুটির বিশ্লেষণ করতে। এখন কি বলবে, সুনীল গোমেজ কিংবা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী তো ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করেননি; তবে তাদেরকে কেন খুন করলো ইসলামী জঙ্গিরা?’ 
বাবা আমার কথার শেষ অংশটুকু সম্পাদনা ক’রে পুরোনো রেকর্ড বাজাতে আরম্ভ করলেন, ‘ইসলামী জঙ্গি নয়, ওরা খুনি জঙ্গি। ইসলাম মানুষ খুন করতে বলেনি। ইসলামের সঙ্গে ওদের কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা মুসলমান নয়, ওরা জঙ্গি; জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই!’
‘এটা তুমি ভুল বলছো, বাবা, অবশ্যই ওদের ধর্ম আছে; ওদের ধর্ম ইসলাম, আল্লাহু আকবর বলেই ওরা ঘাড়ে চাপাতির কোপটা দিচ্ছে…।’ 
বাবা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহু আকবর ব’লে মানুষ খুন করছে বলেই ওরা মুসলমান নয়, কোরানের কোথাও আল্লাহ্ মানুষ খুন করতে বলেননি।’
‘আমি তোমাকে একগুচ্ছ কোরানের আয়াত দেখাতে পারবো, যে আয়াতগুলোতে ইসলামে অবিশ্বাসী এবং বিধর্মীদেরকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে; আর হাদিস তো আরো বিধ্বংসী। তুমি দেখতে চাইলে আমি এখনই তোমাকে দেখাতে পারি।’
এবার বাবা খানিকটা অস্বস্তিতে, কিন্তু সহসাই অস্বস্তি কাটিয়ে বললেন, ‘বাংলা অনুবাদে কোরানের অনেক আয়াতেরই ভুল ব্যাখা করা হয়েছে। আরবি এমন একটা ভাষা, যে অন্য ভাষায় তার অর্থ ঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’ 
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘বাবা, আমার ঘরে দুটো কোরান আছে। আমার কম্পিউটারে আরো দুটো কোরানের পিডিএফ ফাইল আছে। এই চারটে কোরান চারজন মানুষ অনুবাদ করেছেন; এদের মধ্যে তিনজন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। এই তিনজন মানুষ যে আরবি ভাষা ভালভাবে না জেনে কোরান অনুবাদ করেছেন আমার তা বিশ্বাস হয় না, এরা আরবি ভাষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত, তাই এই ভাষাটা ভালমতো না জেনে এরা কোরান অনুবাদ করেছেন, এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। আর অন্যজন আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেছেন; এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁর মতো একজন মানুষ কোরানের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা করবেন, এটা একেবারেই অসম্ভব। কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করলে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হতো না বা তিনি দেশে থাকতে পারতেন না।’
বাবা ধমকের সুরে বললেন, ‘ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব কেবল বড় বড় আলেমরাই বুঝতে পারেন, যার তার এসব পক্ষে এসব বোঝা সম্ভব নয়। তোমার মতো বিপদগামী নাস্তিকদের স্বভাবই হলো ইসলাম ধর্মকে হেয় করা আর মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলা।’
আমার বাবার মতো মধ্যপন্থী মুসলমানরা কিছুতেই বুঝতে পারেন না অথবা বুঝতে চান না যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই ইসলামের জন্ম। মুহাম্মদও কুরাইশদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিলেন তাদের তিনশো ষাটটি মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে, ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিলেন; আরবের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি, রীতি-নীতি, সংস্কৃতিতে আঘাত করেছিলেন। আমরা নাস্তিকেরা কলম দিয়ে ধর্মকে আঘাত করি; কখনোই কোনো ধার্মিককে শারীরিকভাবে আঘাত করি না, ধার্মিকদের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা দিই না। কারণ আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি যে, অন্যদের বিরক্ত না ক’রে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চয় আছে। আমরা কোনো প্রাচীর নই, আমরা উন্মুক্ত তেপান্তর। আমরা কেবল ধার্মিকের অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ে আলো ফেলতে চাই। আমাদের আলো গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা। কিন্তু মুহাম্মদ আরবের মানুষকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছিলেন। হত্যা, খুন, লুন্ঠন, ধর্ষণ ক’রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর পরবর্তীতে মুহাম্মদের সাগরেদরা তার বিধ্বংসী মতবাদের প্রচার-প্রসারে সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়েছে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর; একের পর এক নগরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, বিপন্ন করেছে জনজীবন, অস্ত্রের মুখে কেউ হয়েছে ধর্মান্তরিত, কেউবা অস্ত্রের আঘাতে হয়েছে লোকান্তরিত, ধুলিস্যাৎ হয়েছে মানবতা; অবলুপ্ত হয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতি। এখন এই কথাগুলো যদি আমি বাবাকে বলি, তাহলে বাড়িতে যুদ্ধের আবহ তৈরি হবে, এমনিতেই আজ থেকে রোজা শুরু হওয়ায় এদের অন্তরে টগবগ ক’রে ফুটছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য। 
ফলে আমি আর সেই ইতিহাস না তুলে শুধু বললাম, ‘বাবা, ধার্মিকরাও কিন্তু নাস্তিকদের সমালোচনা করে, গালাগালি করে; কিন্তু নাস্তিকরা তার জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, দেয় কলমের মাধ্যমে। পৃথিবীতে আরো অনেক ধর্মের সমালোচনা হয়, কিন্তু কোনো ধর্মের মানুষই মুসলমানদের মতো চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা করে না।’
বাবা কিছু বলতে যাবে, এরই মধ্যে দাদী এসে হাজির, ‘অই, তুই আমার পোলারে কী উল্টাপাল্টা বুঝাস!’
‘তোমার পোলারে আর আমি কী বোঝামু, ছোটবেলায় যা বোঝায়ে দিছো, তাতেই সব বোঝার রাস্তা বন্ধ! যাই, তোমার সাথে এখন আমার ঝগড়া করার ইচ্ছা নাই।’
আমি উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম দাদীর কথা শুনতে শুনতে, ‘আমার পোলা তর মতো নাস্তিকনি, ধর্ম-কর্ম নাই, সমাজ নাই, আত্মীয়-কুটুম না, যহন দোজখে যাবি তহন বুঝবি…!’
দাদী বলেই চলেছে। ঘরে এসে বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখলাম রেলিংয়ে একটা কবুতর বসে ঘরের দিকে উঁকি-ঝুঁকি মারছে, নিশ্চয় আমাকে খুঁজছে! আমার পোষা কবুতর। আমি রান্নাঘরে গিয়ে বাটিতে কিছু চাল নিয়ে দরজা খুলে পা বাড়ালাম ছাদের উদ্দেশে। 
এই কবুতর পোষা নিয়েও কি আমাকে কম লড়াই করতে হয়েছে! বছর তিনেক আগে বাবাকে কবুতর পোষার কথা বলতেই বাবা বলেছিলেন, ‘তোমার চাচা যদি অনুমতি দেয়, তো পোষো, আমার কোনো আপত্তি নেই।’ 
চাচাকে বলতেই চাচার সাফ জবাব, ‘বাড়িতে কবুতর পোষা যাবে না। কবুতরের বিষ্ঠায় ছাদ নোংরা হবে, বারান্দার রেলিংয়েও উড়ে এসে বসবে, মলত্যাগ করবে। আর বাড়িতে পশুপাখির মলমূত্র ছড়ানো থাকলে সে বাড়িতে ফেরেশতা আসে না। অবশ্য এসব তোমার বোঝার কথা নয়।’
উহ, ফেরেশতা, ফেরেশতা, ফেরেশতা! উঠতে বসতে এদের মুখে শুধু ফেরেশতা। সারা পৃথিবীতে দেড়শো কোটির বেশি মুসলমানের কোটি কোটি বাড়ি, সেসব বাড়িতে না গিয়ে এই বাড়িতেই যেন ফেরেশতা ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে! আমি আর কবুতরের বিষয়ে কোনো কথা বলিনি। একদিন ঘরসহ তিন জোড়া কবুতর কিনে নিয়ে এসেছি, ছাদের পশ্চিমদিকে বসিয়েছি কবুতরের ঘর। 
অফিস থেকে ফিরে আমার কবুতর কেনার কথা শুনে চাচা নিজের ড্রয়িংরুমেই হম্বিতম্বি করেছিলেন, সেসব আমার কানেও এসেছিল। এ বিষয়ে বাবা-মা কিংবা দাদীর সাথে তার কোনো আলাপ হয়েছিল কি না, আমি জানি না। তবে আমাকে আর চাচা কিছুই বলেননি, বাবাও না। মা শুধু বলেছিলেন, ‘তোর চাচার আপত্তি সত্ত্বে কবুতর আনতে গেলি কেন? তোকে তো কথা শুনতে হয় না, শুনতে হয় আমাদের।’
ব্যস, ওই পর্যন্তই। এই তিন বছরে আমার কবুতরের বহর বেড়েছে, এখন ত্রিশটার বেশি। এই তিন বছরে সত্যিই আমি বাড়িতে ফেরেশতা দেখিনি, যেমন দেখিনি তার আগেও!
আমি ছাদে ওঠামাত্র আমার হাতে বাটি দেখে কবুতরগুলো বাকবাকুম ক’রে চঞ্চল হয়ে উঠলো। ছাদের নিচু টুলটায় বসতেই ওরা ওদের ঘর ছেড়ে নিচে নেমে এলো। আমি কিছু চাল ছড়িয়ে দিলাম আর কিছু নিলাম হাতের তালুতে। কিছু কবুতর ছাদের চাল খুঁটে খেতে লাগলো, আর কিছু খেতে লাগলো আমার হাত থেকে। কোলের কাছে নিয়ে খাওয়ালেও ওরা আমাকে ভয় পায় না। হাতের তালুতে ওদের ঠোঁটের ঠোক্কও আমি ভীষণ উপভোগ করি। কবুতরগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে আমার একটা গল্প মনে এলো –
‘পড়ন্ত বিকেলে সদ্য ধান-কাটা ক্ষেতে একদল কবুতর কন্ঠে বাক-বাকুম সুর তুলছে আর নেচে নেচে ঝ’রে পড়া পাকা ধান খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। কখনো একে অন্যের সাথে খুনসুটি করছে, কখনো বা কোনো দুষ্টু সঙ্গীর দুষ্টুমি থেকে রেহাই পেতে উড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বসছে। আর এই ক্ষেতেই একাধিক ফাঁদ পেতে সামান্য তফাতে বসে আছে এক নিষ্ঠুর শিকারি। নাচতে নাচতে খেতে খেতে একটা কবুতর হঠাৎ শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে ঝাপটাঝাপটি করতে লাগলো। তা দেখে আতঙ্কিত অন্য কবুতরগুলো উড়ে দূরে গিয়ে পুনরায় খেতে লাগলো। তবে এবার তারা বেশ সতর্ক। এরই মধ্যে শিকারি দ্রুত ছুটে গিয়ে ফাঁদে আটকা পড়া কবুতরটাকে ধরলো, তারপর হাতের ছুড়ি দিয়ে আড়াই পোঁচে কবুতরের গলাটা কেটে ফেললো। রক্তাক্ত কবুুতরটি কিছুক্ষণ ঝাপটাঝাপটি করলো শিকারির হাতের মধ্যে, তারপর তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ায় সে নিথর হলো। 
এরই মধ্যে সতর্ক থাকা সত্ত্বেও ক্ষেতের অন্য প্রান্তে আরেকটি কবুতর ফাঁদে আটকা পড়েছে। যথারীতি শিকারি ছুটে গিয়ে কবুতরটিকে ধরে একইভাবে জবাই করলো। তারপর ক্ষেতের অন্য প্রান্তে আরেকটি…। 
সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটি অবলোকন করলেন একজন মানুষ। নৃত্য করতে করতে কবুতরদের ধান খুঁটে খাওয়া তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন; আবার শিকারির হাতে কবুতরগুলোর জবাই হওয়াও দেখলেন নীরবে দাঁড়িয়ে, তারপর কবুতরগুলো নৃত্য করতে করতে কী ভুল করেছিল, সেই বিষয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন। এখন প্রশ্ন হলো: মানুষটি কে?
উত্তর: একজন মডারেট বা মধ্যপন্থী মুসলমান। 
(চলবে)
Category: ধর্মকারীTag: রচনা
Previous Post:নামাজ বনাম স্বাধীনতা
Next Post:টাইট-আন-নিকাহ্

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাল্লাহু । pAllahu • ফেসবুক • পেজ • টুইটার

Return to top