লিখেছেন নিলয় নীল
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী–
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
…
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর কাব্যিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে। তিনি পারেননি হিন্দু পিতৃতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে। হিন্দু পিতৃতন্ত্র পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পিতৃতন্ত্র। এতোটাই সফল যে, তা নারীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, স্বামীর মৃত্যুর পর তার সাথে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিজেকে পোড়ালে স্বর্গলাভ হয়! হিন্দু পিতৃতন্ত্র এতো বেশি সফল যে, রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভারাও এই পিতৃতন্ত্রের জয়গান গেয়েছেন। সেই পিতৃতন্ত্রের রাজত্ব এখনও ভালোভাবেই বহাল আছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটা কথা বলেছিলেন, “যাঁরা দাবি করেন, সনাতন ধর্মের নির্ভুল বিধি-ব্যবস্থার জন্যই তা এতো হাজার বছর ধরে তা টিকে আছে, তাঁদেরকে বলতে চাই: টিকিয়া থাকাটাই চরম সার্থকতা নয়। অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে , কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।”
শরৎচন্দ্রের ভাষাতে বলতে হয়, আজকে আমরা তেলাপোকা কতোটা নারীস্বাধীনতা দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করবো।
সনাতন ধর্ম হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্ম। এর আরেক নাম হলো হিন্দুধর্ম। এই ধর্মের ধর্মগ্রন্থের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই প্রত্যেকটা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়াটা আমার পক্ষে কেন, অনেক বড়ো বড়ো লেখকের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই আমি হিন্দুধর্মে প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মগ্রন্থগুলোতে নারীর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো। আগেই স্বীকার করে নিই, লেখাটা পুরোপুরি আমার মৌলিক নয়। তা লেখা হয়েছে বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন লেখা থেকে ও বিভিন্ন ধর্মীয় বই থেকে সংকলিত করে।
সনাতন ধর্মানুসারী অনেক প্রগতিশীল (!) মানুষ দেখেছি, যাঁরা বলেন, হিন্দুধর্ম নারীকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছে। ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ ও গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত থাকার কারণে এইসব তথাকথিত প্রগতিশীল হিন্দু সমালোচনা করে ইসলামিক শরিয়া আইন ও নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করাকে। কিন্তু তারা সমালোচনা করে না সতীদাহ প্রথার। আবার অনেকে স্বীকারই করে না যে, সতীদাহ প্রথা বলতে কিছু ছিলো হিন্দু ধর্মে। লেখাটা তাঁদেরকে উৎসর্গ করলাম।
সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। এই কারণে এই ধর্মের আরেকটি নাম হলো বৈদিক ধর্ম। শুক্লযজু বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করা হয়েছে এভাবে: “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)।
শতপথ ব্রাহ্মণের ১৩ নম্বর শ্লোকে আমরা পাচ্ছি: “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিৎ, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩)।
বৃহদারণ্যকোপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেন: “স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কেনবার’ চেষ্টা করবে, তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে” (৬/৪/৭, ১/৯/২/১৪)।
হিন্দুধর্মের মূল উৎস হলো মনুসংহিতা। তাতে মনু খুব ভালো করে নারীদের সম্মান করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন: “নারীরা ধর্মজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় অশুভ,এই শাস্ত্রীয় নিয়ম” (মনুসংহিতা, ৯/১৮) ।
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে: “বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈর্বা পরিবর্জিতঃ/উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেবব” (৫:১৫৪), যেটার বাংলা অর্থ – স্বামী দুশ্চরিত্র, কামুক বা নির্গুণ হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী কর্তৃক সর্বদা দেবতার ন্যায় সেব্য।
আর কোনও স্ত্রী যদি তাঁর স্বামীকে অবহেলা করে, তাহলে তার শাস্তিও বাতলে দেয়া আছে মনুসংহিতায়: “কোনো নারী (স্ত্রী) যদি স্বামীকে অবহেলা করে, ব্যভিচারিণী হলে সংসারে তো নিন্দিত হবেই সাথে-সাথে যক্ষা, কুষ্ঠ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়, শুধু তাই নয় পরজন্মে শৃগালের গর্ভে জন্ম নিবে সেই নারী” (৫:১৬৩-১৬৪)।
স্বামীকে সেবা করার মাধ্যমে স্ত্রীর স্বর্গবাসের নিশ্চয়তাও পাওয়া যায় মনুসংহিতায়: “স্ত্রীদের জন্য স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রত বা উপবাস নেই, শুধু স্বামীর সেবার মাধ্যমেই নারী স্বর্গে যাবে” (৫:১৫৫)।
(চলবে)
Leave a Reply