লিখেছেন স্মরাতুর স্মরণ
আস্তিক-নাস্তিকদের আলোচনায় একটা শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। সেটি হলো – ধর্মীয় অনুভূতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো ধর্মীয় অনুভূতি আসলে কী? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলতে লোকে কী বোঝাতে চায়? এই আঘাতে কি কেউ আহত বা নিহত হন? শরীরের কোনো অঙ্গে কি ব্যথা অনুভূত হয়? তারচেয়েও যে প্রশ্নটি গুরুতর, সেটি হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? কারও বিশ্বাসকে আঘাত করা কতটুকু নৈতিক? আরও প্রশ্ন চলে আসে: নৈতিকতা কী? নৈতিকতা কি চিরকাল একই থাকে?
সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে হয়ত আরেকটা মহাভারত রচিত হয়ে যাবে। তাই আমি শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত. সেটি নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথমেই বলে নেই, এই তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতির খুঁটির জোর কোথায়? রাজনীতিতে? অর্থনীতিতে? নাকি ব্যবসায়? উত্তর হলো – না! এর খুঁটির জোর জ্ঞান নয়, যুক্তি নয়, অর্থ নয়; এর খুঁটির জোর হলো – বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যে খুব একটা মানবীয়, তা কিন্তু নয়; বরঞ্চ এটা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু কথা হলো ‘বিশ্বাস’ কী?
বিশ্বাস মানে হচ্ছে কোনো কিছু্কে সত্য বলে ধরে নেয়া (beliefs are assumed truths)। তার পিঠে যুক্তি আছে কি না, সেটি ভবিতব্য নয়। আর বিশ্বাসের আছে রকমফের। সবার বিশ্বাসও এক নয়। কেউ পুঁজিবাদে বিশ্বাসী কেউবা সাম্যবাদে। তবে ধর্মীয় অনুভূতির বেলায় যে জিনিসটি কাজ করে তা হলো – মব সাইকোলজি। বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন একই বিশ্বাসে প্ররোচিত হয়, তখন তারা আর যুক্তি মানে না; আঁকড়ে ধরে থাকে সেই বিশ্বাসটিকেই। তখন সেই বিশ্বাসটি তাদের ‘মস্তিষ্ক ধোলাই’ করে। বিশ্বাসটির বিপরীতে কোনো যুক্তিই তখন সহ্য করা হয় না। আর যারা সেই বিশ্বাসটি গ্রহণ করে না, তাদের ওপর চলে অত্যাচার।
এখন দেখি, কী কী করলে ধার্মিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে…
# সাধারণত তাদের বিশ্বাসের বিপক্ষে কোনো যুক্তি দিলে (তা সেই যুক্তি যত অকাট্যই হোক না কেন!)
# ধর্মীয় গ্রন্থের কোনো ত্রুটি ধরিয়ে দিলে
# ধর্মীয় পুরুষের চরিত্র নিয়ে কিছু বলা হলে
# কোনো পৌরাণিক বা অলৌকিক কোনো ঘটনায় সন্দেহ পোষণ করলে
কিন্তু যুক্তি ছাড়া বিশ্বাস হাস্যকর। কেউ যদি বলে, মানুষ এসেছে ছাগল থেকে, তাহলে সে লোকের হাসির পাত্র হবে। তাকে হজম করতে হবে হাজারো টিটকারি। কিন্তু ওই কথাটিই যদি কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে তখন? আর একটি উদাহরণ দেই। ভূত-প্রেতে এখন কেউ যদি বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তাকে কী বলবেন? নিশ্চয়ই তাকে পাগল ভাবা হবে। কিন্তু বিশ্বাসটি যদি জ্বীনকে নিয়ে হয় তখন? তখন এই হাস্যকর যুক্তি নিয়ে কিন্তু কেউ আর টিটকারি করতে পারবে না। কারণ এক্ষেত্রে জনবল বেশী অর্থাৎ পেশী শক্তি বেশী। তাই সেই বিশ্বাসের বিপরীতে কিছু বলামাত্রই বক্তার ধড়র আর দেহ আলাদা হবার আশঙ্কা জেগে উঠবে!
অর্থাৎ সেই অনুভূতি-তনুভূতিকে নয়, শ্রদ্ধা করতে হবে পেশী শক্তিকে। তো সহজেই বোঝা গেলো ধর্মীয় অনুভূতি আসলে পেশী শক্তি! এটি সত্যিকারের কোনো শ্রদ্ধার ব্যাপার নয়।
এখন কথা হলো ভূতে-বিশ্বাসীকে টিটকারি করলে যদি নৈতিকতার স্খলন না ঘটে, তবে জ্বীনে-বিশ্বাসীর বেলায় কেন নৈতিকতার সংজ্ঞা বদলে যায়? বিদ্রূপ একটি আপেক্ষিক বিষয়। একজনের কাছে যা বিদ্রূপের আরেকজনের কাছে তাই হয়তো বিষম-বেদনার। পৃথিবীতে যা একমাত্র ধ্রুব, সেই ‘মৃত্যু’ নিয়েও কিন্তু অজস্র বিদ্রূপাত্মক কৌতুক প্রচলিত আছে। তবে ধর্ম কোন ছার? কেন ধর্মীয় কোনোকিছু নিয়ে বিদ্রূপ করা যাবে না? কেন ধর্মকে নিয়ে সামান্য কৌতুক করলে ধর্মানুভূতি আঘাতে জর্জরিত হয়?
যাই হোক, এইসব তথাকথিত ধর্মানুভূতি হলো মূলত পেশী শক্তি আর মব সাইকোলজির ফল। এর সাথে নৈতিকতা বা মানবিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই যেভাবে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্বাস বা অনুভূতিকে টিটকারি করা যায়, তেমনি ধর্মীয় অনুভূতিকেও একই ভাবে টিটকারি এবং অশ্রদ্ধা করা যায়। এতে নৈতিকতা স্থানচ্যুত হয় না।
Leave a Reply