লিখেছেন জেসমিন জুঁই
আপনি নিশ্চয় জানেন, জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিল ক্যাথলিক চার্চ, কারণ তাঁর মতবাদ প্রচলিত ধারণা বা বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। সেই একই কারণে গ্যালিলিওকে করা হয়েছিল আজীবন গৃহবন্দী। তিনি অন্ধ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের অপরাধ ছিল তাঁর যা বলতেন, তা চার্চ ও সাধারণ খ্রিষ্টানদের বিশ্বাসের সাথে মেলেনি। শুধুমাত্র বিশ্বাসের সাথে যায় না বলে একজন বিজ্ঞানীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা! কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর, তাই না?
তাহলে শুনুন, ২০১৫ সালে টিএসসি-র সামনে আমরা একজন লেখককে কুপিয়ে হত্যা করি। কারণ তিনি কিছু বলেছিলেন, কিছু লিখেছিলেন, যা আমাদের পছন্দ হয়নি। তাঁর আহত, অসহায় স্ত্রী সাহায্যের জন্য ছোটাছুটি করেছেন, আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছি। না, এখন এই ঘটনাকে নিশ্চয় অতোটা অমানবিক ঠেকছে না, তাই না?
কেউ কিছু অপছন্দনীয় লিখলে আমরা তাকে কোপাই। এর আগেও কুপিয়েছি, এর পরেও; রাস্তায়, প্রকাশ্য দিবালোকে। এমনকি কেউ প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও। আমরা শোবার ঘরে সাংবাদিক দম্পতিকে কুপিয়ে হত্যা করি। আরো কুপিয়ে হত্যা করি কেউ কিছু না করলেও, যেমন করেছিলাম বিশ্বজিৎ নামের এক পথচারীকে। এসব মনে পড়ে আপনার খারাপ লাগছে? মোটেই না! কারণ আপনি বাঙালি।
আপনি নিশ্চয় হিটলারকে ঘৃণা করেন? সে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিল, দেশ ছাড়া করেছিল আরো ৯০ লক্ষ ইহুদীকে। তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল, তারা ইহুদি। তেমনি মিয়ানমারে, শ্রীলঙ্কায় কিছু মানুষের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল, কারণ তারা ছিল মুসলিম। ভাবছেন, ওরা কী পাষণ্ড! কী রেসিস্ট!
তাহলে শুনুন, আমরা কোনো এক ছুতো পেলেই আমাদের দেশের কিছু মানুষকে – হোক সে আপনার প্রতিবেশী, হোক সে আপনার বন্ধু – অত্যাচার করি, তাদের সম্পদ লুট করি, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিই, মারধর করি। কারণ তারা “মালাউন”! কী, এখন আর নিশ্চয় অতোটা খারাপ লাগছে না?
আমাদের আফগানিস্তান-সিরিয়ার জন্য খারাপ লাগে, খারাপ লাগে না রামু-ব্রহ্মণবাড়িয়ার জন্য। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করলে আমরা কেঁদে বুক ভাসাই, ক্ষোভে ফেটে পড়ি। তারপর তারা যা করেছে, ঠিক সে কাজই এখানে রামুতে করি। নাহ, আমরা মোটেও হিপোক্রেট বা রেসিস্ট নই।
সিরিয়ার এক মৃত শিশুর উপুড় হয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য আমাদের খুব ব্যথিত করে। শুধু আমরা ব্যথা পাই না পূজার যোনি কেটে ধর্ষণ করার সময়। আপনি নিশ্চয় “যোনি” শব্দটা উচ্চারণ করায় খুব লজ্জা পেয়েছেন? তবে তার সিকিভাগ লজ্জাও হয় না ৫ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করার সময়, ফেলানির জন্য মায়াকান্না করে সেনানিবাসে ধর্ষণের পর তনুকে হত্যা করার সময়।
এতকিছু শুনেও আপনার নিশ্চয় কোনো ভাবান্তর নেই। আমরা যে বাঙালি জাতি, বীর বাঙালি! ব-তে বীর। কিন্তু কী জানেন, ব-তে আরেকটা শব্দও হয়… বর্বর। তবে আপনি নিশ্চয় শতভাগ নিশ্চিত, সেটা আমরা কখনোই নই! এইসব বাদ দিন, তারচে’ চলুন, আমরা খেলা দেখি। মাশরাফিরে স্যালুট দিয়া দেশপ্রেমিক কইয়া লম্বা লম্বা স্ট্যাটাস মারি।
অফ টপিক: আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী তো একজন ক্রিকেটারকে বাড়ি গিফট করছেন, পরবর্তী ক্রিকেটারকে কী গিফট দেবেন, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন তো?
Leave a Reply