আগেরকালে আগ্রাসন, ঔপনিবেশ, আধিপত্যবাদের সহজ সরল রুপ থাকলেও সভ্যতা এবং প্রযুক্তির কল্যানে আধিপত্যবাদের বিবর্তন ঘটছে। এখন আর দেশ দখল করতে হয় না বা মানুষের ট্যাক্সের টাকায় মানুষের বুকেই বন্দুক ধরা সৈন্য দিয়ে গনহত্যা চালাতে হয় না, এখন ঢুকিয়ে দিতে হয় বানিজ্য-সংস্কৃতি-ধর্ম, চুষে নিতে হয় সম্পদ, পঙ্গু করে দিতে হয় অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি।
প্রধানত তিন ধরণের আধিপত্যবাদী এবং আধিপত্যবাদের দালাল দেখতে পাওয়া যায়।
এক) সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদঃ
হলিউড বলিউড তথা পাশ্চাত্য এবং ভারতের সংস্কৃতি, ভাষা ক্রমাগত ঢুকিয়ে দিয়ে ভাষিক/সাংস্কৃতিক বলয়ের ব্যাপ্তি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এই আধিপত্যবাদের সুচনা। এরপরে সেই বলয়ে প্রবেশের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রভাববিস্তার, বাজারে পরিণত করা হয় একটা অঞ্চলের মানুষকে, তাদের শেখানো হয়, তোমাদের পাক্কা মুমিন হতে হলে উর্দু আরবী শিখতে হবে, সুসভ্য বিজ্ঞানমনষ্ক হতে হলে ইংরেজী পড়তে হবে, সংস্কৃতিমনষ্ক হতে হলে হিন্দিতে কথা বলতে হবে। সেই সাথে থাকে আরব পারশ্যের ঐতিহ্য নিয়ে কপাল থাপড়ানো, পাশ্চাত্য সভ্যতার জয়গান গাওয়া, ভারত মাতার বন্দনা। দেশের মেধাবীরা ধীরে ধীরে পাড়ি জমায় পাশ্চাত্যে, সঙ্গীত শিল্পী-মেধাবী চিত্রপরিচালকরা পাড়ি জমায় বলিউডে, মমিনগন হিজরত করে মদিনায়। এবং এভাবেই লুট করে নেয়া হয় আমাদের মানবসম্পদ থেকে শুরু করে সবকিছু। আর যারা পাচার হয়ে যায়, তারাও তাদের নতুন নিবাসের স্বার্থ দেখে, অবহেলায় পরে থাকে মাতৃভুমি।
দুই) অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদঃ অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের ব্যাপ্তি বিশাল এবং দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। বানিজ্যের নাম করে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো ভালমানুষের ভেক ধরে ঢুকে পরে, এরপরে ধীরে ধীরে শুষে নিতে থাকে সবকিছু। তারা কিছু পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায়, এবং তাদের একান্ত অনুগত কিছু ভৃত্য তৈরি করে, যারা মন্ত্রী আমলা হয়ে তাদের বিদেশি প্রভুদের স্বার্থরক্ষার জন্য সবকিছুই করতে পারে। আর আমরাই সেই বাঙালী জাত, রাজাকাররা আমাদেরই মাবোনই সাপ্লাই দিয়েছিল পাক হেরেমে। তাই রাজাকারের অভাব বাঙলাদেশে কখনই হয় নি, হবেও না। যারা নিজের দেশের সর্বনাশ করে হলেও আধিপত্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করবেই।
তিন) ধর্মীয় আধিপত্যবাদঃ ধর্মীয় আধিপত্যবাদ বেশ প্রাচীন তবে এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। খ্রীষ্টান মিশনারীরা আজও আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে ঈশ্বরের জারজপুত্র যীশুর গান শুনিয়ে ভন্ড মানবতার কথা বলে বিভিন্ন দেশ থেকে দরিদ্রদের জন্য সংগ্রহ করা টাকা লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে জোকার নায়েকরা টিভি বিজ্ঞাপনের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনের মত ইসলামের বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে। “এই ক্রিম মাখিলে রঙ হইলে উজ্জ্বল, এই হারপিক ব্যাবহারে আপনার টয়লেট হইবে দু্গন্ধমুক্ত” এর মত “এই ধর্ম কবুল করিলে আপনি পাইবেন শান্তি, বেহেশতে ২৭০০০ স্কয়ার ফিটের ফ্লাট, উন্নতবক্ষা হুর, এই গ্রন্থ পাঠ করিলে আপনি পাইবেন জীবন বিধান, (সাথে চার বিবি ফ্রী)” ইত্যাদি বিজ্ঞাপন দেখে মাথামোটা অশিক্ষিত মানুষেরা সারাজীবনের সঞ্চয় ভেঙ্গে হজ্জ করতে পাড়ি জমায় সৌদী আরবে, প্রতিবছর কয়েককোটি হাজী সারাজীবনের সঞ্চয় মক্কায় খরচ করলে সেটা বছর শেষে কি বিপুল অঙ্ক দঁড়ায়, সেটা ভাবতেই আতংকিত হতে হয়। এবং এই আধিপত্যবাদের দালালরাও তাদের ধর্মের নামে কিছু শুনলেই চাপাতি চালিয়ে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই তিন আধিপত্যবাদের দালালই একদল অন্যদলকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। বামদলগুলো বহু ধরণের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, কিন্তু তাদের বড় অংশ ধর্মীয় আধিপত্যবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে আমেরিকা বিরোধীতার স্বা্থে। আবার বাঙলাদেশি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ভারত বিরোধীতা করছে ঠিকই, একই সাথে পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য-আমেরিকার দালালী করতেও ছাড়ছে না। আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী শিবির তো সরাসরিই ভারত-আমেরিকার দালালী করছে, আবার ভোট চাওয়ার সময় হিজাব তসবি ধরছে। একদল খাল কেটে রাজাকার কুমির এনেছে, এরেকদল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মূলা ঝুলিয়ে দেশের সর্বনাশ করছে। ইসলামী দলগুলো অবশ্য নিম্ন বোধবুদ্ধি সম্পন্ন দালাল, আম্রিকা-ইসরাইল মুর্দাবাদ ধ্বনি দিলেও এক সৌদী আব্বাহুজুরদের ইশারাতেই তারা নাঙ্গা তলোয়ার বের করে নারায়ে তকবীর বলে চেঁচিয়ে যাবে। এদের দিয়ে কোন আশা ভরসা নাই।
এই তিন আধিপত্যবাদকে একসাথে চিনতে না পারলে যেকোন অংশের দালাল বা পরোক্ষ প্রশ্রয়দাতা হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। শেষমষ এক আধিপত্যকে থামাতে গিয়ে আরেক আধিপত্যবাদের খপ্পরে ধরাসায়ী। যেই লাউ সেই কদু।
–আসিফ মহিউদ্দীন
December 27, 2011
http://www.facebook.com/atheist.asif/posts/284614824919286
Leave a Reply