লিখেছেনঃ চার্বাক কাজী
সেমিটিক সভ্যতায় ‘আল্লাহ’ নামটি সেই প্রাক-ইসলামিক যুগ থেকেই প্রচলিত; প্রাচীন হিব্রু ও আরামিক ভাষায় তো বটেই, মেসোপটেমীয় ও অ্যাসিরীয় সহ অন্যান্য ভাষাতেও শব্দটি প্রচলিত ছিল। আজও মুসলমানদের পাশাপাশি মিজরাহী ইহুদিরা এবং কপটিক খ্রিস্টানেরা নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তাকে ‘আল্লাহ’ নামেই ডাকে।
ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিক আরবরা আল্লাহকে লাত (পাতালের ও প্রেমের দেবী), মানাত (ভাগ্যের দেবী) ও উজ্জা (সমৃদ্ধি ও কল্যাণের দেবী) -এর পিতা হিসেবেই উপাসনা করত। এর মাঝে সকিফ গোত্রের লোকেরা লাতকে, কুরাইশ গোত্রের লোকেরা উজ্জাকে এবং বনি হেলাল গোত্রের লোকেরা মানাতকে প্রধান উপাস্য বিবেচনা করত।
চন্দ্র দেবতা হুবাল-এর সাথেও প্রধান তিন দেবী আল লাত, আল মানাত ও আল উজ্জা ছিলেন সম্পর্কযুক্ত; তিন চন্দ্রদেবী আল লাত (পুর্নিমার চাঁদ), আল মানাত (অমাবস্যার চাঁদ) এবং আল-উজ্জা ( মধ্যবর্তী চাঁদ) কে চন্দ্র দেবতা হুবাল-এর মাতা ও স্ত্রী রুপেও কল্পনা করা হত।
এমনকি কোরআনও এই তিন প্রভাবশালী দেবীর প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি; সুরা নজমের দুইটি সুরাতে তাদের উল্লেখ আছে।
৫৩/১৯. তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওযযা সম্পর্কে
৫৩/২০. এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?
ইসলামের প্রথম যুগে, মুহাম্মদ যখন ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন, তখন পৌত্তলিকদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেওয়ার কারনে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা মক্কায় নানাভাবে নিগৃহীত হয়; এমনকি নব্য মুসলমানদের অনেকেই আবিসিনিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন নিজ নিজ প্রান বাঁচাতে। সে সময়ে হতাশ, কাতর, বিষাদগ্রস্ত ও ম্রিয়মাণ মুহাম্মদ টিকে থাকার সংকল্পে মরিয়া হয়ে কাবায় দাঁড়িয়ে এক আপোষকামী আয়াত উচ্চারন করেন, যাতে তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী আল্লাহ’র পাশাপাশি তার অপর তিন কন্যা লাত, উজ্জা এবং মানাতকে উপাস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
নিজ নিজ ঈশ্বরের সম্মানসুচক এই ঘোষণা কুরাইশদের রাগ ও ক্ষোভকে প্রশমিত করে, যার ফলশ্রুতিতে তারা মুহাম্মদ ও মুসলমানদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
আবিসিনিয়া ফেরত মুসলমানেরা অবাক বিস্ময়ে মুহাম্মদকে চেপে ধরে একেশ্বরবাদ থেকে সরে এই শিরক করার কারন জানতে চাইলে মুহাম্মদ চরম শঠতার পরিচয় দিয়ে এই কৈফিয়ত দেন যে শয়তান তার জিহ্বায় ভর করার কারনেই তিনি পূর্বোক্ত সুরাগুলো বলেছিলেন।
পরবর্তীকালে জিব্রাইল নতুন করে “ওহী” নিয়ে আসে এবং শয়তানের আয়াতগুলো বাতিল ঘোষিত হয়; সুরা হজ্জ -এ এই ভুল স্বীকার করা হয়েছে।
২২/৫২. আমি আপনার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল ও নবী প্রেরণ করেছি, তারা যখনই কিছু কল্পনা করেছে, তখনই শয়তান তাদের কল্পনায় কিছু মিশ্রণ করে দিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ দূর করে দেন শয়তান যা মিশ্রণ করে। এরপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়।
২২/৫৩. এ কারণে যে, শয়তান যা মিশ্রণ করে, তিনি তা পরীক্ষাস্বরূপ করে দেন, তাদের জন্যে, যাদের অন্তরে রোগ আছে এবং যারা পাষাণহৃদয়। গোনাহগাররা দূরবর্তী বিরোধিতায় লিপ্ত আছে;
সালমান রুশদী তাঁর স্যাটানিক ভার্সেস বইটিতে এই আয়াত নাজেল, পরিবর্তন ও সংশোধনের বিষয়টা নিয়ে গল্পাকারে ব্যাখ্যা করার কারনে আয়তুল্লাহ খোমেনী তাঁর মৃত্যুদন্ডের ঘোষণাও দেন।
আল্লাহ নামের উৎস নিয়ে প্রবল বিভ্রান্তি আছে বলেই, সে নাম নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তাঁর সাদৃশ্য আছে বলে মত প্রকাশ করা সুরা এখলাছের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১১২/১. বলুন, তিনি আল্লাহ্, এক,
১১২/২. আল্লাহ্ অমুখাপেক্ষী,
১১২/৩. তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি
১১২/৪. এবং তার সমতূল্য কেউ নেই।
মুহাম্মদের সেই গোঁয়ার্তুমির সুত্র ধরে আজ বিভিন্ন মুসলিম দেশ এই শর্ত আরোপ করছে যে, অমুসলিমরা ‘আল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। মালয়েশিয়ায় সেটি নিয়ে আইনও করা হয়েছে।
মানব সভ্যতার ইতিহাস মুছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা ও ইতিহাস বিকৃত করা যে নৈতিক অপরাধ, সে বোধটাই ধর্মান্ধ মুসলমানদের নেই।
তথ্যসূত্রঃ
The Cambridge History of Islam, Islamic Society and Civilization
by P. M. Holt (Editor), Ann K. S. Lambton (Editor), Bernard Lewis (Editor)
Ibn Ishaq, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq’s Sirat Rasul Allah, Translated by A. Guillaume, Oxford University Press, Oxford, England
Al-Tabari (838? – 923 A.D.), The History of al-Tabari (Ta’rikh al-rusul wa’l-muluk), Vol. VI: Muhammad at Mecca, Translated by W. M. Watt and M.V. McDonald, State University of New York Press, Albany, NY, 1988
Leave a Reply