ধর্মের সাথে দারিদ্র্যের সম্পর্ক থাকতে পারে, তবে ধর্মীয় সহিংসতার সাথে কি আছে? মনে হয় না। ভারত উপমহাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিহাস অনেক পুরানো। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত অত্যাচারিত হয়ে এরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে বা অত্যাচারিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে এদের ধর্মীয় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার নজির নেই বললেই চলে। উচ্চবর্ণের অত্যাচারী হিন্দুদের কারণে আগে যেখানে নিজের ধর্মটা ঠিকমতো পালন করতে পারত না, ইসলাম গ্রহণের পরে সেই সমস্যাটা আর হয়নি। হিন্দুরা ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে এদের এড়িয়ে গেছে; আর এদের ধর্ম পালনে বাধা দেয়নি। এরাও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে ধর্ম পালন করেছে।
ধর্ম পালন বলতে এরা ভগবানের জায়গায় আল্যা বলতে শিখেছে। মন্ত্রের বদলে নামাজ পড়া শিখেছ।–এইটুকুই। এছাড়া অশিক্ষাজনিত কারণে কোরান হাদিস সম্পর্কে নিজস্ব কোনো জ্ঞান ছিল না। হুজুর-মোল্লারা এদের ধর্মের নাম ঠকিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ধর্মীয় সহিংসতা এদের মধ্যে প্রবেশ করেনি। এটা করতে শুরু হয়েছে এই সেদিন, যেদিন থেকে এরা “শিক্ষিত” হওয়া শুরু করেছে, যেদিন থেকে এরা দারিদ্র্যের থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে “শিক্ষিত” লোক। কেউ আর না খেয়েও মরে না। কিন্তু মরছে ধর্মের কারণে। জিহাদের নামে ধর্মীয় সহিংসতায় আকৃষ্ট হচ্ছে দিন দিন।
অথচ হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাস করার শত শত বছরের ঐতিহ্য আছে। হিন্দু-মুসলমানদের পাশাপাশি আরো হাজারো ধর্মের বর্ণের জাতের মানুষরাও একসাথে মিলেমিশে বাস করে আসছে। হিন্দুধর্মের একটা ঘৃণ্যপ্রথা হলো বর্ণভেদ-জাতিভেদ প্রথা। উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের লোকেদের ঘৃণার চোখে দেখে, ধর্মীয় ভাবেও এদের অধিকার খুব কম, সেসব ঘৃণা পাওয়ার পাশাপাশি অনেক ধর্মীয় বিধান না মেনে চললে নানা প্রকার শাস্তিসহ হত্যা পর্যন্ত করা হত এই নিম্নবর্ণের মানুষদের। এই ধারা এখনো বিদ্যমান। খুব সম্ভবত এই কারণেই এই নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই ধর্মান্তরিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
আরবেও এরকম ভেদাভেদ ছিল বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে। বলা হয় ইসলাম এসেছিল সেই ভেদাভেদ মুছে দিতে। কিন্তু ইসলাম বা মুহাম্মদ সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ ইসলামেও ৭২টা সেক্টের কথা শোনা যায়, যারা একে অন্যরে ভিন্নমতের জন্য শুধু ঘৃণাই করে না, সুযোগ পেলেই হত্যা করে। নবি মারা যাওয়ার মুহুর্ত থেকেই সেই খুনোখুনি শুরু হয়ে আজ আরব-মিডলইস্টসহ সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও তার ঢেউ এসে লেগেছে।
কিছুদিন শিয়াদের মিছিলে বোমা হামলার পরে নতুন খবর এসছে–“বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে হতাহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রায় তিন দশক ধরে এই এলাকায় সুন্নি ও শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসীরা একসঙ্গে বাস করছে; কখনো ধর্মীয় কোনো বিষয় নিয়ে বিতণ্ডা হয়নি। হঠাৎ মসজিদে নামাজের সময় এধরণের হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়েছেন উভয় সম্প্রদায়ের মুসলিমরা।”
এই সমস্যা শুধু মুসলমানদের নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা ভিন্নমতের জন্য অমুসলিম, নির্ধর্মীদের উপরেও “জেহাদ” চালায়। এইখানে জেহাদ শব্দে অনেক শান্তিপ্রিয় মুসলমানের আপত্তি থাকতে পারে। তারা বলতে পারেন এই জেহাদ সেই জেহাদ নয়, এই জেহাদ হলো মনের কুবৃত্তিকে হত্যা করার জেহাদ। কিন্তু আরেক শ্রেণীর মুসলমান আপনাদের এই ধারণাকে কোরান-হাদিসের আয়াত দিয়ে ভুল প্রমাণ করে দেখাবে যে এই জেহাদ মানে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোতল করার জেহাদ। মজার ব্যাপার বলো, এই কথাগুলো কোরান-হাদিস থেকে নাস্তিকরা বললে নাস্তিকদের উপর ক্ষেপে যাওয়ার লোকের অভাব হয় না, কিন্তু যখন একদল মুসলমানই এই কথাগুলোর দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা করে, তখন সবাই চুপ থাকেন। যারা ধর্ম মানেন, কিন্তু ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা সাপোর্ট করেন না, তাদেরকে এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না।
যা বলছিলাম, ধর্ম একটা ব্রেইনওয়াশকারী জিনিসের মত ব্যবহৃত হচ্ছে। আপনি যেমন ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা না করলেও ছোটবেলা থেকেই ঘৃণা করা শিখছেন, তেমনি আপনার সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিয়ে আসছেন। পরিবার এবং ধর্ম থেকে তারা এই ইদানিং এই ঘৃণা করার শিক্ষাটা এতো বেশি পাচ্ছে যে এখন এটা শুধু ঘৃণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেই ঘৃণা আজ মহীরুহ হয়ে এতটাই ডালপালা গজিয়েছে যে তারা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করতে যেমনটি করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। এই শিক্ষার জন্য ধর্ম আর আজ সেই ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন না হয়ে মানুষ হত্যার অনুশীলন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনই সময় উপলব্দি করার এবং অন্যদেরকেও বোঝানোর যে ঘৃণা আর খুনোখুনি কোনো সমাধান নয়। বাঁচতে হলে সবাইকে সাথে নিয়ে একসাথে বাঁচতে হবে। না হলে এই রক্তবীজ শুধু ঘৃণা আর খুনোখুনি শিখতে শিখতে একদিন নিজেদেরকেও বিনাশ করে ফেলবে।
Leave a Reply