বোরখাওয়ালীর সাথে যৌন-নির্যাতন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তার মতে মেয়েরা নাকি ছোটবেলা এটাকে স্বাভাবিক হিসাবেই নেয়। মনে করে তারা মেয়ে, ছেলেরা একটু আধতু ওরকম করবেই। বিষয়টা অনেকে মজাও পায়, আবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে বিরক্ত হয়। কিন্তু এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্যও করে না। নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার মনে করে, কিছু সময় পরে আবার ভুলে যায়। কারণ নতুন নতুন ঘটনা ঘটে চলছেই…
সমস্যা শুরু হয় যখন কারো প্রেমে পড়ে। তখন ওই একজনের স্পর্শ বাদে আর সব স্পর্শ মেনে নেয়ার মেণ্টালিটি থাকে না। অথবা যখন বুঝতে শেখে যে এটা তার জন্য অপমানের। সমস্যা হয় তখন যখন নিজেকে মানুষ ভাবতে শুরু করে। এগুলো তখনই হয়, যখন “শিক্ষিত” হতে শুরু করে। পুরুষেরা এটা বোঝে বলেই চায় মেয়েরা পড়াশোনা না করুন, বাইরে না যাক, তাদের চোখ না ফুটুক, ঘরের মধ্যে বসে থাকুক শুধু একটা “সেএণ্ডক্সটয়” আর “কাজের মেয়ে” হয়ে।
২. বেগম রোকেয়ার লেখাগুলোকে আমার কাছে জাস্ট দুই পাতা বই পড়ে জ্ঞান ফলানোর মত মনে হয়। এগুলো উনার পুঁথিগত বিদ্যা। অন্যদিকে তসলিমা নাসরিন যা বলেছেন সেগুলো উনার নিজের জীবন থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা। এরকম অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বেগম রোকেয়ার হয় নাই। হলেও তিনি বলেন নাই। যারা তসলিমা নাসরিনকে সহ্য করতে পারেন না (কেন পারেন না, সেটা নিয়ে পরে বলছি), তারা উনাকে ছোট করতে বেগম রোকেয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন।
৩. একজন ছেলে হিসেবে মেয়েদের সব সমস্যার কথা আমার জানার নয়। কিন্তু মেয়েরা তো মুখ খোলে না। ওই যে আগেই বললাম, এগুলোর বেশিরভাগই তারা “মেয়ে হিসাবে” মেনে নেয় মুখ বুজে। মনে করে এটাই স্বাভাবিক। আর যারা মুখ খোলে, তাদেরকে আমরা “নষ্টা মেয়ে” বলে গালি দেই।
ছেলে হিসাবে মেয়েদের ব্যাপারগুলোতে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওই বেগম রোকেয়ার মত জাস্ট পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞান ফলানো মনে হয়। আমরা মনে করি–ওরকম ঘটনা তো অন্য মেয়েদের বেলায় হয়েছে, আমার কাছের কারো তো হয় নাই! তাই এসব ঘটনার গভীরতা বা তাৎপর্য ছেলে হয়ে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবে যদি আপনার মা বোন আত্মীয়া বা গার্লফ্রেণ্ড স্ত্রীদের জীবনের ঘটনাগুলো তাদের মুখ থেকে শোনেন, তাহলে নির্ঘাত আপনার মাথায় রক্ত উঠে যাবে। এদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে শুনে দেখবেন।
৪. বোরখাওয়ালী যখন বলে ছোটবেলায় কাজিনরা বেড়াতে এলে রাতের বেলা চুপি চুপি বিছানায় উঠে আসত। এমনকি সমবয়সী মামা-চাচারাও। (এ ধরনের কথা বেগম রোকেয়া কোনোদিন বলে যান নাই। বলেছেন শুধু তসলিমা নাসরিন। পুরুষের এই রূপটা আমাদের সামনে প্রকাশ করার জন্য তিনি পুরুষের কাছে নষ্টা মেয়ে। এই পুরুষেরা চান তিনি যেন শুধু থিউরি কপচান, যেন এসব বাস্তব ঘটনা না বলেন!) বোরখাওয়ালী বলে আরেকটু বড় হয়ে নিশ্চিত করতে হত সে রুমে একা ঘুমাচ্ছে না, এবং দরজা ভিতর থেকে ভালো করে বন্ধ। আদর করার নামে আত্মীয়স্বজনেরা কোলে নিত, শরীরের নানা জায়গায় হাত বুলাত, দু পায়ের মাঝে শক্ত কিছু চেপে ধরত… বোরখাওয়ালী বলে–তার বান্ধবীরে ভার্সিটির ডিপার্টমেণ্ট হেড খাতায় ভুল আছে বলে বাসায় যেতে বলে, তারপর জোর করে বিছানায় নিয়ে যায়… বোরখাওয়ালী বলে–রাস্তাঘাটে ইচ্ছা করে কত মানুষ ধাক্কা দিয়ে যায়, গায়ে হাত দিতে আসে, হাতের নাগালে না পেলে মুখে বলে… মুখে বলে শ্রদ্ধ্বেয় শিক্ষকরাও। সহ্য করতে না পেরে কান্না করে দিলে আবার পিঠে মাথায় হাত বুলাতে আসে, বলে–“আরে কান্দো কেন! আমি তোমারে কিছু করছি নাকি?” পাস-ফেলের অজুহাতে কতজনরেই না ব্লাকমেইল করে!
এসব শুনে রক্ত গরম হয়, ইচ্ছে করে জানোয়ারগুলোকে খুন করে আসি। আবার এসব শুনে নিজের ভিতরের জানোয়ারটাকেও বলি–তুইও ভালো হয়ে যা! এভাবেই ভালো হই। সবাইকে বলব, তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়তে হবে না, আপনারা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আপনাদের কাছের মানুষদের গল্পগুলোই শুনুন। তাতেই মানুষ হয়ে যাবেন।
৫. মুখ না খোলার কালচার থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসতে প্রথম বলেছেন তসলিমা নাসরিন। এই জন্য তিনি নষ্টা মেয়ে। পুরুষের বাড়া ভাতে এভাবে ছাই তার আগে আর কেউ দেন নাই। উনার দেখাদেখি আর সব মেয়েরাও মুখ খুলুক। কোন কাজিন মামা চাচা শিক্ষক আত্মীয়স্বজন কবে কী করছেন, সব ফাঁস করুক। সব মুখোশ খুলে যাক।
আপডেটঃ একটা পয়েণ্ট মাথায় ছিল, লিখতে গিয়ে বাদ পড়েছে। —
অনেকেই বলেন যে আজকাল নারীবাদীদের লেখায় তসলিমা নাসরিনের লেখা বা কথাই রিরাইট হয়ে ফুটে ওঠে। আমার মনে হয় এটা স্বাভাবিক। তসলিমা নাসরিন যতটা অকপটে খোলাখুলি ভাবে সব বলেছেন, সেটা টপকে যাওয়া খুব সহজ নয়। আর উনার অভিজ্ঞতাও বেশি। তাই অনেককাল উনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবে অন্যরাও যদি এতটা সাহসী হয়ে নিজেদের কাহিনী উজার করে লিখতে শুরু করেন, তাহলে হয়তো নারীবাদ বিষয়ক লেখালেখিতে আরো নতুনত্ব আসবে। এসব লেখালেখিতে সাহসটাই আসল!
Leave a Reply