• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

পাল্লাহু । pAllahu

দাঁড়িপাল্লা ধমাধম-এর বাংলা ব্লগ

  • পাল্লাব্লগ
  • চুতরাপাতা
  • মহাউন্মাদ
  • ধর্মকারী
  • রেফারেন্স
  • ট্যাগস

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ২১)

You are here: Home / ধর্মকারী / সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ২১)
December 28, 2016
লিখেছেন উজান কৌরাগ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০
মাদ্রাসা দুটো অতিক্রম ক’রে আমি রূপনগর খালের পুলের ওপর উঠলাম। পুলের বাম দিকটা ফাঁকা, খালের দিকে তাকালে মনে হয় নাগরিক জঙ্গলের ভেতর থেকে দৈত্যাকৃতির একটা অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে এসেছে; সরু খালের ময়লা-পচা-কালো জল থেকে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। পুলের ডানদিকে পাশাপাশি দুটো চায়ের দোকান; দুটো চায়ের দোকানেই সাতসকালে মানুষের জটলা থাকে, টেলিভিশনে ভারতীয় সিরিয়াল কিংবা বাংলা সিনেমা দেখার ফাঁকে ফাঁকে চা-সিগারেট সহযোগে চলে নানান রকম আলোচনা, এরা প্রাতঃভ্রমণকারী নয়, আশপাশের নিম্নবিত্ত মানুষ; এখন অবশ্য দুটো দোকানের চারটা বেঞ্চে মোটে দু’জন, দু’জনের মাথায়ই টুপি। টেলিভিশন বন্ধ, দোকানের সামনে পর্দা দেওয়া, এক দোকানদারের মোবাইলে বাজছে ইসলামী গান – 
আল্লাহ তুমি অপরূপ
না জানি কতো সুন্দর 
তোমায় আমি সঁপেছি প্রাণ
সঁপেছি এই অন্তর…। 
আল্লাহ্ অপরূপ! কেমন তার রূপ? তবে যে মুমিন মুসলমানরা নিরাকার আল্লাহ্’র কথা বলে! আমি দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে পুলের ঢাল বেয়ে নেমে ইটের এবং মাটির রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম বোর্টানিক্যাল গার্ডেনের গেটে। গেট বলতে চিড়িয়াখানা রোডের মুখের ১ নং কিংবা গড়ান চটবাড়ির দিকের ২ নং গেটের মতো নয়; এখানে দেয়ালের নিচের অংশে ইটের গাঁথুনি নেই। ওপরে দেয়াল, তার নিচ দিয়ে মাথা নিচু ক’রে ঢুকতে হয়। সর্বক্ষণই এদিক দিয়ে প্রবেশ করা যায়, তবে সাতটার দিকে রাস্তার পাশে চেয়ার পেতে চোয়াড়ে গোছের একটা ছেলে বসে থাকে পাশে রাখা টিকিটের ওপর সিগারেটের প্যাকেট আর মোবাইল চাপা দিয়ে, আর কিছুক্ষণ পরই তার জায়গায় বসে একজন বৃদ্ধ। তখন দর্শনার্থীদের ঢুকতে হলে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।

গেটের কাছে পৌঁছতেই লতা-গুল্ম এবং গাছপালার মিলিত গন্ধ ভেসে এলো নাকে; গন্ধটা মনকে সজীব ক’রে তোলে। মাথা নিচু ক’রে গেটের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো পূর্বদিকের দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ, এই আষাঢ় মাসেও কয়েকটি শাখায় থোকা থোকা লাল ফুল নিয়ে গর্বিণী গাছটি ঈষৎ মাথা দুলিয়ে চলেছে। বুক ভ’রে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেতরে রেখে তারপর ছাড়লাম তপ্ত বাতাস, এভাবে বেশ কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে তারপর হাঁটতে শুরু করলাম অরণ্যের গভীরের দিকে। আমি অবশ্য অন্য প্রাতঃভ্রমণকারীদের মতো পিচঢালা পথে হাঁটি না, যদি না রাতে বৃষ্টি হয়। এই নাগরিক অরণ্যের ভেতরেও আরেকটা অরণ্য আছে, সেটার রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ নিতে নিতে যাই আমি। গেট থেকে একটু এগোলেই পিচঢালা সরু পথ ছেড়ে ডানদিকের বাঁকা লেকের ধার ঘেঁষে দু-পাশের নুয়ে থাকা লতা-গুল্মের ভেতর দিয়ে চ’লে গেছে একটা পায়ে চলা পথ, আমি লাল মাটির এই পথেই হাঁটি। পায়ে চলা পথটি কোথাও সরু আবার কোথাও বেশ চওড়া, তবে অসমতল। বাঁকা লেকের ধার দিয়ে প্রচুর হিজলগাছ, হিজলগাছের প্রাণ বড় শক্ত, পানির তলায় কয়েকমাস থাকলেও মরে না; এজন্যই লেকের ধার দিয়ে হিজলগাছ লাগানো, কেননা বর্ষায় লেকের জল বেড়ে গেলে হিজলগাছের গোড়া তলিয়ে যায়। এখন ফুল ফোটার মৌসুম। হিজলের লম্বা লম্বা বোটায় অজস্র ফুল দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে, আর তলায় তো ঝরা ফুলের উৎসব! অজস্র ঝরাফুল ছেয়ে আছে লালমাটি, লতা-গুল্মের ঝোপ, ছোট ছোট সবুজ গাছের পাতা আর পানির ওপর। তিন ধরনের হিজল ফুল; সাদা, গোলাপী আর লালচে। কোথাও লেকের পানির ওপর চিৎ-উপুড় হয়ে মৃদু ঢেউয়ের দোয়ায় দুলছে রাশিরাশি ফুল, আবার কোথাও লেকের কোনার দিকে পানির ওপর ভাসতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ কচুরিপানার বিছানায় আয়েশি ভঙ্গিতে অচঞ্চল; তার-ই মধ্যে গাছের পাতা ভেদ ক’রে ঢুকে পড়েছে লম্বা দু-এক ফালি রোদ। পায়ে চলা পথটি অদৃশ্য, এখন লেকের ধার দিয়ে অসমতল মাটির আর গাছের শিকড়-বাকড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি হিজল ফুলের সৌন্ধর্য অবলোকন করতে করতে; একেক জায়গায় ফুলের প্রাচুর্যে বিস্ময়ে পা থেমে যায়; জড়াজড়ি ক’রে থাকা সাদা, লালচে, আর গোলাপি ফুলের দৃষ্টি জুড়োনো সম্মিলিত সৌন্ধর্য আর রাশি রাশি ফুলের মাদকতাময় মিষ্টি গন্ধের সম্মোহন বাণে আমি ধরাশায়ী হই! গাড়ির শব্দ নেই, মানুষের কথা নেই; কেবল গাছগাছালিতে বিচরণরত বিচিত্র সব পাখির কণ্ঠস্বর, বসন্তকাল নয় তবু থেকে থেকে কানে আসে কোকিলের ডাক; চারদিকে তাকালে কেবল গাছপালা আর লেকের পানি এবং জলজ উদ্ভিদ চোখে পড়ে; মনে হয় যেন কোনো এক অপার্থিব জগতে এসে পড়েছি! সময়ের হিসেব লুপ্ত হয়, আমি যেন পাঁচ হাজার বছর আগের কোনো এক কিরাতপুত্র, তবে পৈত্রিক ধর্ম-কর্ম বর্জন ক’রে পশু-পাখি হত্যার বদলে তাদের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, পশু-পাখির দল আমাকে দেখে পালিয়ে যাবার বদলে বিশ্বাস ক’রে ভালবেসে কাছে আসে, পশুরা গা ঘেঁষে বসে আর পাখিরা ভালবেসে গান শোনায়! একটা গুঁইসাপের চলার শব্দে আমার সম্মোহন লুপ্ত হলো, হালকা বাতাস এসে উস্কানি দিলো যৌবনে! নিঃসঙ্গতা চাগাড় দিয়ে উঠলো হঠাৎ। ইচ্ছে করছে তলা থেকে এক আঁজলা ফুল কুড়োই, কুড়িয়ে….! মনে পড়ছে, ভীষণ মনে পড়ছে…! কিন্তু কী করবো ফুল কুড়িয়ে? ফুল কুড়োনোর ইচ্ছেটা ম’রে গেল! ফুলগুলো তলাতেই ভাল আছে, তলাতেই থাক; গুঁইসাপটা আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিলো, ওর পানিতে ঝাঁপ দেবার শব্দে চাপা প’ড়ে গেল আমার বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস! আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। 
রোজার কারণে গার্ডেন বলতে গেলে ফাঁকা। তিন-চারজন মানুষ চোখে পড়েছে, অথচ অন্য সময়ে বহু মানুষ প্রাতঃভ্রমণে আসে, কোথাও দলবদ্ধভাবে ব্যায়াম করে, কোথাওবা খেলে ফুটবল। আজ একেবারেই সুনসান। আমি কিছুক্ষণ ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করলাম, তারপর বেঞ্চে বসে বিস্কুট খেয়ে পানি পান করলাম। এরপর বেশ উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে হাঁটতে শুরু করলাম গড়ান চটবাড়ির শক্তিসাগর পুকুরপাড়ের উদ্দেশে। 
গোলাপ বাগানের কাছে এসে বেঞ্চে বসা একজনকে দেখতে পেলাম, লোকটা মুখ চেনা। মোবাইলে পুরনো দিনের বাংলা গান ছেড়ে তাকে হাঁটতে বা বসে থাকতে দেখেছি বহুদিন। অন্য সময়ে তার মাথায় টুপি না থাকলেও আজকে মাথায় সাদা টুপি পরেছেন। বদলে গেছে মোবাইলের গানও: 
‘আল্লাহ্, ওগো আল্লাহ্
ক্ষমা ক’রে দাও
মাফ ক’রে দাও 
যতোদিন এই জীবনবীণা বাজিবে
সুপথে চালাও মাফ ক’রে দাও।’ 
গার্ডেনের গড়ান চটবাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে বেড়িবাঁধের রাস্তায় উঠে দাঁড়ালাম, দু’দিক থেকেই গাড়ি আসছে-যাচ্ছে। গাড়ি এলে আসতেই থাকে, একপাশ ফাঁকা হয় তো আরেক পাশ থেকে আসে পিঁপড়ার সারির মতো গাড়ি, এরই মধ্যে একটু ফাঁকা পেলেই দু’দিকে সতর্ক চোখ রেখে রাস্তা পার হতে হয়। বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটওভারব্রিজ খুবই প্রয়োজন। এই রাস্তায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হয়, পনেরদিন আগেও রাস্তার ওপাশের শক্তি সাগর পুকুরের পাড়ে একটা ট্রাক উল্টে গিয়েছিল। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের আমলে নির্মিত হয়েছে এই বেড়িবাঁধ। তারপর অনেকবার সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই এক লেনের এই রাস্তাটিকে আরো চওড়া এবং একাধিক লেন করার কথা ভাবেনি, অথচ এটি ভীষণ ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। গাড়ির চাপ একটু বাড়লেই বিভিন্ন পয়েন্টে জ্যাম লেগে যায়। রাস্তাটা দুই লেন হ’লে অ্যাকসিডেন্ট যেমন কমতো, তেমনি মিরপুর থেকে সাধারণ মানুষ তো বটেই বিশেষত অফিসযাত্রীরা কম সময়ে এবং নিরাপদে চন্দ্রা, শফিপুর, জিরানিতে যাতায়াত করতে পারতো।
একটু ফাঁকা হতেই আমি রাস্তা পার হয়ে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, আমার ডানদিকে শক্তি সাগর পুকুর আর বামদিকে দুটো দোকান। রাস্তার ঢালের কাছাকাছি পরোটা, সিঙ্গারা, পুরির দোকান; দোকানের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে পাটকাঠি আর তাঁবুর ছাউনি দিয়ে কয়েকটি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা; দোকানের পিছনে আলাদা একটা ছাপড়া রান্না করার জন্য; যেখানে সিঙ্গারা এবং নাস্তার তরকারি রান্না করেন দোকানদারের স্ত্রী। দোকানদার বেঞ্চে আর তার স্ত্রী দোকানে ব’সে আছে, রোজার কারণে কোনো খরিদ্দার না থাকায় তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। এই দোকানের পরেই আরেকটি দোকান, চা-বিস্কুট-সিগারেটের; প্রাতঃভ্রমণকারীদের উপস্থিতি না থাকার কারণেই হয়তো এখনো খোলেনি। আমি এই দোকান দুটো পেরিয়ে পরিত্যাক্ত একটি দোকানের চাঙায় কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বসলাম। ঘামে একেবারে নেয়ে উঠেছি। এখন দারুণ আরাম লাগছে তুরাগ নদীর বুক পেরিয়ে আসা অবাধ হাওয়ায়। 
শক্তিসাগর পুকুরের পার আর তার নিচের এই ঢালু জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সব মিলিয়ে আট-দশটি দোকান ছিল আগে। এখন চালু আছে মাত্র দুটি; কয়েকটি দোকানঘর ভেঙে নিয়ে গেলেও পরিত্যক্ত তিনটে ঘর আর তার সামনের কয়েকটি চাঙা এখনো রয়ে গেছে, উইপোকায় খাচ্ছে বাঁশ-কাঠ। শক্তিসাগর পুকুর আর তার পাড়ের সার্ধশতবর্ষী বটগাছকে কেন্দ্র ক’রে জায়গাটা চোটোখাটো একটা পর্যটন কেন্দ্রের রূপ নিতে শুরু করেছিল, কিন্তু মুকুরেই তা বিনষ্ট করেছে প্রশাসন। রোজকার যান্ত্রিক জীবনযাপনের চাপে ক্লিষ্ট মানুষ ছুটির দিনগুলোতে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভিন্ন স্বাদ নিতে এখানে আসতো, অনেকে সার্ধশতবর্ষী বটগাছ দেখতে আসতো। কেবল ছুটির দিনগুলোতে নয়, অন্যান্য দিনগুলোতেও আসতো ছাত্র-ছাত্রী এবং ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা। কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশে টঙ দোকানে ব’সে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতো, মন চাইলে নৌকায় চড়ে তুরাগের বুকেও ঘুরতো। দর্শনার্থীদের জন্য ছই দেওয়া অনেকগুলো ডিঙ্গিনৌকা ছিল; সেই নৌকাগুলোর বেশিরভাগই এখন ছইহীন, চিৎ-উপুড় হয়ে প’ড়ে আছে ডাঙায়। এখন সচল আছে কেবল জেলেদের মাছ ধরা দুটো নৌকা, যা সব সময় এখানে থাকেও না; গার্ডেন লাগোয়া রাস্তার ওপাশের মহল্লার মানুষের নিত্যদিনের কাজ যেমন ঘাস কিংবা কচুরিপানা সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত দুটো নৌকা; আর একটা নৌকা আছে আফজাল ভাইয়ের, সেটাও ছইহীন। আফজাল ভাই একটা ছাতা আর বৈঠা নিয়ে বসে থাকে, কখনো নৌকাভ্রমণে ইচ্ছুক কোনো ভ্রমণপিপাসু বা প্রেমিকযুগল এলে তাদেরকে নৌকায় ঘুরিয়ে আনে। কদাচিৎ পুলিশ এলে আস্তে ক’রে কেটে পড়ে। এখন অবশ্য সে নেই, তার নৌকাটি মাটির গভীরে পুঁতে রাখা লোহার শিকের সঙ্গে শিকল বেঁধে তালা দিয়ে রাখা। 
দর্শনার্থীদের ভিড় বুঝে আশপাশে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কয়েকটি পার্ক এবং রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছিল; যার কয়েকটি এখনো আছে; আর কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে দর্শনার্থীর অভাবে। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা মোটরবাইক নিয়ে যারা আসতো বা সংখ্যায় কম হলেও এখনো যারা আসে, তারা পার্কে কিংবা রেস্টুরেন্টে সময় কাটাতো বা এখনো কাটায়। শোনা যায়, পার্ক এবং রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকেরা বিত্তবান এবং প্রভাবশালী, পুলিশ তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়, যে কারণে ওগুলো টিকে আছে। কিন্তু যারা রিক্সায় এসে নদীর পারে ব’সে, নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে কিংবা টঙ দোকানে ব’সে চা খেতে খেতে গল্প করতো, পুলিশ তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করতো। কেবল হয়রানি নয়, প্রতারণাও করতো। শাহ্ আলী থানার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তারা রিক্সায় আসা তরুণ-তরুণীদের পথেই আটকে দেয়, থানায় আটকানোর ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে রিক্সা ফিরিয়ে দেয়; কখনো কখনো থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয়। ফলে এই ধরনের হয়রানি-প্রতারণার ভয়ে দশনার্থীরা এখন বলতে গেলে আসেই না। পুলিশি হয়রানির ব্যাপারটা না জেনে এখনো যারা আসে, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হয়। এই এলাকা নিয়ে পুলিশের অভিযোগ যে, এখানে অসামাজিক-অবৈধ কার্যকলাপ হয়। অসামাজিক বা অবৈধ কার্যকলাপ বলতে যা তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো, যুবক-যুবতীরা এদিকে এসে নদীর ধারের বিভিন্ন খোলা জায়গায়-নৌকায় ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। নৌকায় বা খোলা জায়গায় কতোটা ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা সম্ভব? কোনো প্রেমিক যুগল যদি একজন আরেকজনের হাত ধ’রে গল্প করে, একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বোনে, একজন আরেকজনের কাঁধে কি বুকে মাথা রেখে কথায় কি মৌনতায় সময় পার করে কিংবা একে অন্যের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে পান করে চুম্বনসুধা, তা কি অপরাধ? এগুলো কি অসামাজিক সম্পর্ক কিংবা সমাজের মানুষ এইসব সম্পর্কে আবদ্ধ নয়? সমাজের মানুষও তো তার প্রিয়জনের ঠোঁটে চুম্বন করে। এই যুবক-যুবতীরাও তো সমাজেরই মানুষ। আর অবৈধ সম্পর্ক? কেউ তো কাউকে বাড়ি থেকে জোর ক’রে তুলে এখানে নিয়ে এসে তার ঠোঁটে চুমু খেতো না, তারা আসতো স্বেচ্ছায়। স্বেচ্ছায় কেউ সম্পর্কে জড়ালে সেই সম্পর্ক কী ক’রে অবৈধ হয়! এখানে মুক্ত পরিবেশে তারুণ্যের প্রেমের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু খোদ ঢাকা শহরেই শতশত হোটেলে-অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশি ছত্রছায়ায় জমজমাট মাদক এবং দেহব্যবসা চলছে! 
পুলিশের এই ধরণের হয়রানি বা তোলাবাজি যে এখন এখানেই চ’লে তা নয়, স্বীকৃত পর্যটন এলাকাতেও এসব চলে। আমার এক সহপাঠী কিছুদিন আগে ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কুয়াকাটা গিয়েছিল ঘুরতে। সন্ধ্যায় বিচ থেকে ফেরার সময় পুলিশ ওদেরকে ধরেছিল। জানতে চেয়েছিল ওরা বিবাহিত কি-না। ওরা হ্যাঁ বলার পরও সম্ভবত ওদের বয়সের কারণে পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল, সেজন্য ওরা যে বিবাহিত তার প্রমাণ দেখাতে বলেছিল। বিবাহের নথিপত্র নিয়ে তো আর কেউ ঘুরতে যায় না, তাই পুলিশ ওদের বাড়িতে ফোন ক’রে অবিভাবকের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশকে পাঁচশো টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল ওরা। যে দেশে তরুণদের প্রেমের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সে দেশে তরুণরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ সহ নানা ধরনের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে তো জড়াবেই। সুস্থ এবং অপরাধমুক্ত সমাজের জন্য চাই তারুণ্যের নির্বিঘ্ন প্রেমের অধিকার। আমাদের দেশে গলিতে-গলিতে মসজিদ, অথচ কারাগারে ঠাঁই নাই ঠাই নাই অবস্থা; পুরাতন কারাগার ভেঙে নতুন কারাগার নির্মাণের পরও ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ অপরাধী রাখতে হয়! আর নেদারল্যান্ডস-এ স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা চুটিয়ে প্রেম করে, সব বয়সের মানুষই প্রকাশ্যে চুমু খায়; অথচ অপরাধীর অভাবে নেদারল্যান্ডের কারাগারগুলো বন্ধ ক’রে দিতে হচ্ছে! 
এই যে এখানে তারুণ্যের প্রেমের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, এর পেছনে অন্য কালো হাতের প্রভাব থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। কারণ প্রেম ব্যাপারটাই তাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই শক্তিসাগর পুকুরপাড়ের সার্ধশতবর্ষী বটবৃক্ষটিকে আগে হিন্দুরা পূজা করতো। আর এই শক্তিসাগর পুকুর এবং প্রাচীন বটবৃক্ষের সৌন্ধর্য ম্লান ক’রে বটবৃক্ষটির খুব কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি দ্বিতল ভবনের মসজিদ ও মাদ্রাসা; নিচতলায় বায়তুল আমান হামিদিয়া জামে মসজিদ, দোতলায় মাবিয়া ইক্করা হাফিজিয়া নূরানি মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এই স্থানটির খুব কাছে মুসলিম বসতি নেই, মুসলিম বসতি এখান থেকে পায়ে হেঁটে অন্তত সাত-আট মিনিটের দূরত্বে। ফলে এখানে মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার; প্রথমত হিন্দুদের পূজায় ব্যাঘাত ঘটানো এবং বন্ধ করা, দ্বিতীয়ত তারুণ্যের প্রেমের জোয়ারে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুরাগ এবং গার্ডেনের জায়গা দখল ক’রে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে; কেননা বাংলাদেশে এটা একটি পরিচিত দৃশ্য যে একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সরকারি খাস জমি, নদী, খেলার মাঠ এসব দখল ক’রে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই গড়ে তোলে মসজিদ এবং মাদ্রাসা। ধর্ম যেহেতু একটি স্পর্শকাতর বিষয়, তাই সরকারী জায়গা দখল ক’রে ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চুপ থাকে এই জন্য যে, বাধা দিতে গেলে যদি এলাকার লোকজন প্রতিরোধ করে, সরকারের গায়ে ধর্মবিরোধী তকমা লেগে যায়! আর অবৈধভাবে জায়গা দখল ক’রে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলে যেহেতু পার পাওয়া যায়, সরকারের দায়িত্বশীল মহলও এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না; এই সুযোগটাই নেয় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা জিনে যোগায়, মধ্যপ্রাচ্যের জিন; সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার ইত্যাদি দেশের সহি জিন! মধ্যপ্রাচ্যের জিনের টাকায় বাংলাদেশের জিনভক্ত মুমিন ভৃত্যরা যত্র-তত্র ভূমি দখল ক’রে গ’ড়ে তুলছে মসজিদ এবং মাদ্রাসা; নিবিড়ভাবে চাষ হচ্ছে জঙ্গিবাদের, ফলনও আশাতীত! আজকাল জিনভক্ত মুমিন ভৃত্যরা টার্গেট করছে নির্জন নদীর পারসহ এমন সব জায়গা, যেখানে বিনোদন কেন্দ্র গ’ড়ে উঠেছে বা উঠছে বা গ’ড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। এমন সব জায়গায় মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ ক’রে বিনোদন কেন্দ্রকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিচ্ছে। উদ্দেশ্যও থাকে তাই, যাতে বেশরিয়তী বিনোদন কেন্দ্রগুলো বিকশিত হতে না পারে। এরা যে ভূমি দখল ক’রে কেবল মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে, তা-ই নয়, এরা আশপাশের ভূমিও দখল করে। মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ এদের প্রাথমিক প্রক্রিয়া, এরপর আশপাশের জমি দখল ক’রে ঈদগাহ বানায়, কালক্রমে সেই ঈদগাহ্ হয়ে ওঠে বাজার। আর মধ্যপ্রাচ্যের জিনদের পাঠানো টাকার সাথে বাজারের দোকান ভাড়ার টাকা যোগ হওয়ার পর একতলা বা দোতলা মসজিদ-মাদ্রাসা ধাই ধাই ক’রে বেড়ে বহুতল হয়, তখন বহুতলের একতলা-দোতলা সুপার মার্কেট হিসেবে ভাড়া দিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার কার্যক্রম চালানো হয় ওপরের দিকের তলাগুলোতে। তখন কোনো কারণে মধ্যপ্রাচ্যের জিনের টাকা পাঠানো বন্ধ হলেও তেমন অসুবিধা হয় না, দোকান ভাড়ার টাকায়-ই চলতে পারে মসজিদ-মাদ্রাসা এবং জঙ্গি কার্যক্রম। যেমনটা হয়েছে আমাদের মহল্লার মসজিদ-মাদ্রাসার ক্ষেত্রে; ঈদগাহ্ এখন মাছ-মুরগী আর সবজির বাজার, একতলা-দোতলা সুপার মার্কেট। 
তবে এখানকার এই মসজিদ এবং মাদ্রাসাটি জমি দখল ক’রে নয়, নিজের জায়গাতেই নির্মাণ করা হয়েছে; ভবন নির্মাণ এবং মাদ্রাসা চালানোর খরচ মধ্যপ্রাচ্যের জিনের থেকে প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনাই বেশি। আর নিজের জায়গায় ভবন নির্মাণ করলেও এরই মধ্যে ভবনের সামনের গার্ডেনের কিছু জায়গা দখল করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো জায়গা যে দখল করবে, সে ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত থাকা যায়, কেননা এই মসজিদ থেকে বেরোতে হয় গার্ডেন অথবা তুরাগের জায়গা দিয়ে, বেড়িবাঁধে উঠার জন্য মসজিদের নিজস্ব কোনো রাস্তা নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে জায়গা দখল ক’রে এখানেও তথাকথিত ঈদগাহ্ এবং মার্কেট নির্মাণের সম্ভাবনা প্রবল। 
মসজিদ-মাদ্রাসা ভবনটি যে ব্যক্তিগত জায়গায় নির্মিত, সেটা আমি জেনেছিলাম এক জেলের কাছ থেকে। প্রৌঢ় জেলের নাম ইয়াসিন মিয়া, বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছিলেন। একথা-সেকথার পর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে তো কেউ খুব একটা নামাজ পড়তে আসে না, আশপাশে কোনো মুসলমানের বাড়িও নেই; তাহলে এখানে মসজিদ নির্মাণ করলো কেন?’ 
‘হাউস জাগছে তাই করছে। ট্যাহা থাকলে মানুষ সোনার জামা পিন্দে, আর এ তো মসজিদ!’
‘মসজিদ কি নিজের জায়গায় করছে, না জায়গা দখল ক’রে?’
‘নিজের জায়গায়-ই করছে।’ এরপর মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে এবং দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে বললো, ‘তয় হ্যার বিচার আছে না? বিচারও করছে!’
‘বিচার…কিসের বিচার?’
‘আল্লাহ্ কন আর ভগবান কন, সে তো একজনই, আমরা তারে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাহি; সেই একজনের বিচার। এই যে দ্যাকতাছেন বটগাছ, এই বটগাছরে হিন্দুরা বহুকাল আগে থেইকাই ত্যাল-সিঁন্দুর-ধান-দূর্বা দিয়া পূজা করতো। এইহানে যে মসজিদ বানাইছে, মসজিদ বানানোর আগে হ্যারে স্বপ্ন দ্যাহাইছিল, হ্যায় যাতে এইহানে মসজিদ না বানায়।’
‘কে স্বপ্নে দেখাইছিল?
‘বুঝতাছেন না?’ আবারো আকাশের দিকে তর্জনী তোলে, ‘ঐ যে, উপরে একজন আছে তেনায়। স্বপ্ন দ্যাহানোর পরও হ্যায় কতা হুনে নাই, মসজিদ বানাইবার লাগছে; তারপর আবারো হ্যারে স্বপ্ন দ্যাহাইছে মসজিদ বানান বন্ধ করনের লাইগ্যা। হ্যায় কুনো কতাই কানে নেয় নাই, গায়ের জোরে মসজিদ বানাইছে। কয়দিন পরই হ্যায় মরছে। আর তার মরণের কিছুদিন বাদেই মরছে তার এট্টা পোলা।’
‘কী বলেন, এসব সত্যি?’
‘মিছা কতা কইলে বাপের জন্মই না! কাছে-কিনারের মানুষরে জিগায় দ্যাহেন যে মসজিদ বানানো পর হ্যারা বাপ-বেটায় মরছে কি-না! হুনেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক আর খিরিশটান; কারো ধর্মরে হেলা করতে নাই। যার যার ধর্ম তার তার, আর সবার উপরে তেনার বিচার।’ 
ইয়াসিন মিয়া এরপর তার জীবনে দেখা এরকম আরো অলৌকিক ঘটনার কথা বলতে থাকে। আমি আর তাকে বলি না যে, চাচা, আমি রোজ রোজ আপনার আল্লাহ্ আর ভগবানের বিরুদ্ধে লিখি; কই আল্লাহ্ বা ভগবান আমাকে তো মারে না! তাছাড়া ভারতবর্ষের মাটিতে বহু মন্দির ভেঙে মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ করেছে, আওরঙ্গজেব মসজিদে উঠার সিঁড়ির ধাপের নিচে রেখেছিল বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, যাতে মুসল্লিরা তা মাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। এখনো সেসব মসজিদের অনেকগুলোই বহাল তবিয়তে টিকে আছে এবং মুসল্লিরা নামাজ পড়ছে। স্বয়ং মুহাম্মদ কাবাঘরের মূর্তি ভাঙায় অংশ নিয়েছিল, কাবাঘরে পূজিত কাঠের ঘুঘুটি তিনি ভেঙেছিলেন; পৃথিবীতে এখনো মুহাম্মদের ধর্ম টিকে আছে আর কাবাঘর এখনো মুসলমানের দখলে। কোরাইশ কিংবা হিন্দুদের ঈশ্বর রেগে গিয়ে মুসমানদের মসজিদ ধ্বংস করেনি বা পৃথিবী থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্নও কনেনি। 
ইয়াসিন মিয়াকে ব’লে আঘাত দিতে চাইনি যে, চাচা পৃথিবীটা ঈশ্বরের নয়; মগজের ধার এবং পেশিশক্তি বেশি যার, পৃথিবীটাও তার; অতএব এই মসজিদও টিকে যাবে। 
যে লোক মসজিদ নির্মাণ করেছে, সে আর তার ছেলে হয়তো প্রকৃতির নিয়মেই মারা গেছে; হয়তো অসুস্থ ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ এটাকে হিন্দুদের পূজার কাছে মসজিদ নির্মাণের শাস্তি হিসেবে দেখেছে, এমনকি মুসলমানরাও! হয়তো যুগে যুগে বিশ্বাসী মানুষদের দ্বারা এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে মিথ্ আর ছড়িয়েছে মুখে মুখে! 
এখানকার বন্ধ হয়ে যাওয়া টঙ দোকানগুলোর মালিক এবং নৌকার মাঝিরা ছিল দরিদ্র, হয়তো দোকান আর নৌকাই ছিল তাদের রুটিরুজির একমাত্র মাধ্যম। দোকান আর নৌকা চালানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে নিশ্চয় তারা বিপদে পড়েছিল। তারা কে কোথায় আছে, জানি না। জানি কেবল একজনের কথা, পুলিশি হয়রানির সম্ভাবনা আর অল্প রোজগার সত্ত্বেও যে এখনো পেশা পরিবর্তন করেনি। কখনো নৌকায় শুয়ে-বসে, আবার কখনোবা ছাতা আর বৈঠা নৌকায় রেখে এসে বটতলার বাঁধানো বেদিতে কিংবা এই পরিত্যক্ত দোকানের চাঙায় ব’সে নৌকাভ্রমণেচ্ছু দর্শনার্থী অথবা প্রেমিক যুগলের অপেক্ষা করে; মানুষ পেলে গল্প করে, আবার কখনো গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে, ‘নদী ভরা ঢেউ বোঝো না তো কেউ, কেন মায়ার তরী বাউ বাউ বাউ রে’ অথবা ‘নড়ে নড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না, কে কথা কয়রে দেখা দেয় না।’ সে কিছু খুঁজে পাক বা না পাক আমি খুঁজে পেয়েছি তাকে। গেল বর্ষার আগের বর্ষায় তার সঙ্গে আমার পরিচয় এখানেই। সেদিন ছিল শ্রাবণের মেঘলা দিন। বর্ষায় জল বেড়ে শক্তিসাগর পুকুরের পাড়ের কাছে এসে পড়েছিল। আমি পাড় ধরে এগোচ্ছিলাম বটগাছতলার উদ্দেশে, বড় বকফুল গাছটির কাছে আসতেই চোখে পড়লো গাছের শিকড়ে বাঁধা ঢেউয়ের দোলায় দোলায়িত নৌকায় শুয়ে মাথার নিচে দু-হাত রেখে বছর চল্লিশের একজন মানুষ চোখ বুজে গাইছে: 
‘মুখে মুখে সব মুসলমান কাজের বেলায় ঠনঠনা
শোনো মওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।’
আমি বেশ চমকে গেলাম! কী দুঃসাহস, সামান্য দূরত্বে মসজিদ-মাদ্রাসা, ওখানকার কেউ শুনতে পেলে একে আস্ত রাখবে! গানটি আমি কখনো শুনিনি, লাইনদুটোর আগে-পরে কী আছে, জানি না। কিন্তু সুরে সুরে এক সত্য এবং সাহসী উচ্চারণ শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম তার দিকে তাকিয়ে। বেশ সুরেলা গলা, নিশ্চয় গাওয়ার অভ্যাস আছে। লাইনদুটো দ্বিতীয়বার গাওয়ার সময় সে হঠাৎ চোখ খুললো আর আমার চোখে চোখ পড়তেই গান থামিয়ে ধড়পড় ক’রে উঠে বসলো, বুঝিবা খানিকটা ভড়কে গিয়ে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। 
(চলবে)
Category: ধর্মকারীTag: রচনা
Previous Post:বুম-বুম ইছলাম
Next Post:অথর্ববেদের ইন্দ্ৰজাল

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাল্লাহু । pAllahu • ফেসবুক • পেজ • টুইটার

Return to top