লিখেছেন হিমালয় গাঙ্গুলী
মুহাম্মদ হিমু সিরিজের অন্যান্য গল্প:
আমি এখন বসে আছি মক্কা থানার ওসি সাহেবের সামনে। আমাকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে সকাল নয়টায়, এখন দুপুর বারোটা। এই তিন ঘন্টায় ওসি সাহেব এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করেছেন, কাগজপত্র নিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি করেছেন এবং কয়েক জনকে ধমকেছেন। আমার দিকে কোনোরকম আগ্রহ দেখান হয় নি। না দেখানই ভালো। পুলিশের দৃষ্টি অতি ভয়ংকর। এদের সামনে তটস্থ হয়ে বসে থাকতে হয়। আমি টাইট হয়ে বসে আছি। ওসি সাহেবের মেজাজ-মর্জি বিশেষ ভালো মনে হচ্ছে না। মেজাজ এভাবে চড়তে থাকলে আমার খবর আছে। সাধারণ সংবাদ শিরোনাম না, একেবারে রাত আটটার আরবী সংবাদ। মনে হচ্ছে, আজ হালুয়া সুদ্ধ টাইট হয়ে যাবে। মহাপুরুষদের হালুয়া-টালুয়া এইসব ইহজগতিক চিন্তা করলে চলে না। আমি জাগতিক চিন্তা বাদ দিয়ে মনের অজান্তে বলে ফেললাম, ‘ইয়া হু!’
ওসি সাহেব আমার দিকে কঠিন চোখে তাকালেন। সাহিত্যের ভাষায় একে বলে সর্পদৃষ্টি। আমি সর্পদৃষ্টি উপেক্ষা করে মধুর গলায় বললাম, ‘কেমন আছেন, স্যার?’
স্যার এবার আরও তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। এর মানে হচ্ছে: “বাঁশডলা খাইলে ঠিকই বুঝবা কেমন আছি”।
আরো আধা ঘন্টা ধৈর্যের পরীক্ষা দিলাম। ধৈর্য অতি জটিল বিষয়। আমার বাবা তার বিখ্যাত উপদেশমালায় বলেছেন, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীল দের পছন্দ করেন।’
ওসি সাহেবের সাথে আমার সওয়াল-জবাব শুরু হল। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তার নাম মনকির কিংবা নকির।
– আপনার নাম
– হিমু। পুরো নাম মুহাম্মদ হিমালয় আলি খাঁ।
– এটা আপনার পুরো নাম?
– জ্বি না। ওস্তাদ ইসরাফিল খাঁ সাহেবের সানাই শুনতে যাওয়ার পথে গ্রেফতার হয়েছি। উনার প্রতি মহব্বত প্রদর্শন করছি বলে আপাতত খাঁ পদবীটা ব্যবহার করছি। লিঙ্গ বিষয়ে আমার কিঞ্চিত আগ্রহ আছে। খাঁ-এর স্ত্রী লিঙ্গ হচ্ছে খানম।
– আপনার পেশা?
পুলিশ
ফুলিশ
গরু
সরু
সিঁড়ি
গাঞ্জা ভরা বিড়ি
ওসি সাহেব থম মেরে রইলেন। ঝাড়া পাঁচ মিনিট থম মেরে থাকার পর গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনাকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে জানেন?”
আমি উদাস গলায় বললাম, “জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই। আমাকে গভীর রাতে রাস্তায় পেয়ে মাঝে মাঝেই থানায় ধরে আনা হয়। আমি কখনই কারণ জানতে চাই না।”
ওসি সাহেব সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘কখনই কারণ জানতে চাননা, কারণ কী?”
আমি গলায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, “কুরআনে সব কিছু আছে, কিন্তু আপনি আমাকে কেন গ্রেফতার করেছেন, তা লেখা নেই। কুরআনের বাইরে কোনো তথ্যই তথ্য না। এই সব আউট তথ্য আমি … দিয়েও পুছি না।”
ভেবেছিলাম আমার ত্যাঁদড়ামি টাইপ কথাবার্তা শুনে আমাকে স্পেশাল কেয়ার রিমান্ডে নেওয়া হবে এবং রোলারের গুঁতা খেয়ে চোখে শর্ষের ফুল দেখতে হবে।
সেরকম কোনো ভাবলক্ষন দেখা গেল না।
দ্বিতীয় প্যাকেটের প্রথম সিগারেটে টান দিয়ে ওসি সাহেব খুক খুক করে কাশতে লাগলেন।
আমি সাহস করে একটা কথা বলে ফেললাম, “স্যার, উটের মুত্র পান করলে কাশি ভালো হয়, হাদিসে আছে।”
– হাদিস জিনিসটা কী?
– স্যার, হাদিস হচ্ছে একটা সেমি-ঐশ্বরিক কিতাব। বিনীতভাবে জানাচ্ছি, বইটির লেখক আমি নিজে ।আমার ইচ্ছে ছিল মালাউন কবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করবেন। তিনি আসতে পারেন নি। তবে দু’চরণ লিখে পাঠিয়েছিলেন। অনুমতি দিলে বলি স্যার?”
ওসি সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। আমি গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলাম:
মনে কর যেন আরব ঘুরে
দণ্ড ধরে যাচ্ছি অন্তঃপুরে
আয়েশা সেথা চিৎ হয়ে রয় পড়ে
পা দু’খানি একটুকু ফাঁক করে…
ওসি সাহেব আমাকে ইশারায় থামতে বললেন। আমি থেমে গেলাম। যারা ক্ষমতাবান, তাদের নানা ধরনের ইশারায় পারদর্শী হতে হয়। আমি যখন সম্পূর্ণ মহাপুরুষ হয়ে যাব, তখন আমাকে নিয়েও এরকম ইশারা চালু হবে। পাখির গু, শ্যাওলা, মাটি, মেঘ এইসব জায়গায় পাবলিক আমার এবং আমার মাথা-খারাপ বাবার নাম খুঁজে পাবে। কারণে-অকারণে সুবহানাল্লাহ-আলহামদুলিল্লাহ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে।
ওসি সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, “আপনি কি জানেন, আপনি মানসিক ভাবে কী পরিমান অসুস্থ? আপনি সোসাইটির জন্য একটা অভিশাপ?”
আমি ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বললাম, “হতে পারে, স্যার। সব ইহুদি-নাসারাদের ষড়যন্ত্র।”
ওসি সাহেব হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “আপনার মানসিক চিকিৎসা দরকার।”
আমি করুণ মুখ করে বললাম, “ওহ আচ্ছা।”
থানা থেকে ছাড়া পেলাম রাত একটায়। সাড়ে বারোটার দিকে ওসি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, “চলে যান। বহুত ঝামেলা করেছেন এখন ফুটেন।”
আমি অতি দ্রুত ফুটে গেলাম।
আকাশে কৃষ্ণপক্ষের আধখানা চাঁদ। মনোহর কোনো দৃশ্য না। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চাঁদ দেখলেই আমার মধ্যে ঘোর তৈরি হয়। আমি হনহন করে হাঁটা শুরু করলাম।
কোন দিকে হেঁটেছি, জানি না, ঘন্টাখানেক পর দেখলাম, আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার খালাপ্রতিম স্ত্রী খাদিজা বেগমের বাসার সামনে। এই গভীর রাতেও সেখানে আলো জ্বলছে। ঘটনা নিশ্চই ভয়াবহ। আমি দরজায় গিয়ে হাঁক দিলাম, “ইয়া আলি!”
দরজা খুলে গেল। খাদিজা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মধুর গলায় বললাম, “কেমন আছ, খালা?”
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি অসংখ্য বার গালি শুনেছি। আমি মনে মনে গালি শোনার প্রস্তুতি নিলাম।
গালি শুনতে হল না। গলা নামিয়ে খালা বললেন, “ভিতরে এস।”
আমি কমান্ডো স্টাইলে ঘরে ঢুকে গেলাম।
আক্কেল গুড়ুম নামে একটা বাগধারা আছে। ঘরে ঢুকে আমার দৃষ্টি গুড়ুম হয়ে গেল। খাটের উপর নগ্ন হয়ে বসে আছে ইমাম হাসান। তার চোখ বন্ধ। আমি যেহেতু কোনো কিছুতে অবাক হই না, সেহেতু অতি স্বাভাবিক গলায় বললাম, “কী রে হাসান, এরকম নাগা সন্ন্যাসী হয়ে বসে থাকার হেতু কী?”
হাসান ফিস ফিস করে বলল, “ হিমুদা, আমাকে আর হাসান ডাকবে না, এখন থেকে আমার নাম বাদল।”
আমি আরও ফিস ফিস করে বললাম, “বাদল তুই এখন করছিস কী?”
বাদল বলল, “হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করছি। তুমি যা যা কর, আমিও তাই তাই করি। বাস্তবে পারি না বলে কল্পনায় করতে হচ্ছে। এই দেখ না, কল্পনায় তোমার মতো করতে গিয়ে আমি হাতের রেখা উঠিয়ে ফেলেছি।”
বাদল দাঁত বের করে তার রেখাবিহীন হাত দেখাল। আমি বাদলের হাতের দিকে তাকালাম। হাতের রেখাগুলো একসাথে দেখতে অনেকটা আল্লাহু টাইপ লাগছে। আরবী ভাষার মজাই এটা। কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং ধরনের বর্ণমালা। পাবলিককে আউলা ঝাউলা কিছু একটা বুঝিয়ে দেওয়া কোনো ঘটনা না।
বেশিক্ষণ আল্লাহু দেখা গেল না। খাদিজা এসে হুংকার দিয়ে বলল, “তুই হচ্ছিস যত নষ্টের মূল। বাতাস দিয়ে দিয়ে ছেলেটার মাথা নষ্ট করেছিস। গুরুদেব এসেছে আমার! ধ্যান শিখায়!”
এমনিতে খাদিজা বেগম আমাকে কখনও তুই করে বলে না। আজ মনে হয় ভয়াবহ কিছু ঘটিয়ে ফেলেছি।
আমি মধুর গলায় বললাম, “মূল কি না, জানি না, তবে মুলার মতো একটা জিনিস আমার আছে। নুরানী মুলা। ধর্মীয়ভাবে বলতে গেলে মুলা মোবারক।”
খালা আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, “তোর সাগরেদ বিরাট তালেবর হয়ে গেছে! সে এখন কারবালার মাঠে জীবন বিসর্জন দিবে। ইছলামের সৈনিক হয়েছে! বদের বদ হয়েছে!”
আমি আনন্দে খাবি খাচ্ছি এমন একটা ভাব করে বললাম, “ইছলামের সৈনিক তো বদের বদ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আল্লাহের পথে লুচ্চামি বাধ্যতামুলক। হাদিসে আছে। সরাসরি নেই আকার-ইঙ্গিতে আছে। মর্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়!”
খালা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। গাম্ভীর্য বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেল না। খালা “ঘোঁৎ” জাতীয় একটা শব্দ করে ঢেঁকুর ছাড়লেন।
আমি হাস্যমুখে বললাম, “ আমার আশেপাশের নারীদের সবাই দেখছি “বতী” – আয়েশা মায়াবতী, যয়নাব গর্ভবতী, সাফিয়া দুগ্ধবতী, তুমি গ্যাসোবতী। বিদেশে গিয়ে গ্যাস ছেড়ে আসতে পার। হাদিসে আছে, “গ্যাস ছেড়ে আসার জন্য সুদূর চীনে যাও।”
খালা আরেকটি “ঘোঁৎ” ছাড়লেন। এবারেরটা আরো জোরে। আমি বিজয়ীর ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলাম।
রাত তখন অনেক। চাঁদ প্রায় ডোবে ডোবে। আমি প্রায়ান্ধকারে হাঁটছি। কিছুক্ষণ হাঁটতেই আমার শিষ্যসম নাপিত জিব্রাইলের সাথে দেখা। শেষ খবর অনুযায়ী – সে নাপতালি ছেড়ে পাবলিক টয়লেট এর মালিক হয়েছে। “দ্য কাবা পাবলিক টয়লেট”, খুবই ইসলামি নাম।
জিব্রাইলের গা থেকে গাঁজার উৎকট গন্ধ আসছে। হারামজাদাকে দ্য কাবা পাবলিক টয়লেট-এ নিয়ে হেবি ডলা দিয়ে একটা গোসল দেওয়া দরকার। আমি কিছু বলার আগেই জিব্রাইল চিঁচিঁ করে বলল, “জনাব, আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে। কেমন আছেন, স্যার?”
আমি জবাব দিলাম না। দার্শনিক টাইপ ভাব নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “তোমার ওস্তাদ ইস্রাফিল খাঁ সাহেবের সানাই তো শুনালে না।”
জিব্রাইল আমতা আমতা করে বলল, “ওস্তাদের অবস্থা খারাপ। সিদ্ধি খেয়ে সিদ্ধিলাভ করার পর্যায়ে চলে গেছেন। উনি বলেছেন, উনি বাঁশি বাজালে নাকি কেয়ামত হয়ে যাবে।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাদক আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা উল্টাপাল্টা কথা ছাড়া বলে না। এদের কাছে প্রশ্ন করা অর্থহীন।
জিব্রাইলের সাথে আরো কিছুক্ষন সৌজন্যমূলক বাতচিত চালালাম:
– তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
– কোন ব্যবসা?
– দ্য কাবা পাবলিক টয়লেট।
– ওহ আচ্ছা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক ছাগলা এসে টয়লেট বন্ধ করে দিয়েছে। সে বলতে চাচ্ছে, আরবের আবহাওয়ায় শুচু করার জন্য পানির চেয়ে মাটির দলাই শ্রেয়। ঢিলা কুলুপও আবশ্যক। হারামজাদার নাম হচ্ছে মিকাইল।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “যাযাকাল্লাহ খয়রান।”
জিব্রাইলের কাছ থেকে এক স্টিক ঝেড়ে দেবো ভেবেছিলাম। ঝাড়া গেল না। তার আগেই পুলিশের কাছে ধরা খেলাম। ওসি সাহেব নিজে এসেছেন আমাকে ধরতে। নিজের সৌভাগ্যে নিজেই অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমি আনন্দিত গলায় বললাম, “ ভাইজান, বিষয় কী?”
ওসি সাহেব বিরস গলায় বললেন, “বিষয় কিছু না। দোয়া-দরুদ যা যা বানিয়েছিলে, পড়ে ফেল। তোমাদের এক নবী দোয়া পড়ে মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। দেখ ধর্মীয় লাইনে ট্রাই করে কিছু করা যায় কি না। লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
আমি দাঁত বের করে বললাম, “হুজুর কি আমাকে রিমান্ডে নিচ্ছেন? জনাবের কাছে একটা রিকোয়েস্ট, আমাকে মেরে ফেললে পানির ট্যাঙ্কিতে দয়া করে লাশ ফেলবেন না। পরিবেশ দূষণ হয়। পরিবেশ রক্ষাও ঈমানের অঙ্গ।”
ওসি সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি চিৎকার করে বললেন, “শুওরের বাচ্চা, আমার সাথে বিটলামি করস? জিহাদও করস? হারামজাদা, জিহাদ আমি তোর … দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো!”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার প্রবল ইনটিউশন বলছে, আমাকে আজ রিমান্ডে নেওয়া হবে। কপাল খারাপ হলে ক্রসফায়ারেও দিয়ে দিতে পারে। মহাপুরুষদের এইসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হয় না, আমি অস্তগামী চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমরা হাঁটছি। আমার হাতে হাতকড়া। পশ্চিম আকাশে অর্ধেক থালার মতো চাঁদ। আমি হাঁটছি, আমার সাথে চাঁদও হাটছে। জ্যোৎস্না কখনও মানুষকে ছেড়ে যায় না। ঘরের দরজা পর্যন্ত মানুষের সাথে আসে। দরজা বন্ধ করে তাকে ত্যাগ করে মানুষ। জ্যোৎস্না মন খারাপ করে না। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ফাঁক-ফোকর পেলেই সে চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়ে। ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়া ভেদ করে ঢোকার ক্ষমতা চন্দ্রালোককে দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply