ভিন্ন মত পোষণ করতে না পারলে তাকে ‘মুনি’ বলা যায় না। এ থেকেই ‘নানা মুনির নানা মত’ কথাটার সৃষ্টি। এরকম মুনিদের চিন্তাভাবনা ছিল প্রথাগত ঋষিদের থেকে স্বতন্ত্র। একেক মুনি একেকটা মত বা দর্শন নিয়ে কাজ করছেন। এদের মধ্যে ঋষিদের বেদ অস্বীকার করার প্রবণতাও অনেক। অর্থাৎ এদের অনেক মতবাদ বা দর্শন আংশিক বা পুরাই “নাস্তিক্যবাদ”। কিন্তু কোনো না কোনো কারনে বা প্রচারের অভাবে এগুলো ঠিক আলাদা “ধর্ম” হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, যেমন হয়েছে মহাবীর বা বুদ্ধদের জৈন বা বৌদ্ধধর্ম।
ওদিকে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতেও অনেক “নবী” এসেছে। সবার সাথে সবার মতামত মিলে না। তাই বলে সবাই কিন্তু আলাদা ধর্ম বানাতে পারেন নাই। পারছেন শুধু মুসা, ঈশা আর মুহাম্মদ। মতামত সবাই দিতে পারে। যা কিছু “সত্য”, তা পরে বিজ্ঞানের সূত্রে “বৈজ্ঞানিক সত্য” বলে পরিগণিত হয়। যা কিছু ভুল সেগুলোর মধ্যে চাপার জোরে বাহুবলে কিছু ধর্মে পরিণত হয়। বাকিগুলো থাকে শুধু “দর্শন” হিসাবে। এগুলোরও গুরুত্ব আছে–এগুলো আমাদের চিন্তাভাবনার পরিধি বাড়ায়, নতুন কিছু ভাবতে বা সন্ধান করতে অনুপ্রাণিত করে।
যা হোক, আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মত একেশ্বরবাদী ধর্ম, এমনকি জৈন-বৌদ্ধধর্মগুলোর মত ধর্মগুলো যেভাবে সৃষ্টি, বর্তমানে হিন্দুধর্ম বলতে যা বোঝায়, সেটার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া এক নয়। আব্রাহামিকটাইপের ধর্মগুলো বাদে হিন্দুধর্মসহ পৃথিবীর আরো যত ধর্ম, বিভিন্ন সভ্যতায় যেমন মিশরীয়, হরপ্পা, মহেঞ্জাদারো–প্রায় সবই পৌত্তলিক। এমনকি আরবে ইসলাম আসার পূর্বেও যে ধর্ম ছিল সেটা বা সেগুলোও পৌত্তলিক। বর্তমানের হিন্দুধর্ম অবশ্য আগে শতভাগ পৌত্তলিক থাকলেও পরে বৈদিক যুগে এর সাথে একেশ্বরবাদটারও মাখামাখি হয়েছে। তারপর পৌরাণিক যুগে আবার নানান দেবদেবী, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নানান ডালপালা গজিয়ে বর্তমানে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছে। যাদের ধর্মের উৎস সন্ধান করার ইচ্ছে আছে, তাদের কাছে এসব ধাপগুলো একে একে স্পষ্ট হবে। (এসব নিয়ে অনেক বেশি লেখালেখি হওয়া উচিত বলে মনে করি।)
তো প্রায় সব পৌত্তলিকতার বা পৌত্তলিক ধর্মের উৎসই এক। ঠিক যেমন আব্রাহামিক ধর্মগুলো। এগুলো কারো না কারো একার মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যদিও আগের পৌত্তলিকতার অনেক উপাদান এসব আব্রাহামিক ধর্মেও কোনো না কোনো ভাবে রয়ে গেছে। এখন ধর্মের উৎসের সন্ধান করতে গেলে–আব্রাহামিক ধর্মের উৎস জানা খুবই সোজা এবং এর যথেষ্ঠ “ঐতিহাসিক” তথ্য এসব ধর্মের নিজস্ব “ধর্মগ্রন্থেই” রয়েছে। কিন্তু পৌত্তলিকতার উৎস সন্ধান করা কিছুটা জটিল। বিশেষ করে যেখানে যেখানে আব্রাহামিক ধর্মগুলো হানা দিয়েছে, সেখানে এই ধর্মানুসারীরা আক্রমনাত্মক বা ধ্বংসাত্মক মনোভাবের কারণে পৌত্তলিকদের প্রায় সব উপাদান ধ্বংস করে দিয়েছে। কিছুটা উপাদান রয়ে গেছে ভারতের পৌত্তলিকতার মধ্যে। অন্যদের মধ্যে উপাদান থাকলেও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে সেগুলো আমার পক্ষে জানা বা যাচাই বাছাই করা সম্ভব নয়। আমি নজর দেব হাতের কাছে বাংলা ভাষায় বা বাংলায় অনূদিত তথ্য-প্রমাণাদির দিকে।
এদিকে বর্তমানে অনেক ভারতীয় বা “ভারতীয় হিন্দু” মনে করে ভারতের ইতিহাস বহিরাগত ইউরোপিয়ানদের বানানো, তাই তারা এগুলো মানতে চায় না। তারা বর্তমানে নিজেদের কিছু কথাকে ইতিহাস বলে চালাতে চায়। তাদের এই কথাগুলোকে মনগড়া বলার আগে এসব ইতিহাসের “বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, তথ্য-প্রমাণের” দাবী তুলতে চাই। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের ইতিহাস রচনা শুধু ইউরোপিয়ানরাই করেন নাই, অনেক ভারতীয় এমনকি বাঙালীরাও এর সাথে যুক্ত। ইতিহাস রচনার পথে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এনারা নিজেরাও করেছেন। তার সাথে ইউরোপিয়ানদের রচিত ইতিহাসের পার্থক্য খুব সামান্যই। যেখানে ইউরোপিয়ানরা “ভুল” করছেন বলে মনে হয়েছে সেখানে এনারা সেই ভুলগুলো “বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা” দিয়ে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এনাদের যুক্তি পরে আবার ইউরোপিয়ানরা খণ্ডন করেছেন কিনা, সেটা ব্যক্তিগত ভাবে আমার জানার সৌভাগ্য হয় নাই।
সব নাম এই মুহূর্তে মনে নেই–বিদেশী পণ্ডিতদের পাশাপাশি আমাদের দেশের হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাখালদাস, অতুল সুর, সুকুমার সেন, রমেশচন্দ্র, হেমন্তকুমার, দিনেশচন্দ্র, নীহাররঞ্জন, দেবীপ্রসাদ, সুকুমারী, ভবানীপ্রসাদ–এনারা ভারত ও বাংলাদেশ, বাঙালী, বাংলা, সাহিত্যের ইতিহাসের এবং ধর্মের উৎপত্তির যে-দিকটা আমদের সামনে তুলে ধরেন, বর্তমানে অনলাইনে কিছু লোক (এনারা মনে করেন সব ব্যাদে আছে) কিছু ওয়েবসাইটের লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে উলটো কথা বলেন। তার মধ্যে একটা হলো, আর্যরা বহিরাগত নয়, অর্থাৎ তারা ভারতের বাইরে থেকে আসে নাই। নতুন এমন কী গবেষণা হয়েছে বা কী এমন যুগান্তকারী তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয় আর্যরা “বহিরাগত” নয়? (অবশ্য তারা বহিরাগত হলেই বা কী আর না হলেই বা কী, তাতে ঠিক কী যায় আসে, সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়।) যেসব নাম উল্লেখ করেছি, তারা নিজেরা অবশ্য দাবী করেন নাই যে তাদের লেখাই শেষ কথা। বরং তারা নিজেরাই অনেক জায়গায় বলে গেছেন যে এসব নিয়ে আরো অনেক গবেষণার দরকার আছে। আমি জানতে চাইছি যে উনাদের পরে আরো এমন কে কী “গবেষণা” করছেন, কী এমন পেয়েছেন যাতে উনাদের কথা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা চলুক…
Leave a Reply