লিখেছেন: সত্যের পূজারী
গত দু-তিন দিন যাবত ফেসবুকে আকার ইঙ্গিতে লেখা বেশকিছু লেখা থেকে ‘পিরিয়ড’ শব্দটা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে দেখছিলাম। আসল ব্যাপারটি কি তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এটা তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বলে কারও কাছে জিজ্ঞেসও করা হয় নাই। আজ যখন পরিচিত ভাইয়ের লেখায় শব্দটি পেলাম তখন সেখানে জানতে চেয়ে কমেন্ট করতেই আরেকজনের মাধ্যমে লেখাটার সন্ধান পেলাম এবং পড়লাম, জানলাম ও বুঝলাম।
রুপা নামের একটি মেয়ে তার স্ট্যাটাসে লিখেছে, ” পিরয়ড – বিরক্তিকর একটা জিনিস। একে তো করে ব্যথা, তার ওপর আবার নোংরা নোংরা ফিলিংস। উফফ — feeling irritated.”
লেখাটি বেশ কয়েকবার পড়লাম। না আমি এতে তেমন কিছু পেলাম না যে লেখাটির সমালোচনা করবো বা আলোচনা করবো। পিরিয়ড নারীদের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে লুকোছাপার তো কিছু নেই। শৈশব পার হয়ে কৈশোরে পদার্পন করার সাথে ছেলে মেয়ের উভয়েরই একটা পরিবর্তন ঘটে। মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয় আর ছেলেদের হয় বীর্যপাত প্রক্রিয়া। দুটোই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। বরং এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাই অস্বাভাবিক ও প্রকৃতি বিরোধী।
লেখাটিতে আমি কিছু না পেলেও যাদের পাওয়ার তারা ঠিকই পেয়েছে। প্রায় তিন শতাধিক মন্তব্য জমা পড়েছে মন্তব্যের ঘরে। শেষের কয়েকটা মন্তব্য পড়ে গা গুলিয়ে আসলো। মাত্রই দুপুরের লাঞ্চ সেরে রুমে আসছি। পেটের খাবারগুলো যাতে উগ্রে না আসে সেজন্য দ্রুত ওখান থেকে সরে আসলাম। এসে কয়েকটি লম্বা দম নিয়ে এ লিখা লিখতে বসলাম। ওখানে যারা কুৎসিত, নোংরা, জঘন্যতম ভাষায় মন্তব্যগুলো করেছে তারা সবাই নিজেদের পাক্কা মুমিন, ধার্মিক মনে করে। তাদের ধর্মের সাথে মেয়েটির শেয়ার করা নিরীহ ফিলিংসটা সাংঘর্ষিক বলেই তারা মেয়েটির ওপর হামলে পড়েছে। বাস্তব জীবনে সুযোগ পেলে, আমি নিশ্চিত, ওরা মেয়েটিকে ধর্ষণ করতো এবং পরে পাথর মেরে হত্যা করতো।
কেন এমনটি হলো? এক, প্রতিটা প্রচলিত ধর্মেই যৌনতাকে অন্যতম প্রধান ট্যাবু হিশেবে ধরা হয়। অথচ শুধু ইতিহাস নয়, প্রচলিত ধর্মগুলির ধর্মগ্রন্থগুলোই সাক্ষ্য তাদের ধর্মাবতারগণ কতটা যৌন বিকারগ্রস্ত ছিলেন। সে বিষয়ে অবশ্য তাদের টু শব্দটি নেই। নাম্বার দুই, পিরিয়ড নিয়ে একেকটি ধর্মে একেক ধরনের মিথ প্রচলিত আছে। তারমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মিথ হলো, অ্যাডামকে যখন ইভ নিষিদ্ধ গন্ধম খেতে প্ররোচিত করে এবং খাওয়ায় ইশ্বর তখন রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে গন্ধমের নিষিদ্ধ রসটাকেই ইভের পাপের স্মারকস্বরুপ তার শরীরে দেন যাতে বংশ পরম্পরায় এ পাপের কথা তারা স্মরণ রাখতে পারে। ফলে প্রায় ধর্মগ্রন্থে পিরিয়ডকে অপবিত্র শুধু তাই নয় পিরিয়ডের সময় নারীর পুরো শরীরটাকেই অপবিত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পিরিয়ডের সময় স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকার জন্য কুরআনে এরশাদ করা হয়েছে এবং কোনো এক জায়গায় পড়েছিলাম পিরিয়ডের সময় স্ত্রীকে আলাদা ঘরে এক প্রকার বন্দী করে রাখার কথা বলা হয়েছে হিন্দু ধর্মে। অপবিত্র, নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলায় জিহাদি জোসে মেয়েটির ওপর ভার্চুয়ালি হামলে পড়েছে বিভিন্ন ধর্মের মর্দে মোজাহিদরা।
তৃতীয় কারণটি হচ্ছে ধর্মীয় এবং সামাজিক। মানুষ আদিম যুগ থেকে ক্রমেই উৎপাদনের উৎকর্ষ এবং সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে ব্যক্তিগত সম্পদের উথান হওয়ায় নারীকেও তারা অপরাপর বস্তুগত সম্পত্তির মতো মনে গণ্য করে আসছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে এবং অন্যান্য বিধিবিধানের পাশাপাশি দুটো প্রক্রিয়ারই লক্ষ্য নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা, নারীর ভালোমন্দ ঠিক করে দেয়া, নারীর জন্য নানান বিধিনিষেধ তৈরি করা। নারী কি করবে, নারী কিভাবে চলবে, নারীর কি দরকার না দরকার সবই বলে দিবে ধর্মতন্ত্রের মুখোশের আরালে ওই পুরুষতন্ত্র। নারীর কথা নারী বলবে কেন? তার কথা ও প্রয়োজন মিটানোর জন্য কি ঘরে পুরুষ লোক নাই! ফলে যখনই কোনো নারী তার নিজের কথা বলেছেন বা বলবার চেষ্টা করেছেন তখনই তাকে থামাতে এগিয়ে এসেছে ধর্ম, সমাজ, পুরুষতন্ত্র। তাই তসলিমা নাসরীন যখন মনখুলে নিজের কথা বলে তখন তাঁর ওপর মৌলবাদী আক্রমণ হয়, তাঁকে দেশছাড়া হতে হয়। রোকেয়া যখন নারীমুক্তির কথা বলে তখন সে কাফের-মুরতাদ বলে ঘোষিত হয়। রুপারা যখন নিজেদের ভাল লাগা, খারাপ লাগা অবলীলায় প্রকাশ করে তখন তারা ভার্চুয়ালি ধর্ষিত হয়!
নারীকে শুধু ধর্ম ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজই প্রকোষ্ঠ বদ্ধ করে রাখে নাই। নারীরা নিজেরাই রাখছে। ধর্ম এবং প্রচলিত সমাজ তেমন অসংখ্য নারী তৈরি করে রেখেছে, প্রতিনিয়ত তৈরি করছে। তাই কোনো নারী বা পুরুষ নারীদের বিষয়ে কিছু লিখলে বা বললে প্রথমেই কিছু নারীরা এগিয়ে এসে বিরোধিতা করে। নারীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা হুমায়ুন আজাদের “নারী” বইটি পড়ে হুমায়ুন আজাদের এক কলিগ ফোন করে বলেন, নারী বইটি কি আপনি লিখেছেন। উত্তরে তিনি জানালেন হ্যাঁ। আপনি কাজটি ঠিক করেননি, কলিগটি আবার বললো। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন ঠিক হয়নি? উত্তরে ফোনের ওপাশ থেকে মহিলাটি বললেন, বিষয়টি অশ্লীল। একথা শুনে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, যতদিন না নারীদের নিজেদের কথা তারা নিজেরা না বলবে ততদিন তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। যাইহোক, রুপারা থেমোনা, তোমাদের কথা তোমরা বলে যাও। বাঁধের অচলায়তন ভেঙে মুক্তির গান গাও।
Leave a Reply