তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটা আবার পড়লাম। হ্যাঁ, আবার। অনেককাল আগের পড়ার স্মৃতি ঝাপসা ঝাপসা মনে ছিল। এতদিন, সত্যি বলতে, কবি নিতাই আমার মনে একজন ভিলেনের আসন গেঁড়েই বসে ছিল। এতকাল পরে আবার পড়ে খেয়াল করলাম সেই তখনকার দিনের সংস্কার–অন্যের স্ত্রীর প্রেমে পড়া, তাকে পাগল করে দেশান্তরিত হওয়া, পরে আবার এক দেহোপজীবিনী সাথে সম্পর্ক জড়ানো–পুরানো সংস্কার এসব মেনে নিতে পারে নি আগে।
আবার নতুন করে পড়ে, নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম কবিকে…প্রতিটা চরিত্রকে। সহজে আগেবী হওয়ার মানুষ আমি না। তবুও পড়তে পড়তে বুকের ভিতরটা কেমন যেন হুঁহুঁ করছিল। প্রেম-ভালোবাসার জায়গাগুলোতে চোখ ভিজে যাচ্ছিল, অস্বীকার করব না। তবে শেষ পর্বে নিতাইয়ের দেশে ফেরার পথে এসে সত্যিই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলছিলাম।
আমি ঘরকুনো টাইপের মানুষ। বাড়ির বাইরে কোথাও ভালো লাগত না। বাইরে কোথাও থেকে বাড়ি ফেরার পথে যে মনের অবস্থাটা হত, সেরকম একটা অবস্থা নিতাইয়েরও। এখন প্রবাসী বলে নিতাইয়ের বাড়ি ফেরার অনুভূতিটা আরো বেশী নাড়া দিচ্ছিল। এখনও যখন দেশে ফেরার কল্পনা করি–নিতাইয়ের মত মনে হইল–কেউ একজন “কৃষ্ণচূড়ার গাছতলায় পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ওই যে! —গ্রামের ধারের নদী ও নদীর ধারে চরভূমিতে তরির চাষ, বিস্তীর্ণ মাঠ, বৈশাখে মাঠের ধূলা, কালবৈশাখীর ঝড়, কালো মেঘ, ঘনঘোর অন্ধকার, সেই চোখ ধাঁধানে বিদ্যুৎ—সেই কড়্ কড়্ শব্দে মেঘের ডাক —ঝর্ ঝর্ বৃষ্টি—সব মনে হইল।”
তারপর ফিরতে ফিরতে পথে “ঝম্-ঝম্ শব্দে ট্রেন চলিয়াছে… দুপাশে কাশের ঝাড়, ঘন সবুজ। অজয়! অজয় নদী!”–এই পর্যন্ত এসে মনে হচ্ছিল আমি নিজেই বাড়ি ফিরছি। পড়ছি আর গুগল ম্যাপে এই রেলপথ… নদী… সব বের করে করে দেখছি। উইকিতে অজয় নদী সম্পর্কে পড়ছি–“১৩শ শতকের গীতগোবিন্দ লেখক কবি জয়দেবের কথিত জন্মস্থান বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্ব গ্রাম ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম অজয় নদীর পাড়ে।… অজয়ের ধারা শুরু থেকে অনেকদুর অবধি ল্যাটেরাইট মাটির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্ধমানের আশুগ্রামে এসে শেষ পর্যন্ত পাললিক অববাহিকায় প্রবেশ করে। অজয়ের উপত্যকায় শাল, পিয়াল ও পলাশের ঘন জঙ্গল ছিল। কিন্তু অধুনা খনিজ নিষ্কাষণ ও অন্যান্য মনুষ্যজনিত উপদ্রবে বেশীরভাগ জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে।”
এই জঙ্গল সাফের কথাটা পড়ে আবার মনে পড়ল–ছোটবেলায় যেসব গাছপালার সাথে বেড়ে উঠেছি, এখন আবার বাড়ী গেলে সেগুলোও আর দেখব না। গ্রামের লোকেরাও গাছপালা কেটে দালান উঠাচ্ছে। ফোন দিলে বলে যে আছে মোটামুটি, তবে দিন দিন গরম বাড়ছে…
সুন্দরবনের কথা মনে পড়ছিল। কার একটা লেখায় দেখলাম, কিছু বছর আগে রামপালও সুন্দরবনের মধ্যে ছিল। আর এখন সেই রামপাল থেকে সুন্দরবনের দুরত্ব কয়েক কিলোমিটার। জীবন সহজ করতে টেকনোলজির দরকার আছে, কিন্তু যারা এতদিনে টেকনোলজিতে অনেক এগিয়ে গেছে, তারাই এখন উলটা গাছপালাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশী। নিউইয়র্ক সিটির মত জায়গাতেও বছর কয়েক আগে কনক্রিটের ফুটপাত খুঁড়ে এক মিলিয়ন গাছ লাগানো হয়েছিল। এছাড়া কোথাও একটা গাছ কাটার প্রয়োজন হলে আশে-পাশে আরো কয়েকটি গাছ লাগানোর উপায় রেখে তারপর গাছ কাটে।
অনলাইনে লেখালেখি করে হয়তো সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না, তবুও ইতিহাস একদিন বলবে–কিছু বেকুব সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য রাস্তার নেমে আন্দোলন পর্যন্ত করেছিল…
Leave a Reply