সমকামিতাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে একসময় “মেণ্টাল ডিজঅর্ডার” হিসাবে গণ্য করা হত। দিন দিন চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি হয়েছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে সমকামিতা বিষয়েও হয়েছে বা হচ্ছে ব্যাপক গবেষণা। তাতে বের হয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। যার ফলে সমকামিতা বিষয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রও তার পূর্বের অবস্থান থেকে সঙ্গত কারণেই সরে এসেছে–এটাকে আর “মেণ্টাল ডিজঅর্ডার” হিসেবে দেখা হয় না।
বিজ্ঞান কাজ করে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে। সেখানে আবেগ বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্থান নেই। তাই নতুন একটা সত্যকে বিজ্ঞান যতটা সহজে গ্রহণ করতে পারে, আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। সময় লাগে মানিয়ে নিতে। এ বিষয়ে যথেষ্ঠ উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন বিজ্ঞান যখন ঘোষণা দিয়েছিল, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে–তখন মানুষ এটা মেনে নিতে পারে নি। তার প্রধান কারণ ছিল, এই বৈজ্ঞানিক সত্যটা ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। বিশ্বাসীরা মিথ্যাকে যত সহজে আপন করে নেয়, সত্যকে ততটাই ভয় পায়।
তেমনিই একটা নতুন সত্য হলো, সমকামিতা স্বাভাবিক একটা বিষয়। আবার স্বাভাবিক ভাবেই এই নতুন সত্যটা ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই বিশ্বাসীদের পক্ষে সমকামীদের মেনে নেয়ায় এই ধর্মই প্রধান বাধা। ধর্মের আরেকটা ব্যাপার হলো এটা নিজ মতামতের বাইরে আর কোনো মতামতকে গ্রহণ করতে অক্ষম। আর বিশ্বাসী তথা ধার্মিকরা নিজ সেক্টের বাইরে আর সবাইকে অবজ্ঞা, কখনও খতম করারও পক্ষে।
আমাদের নবীর কাছে একটা বন্ধ্যা মেয়েকে বিবাহের অনুমতি চাইলে তিনি সেটা অনুমোদন করেননি, কেননা এতে সন্তান হবে না। ওদিকে তিনি জনসংখ্যা দিয়ে আর সব মতামতকে পরাজিত করতে চেয়েছিলেন। একই ভাবে সমকামীরাও সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। নবীর অনুসারীদের খুব সম্ভবত এটাই প্রধান ভয়, যদি তাদের দলের লোকজন সংখ্যায় কমে যায়, তাহলে তাদের মত টিকবে কিভাবে! কিংবা যদি সবাই সমকামী হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ায় মানুষ টিকবে কিভাবে! অথচ তারা ভেবে দেখে না যে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা মিলিয়ে গলা ফাটিয়েও তারা সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরাতে পারছে না। কিংবা সবার সমকামী হয়ে যাওয়ার ভয়টাও অমূলক।
একটা সময় বাহাতিদেরও খারাপ চোখে দেখা হত। ব্যাপারটা হিংসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বাহাতিরা বেশিরভাগ সময় ডানহাতিদের চেয়ে বেশি দক্ষ হয়। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ডানহাতিদের এটাই ছিল মাথা ব্যথার কারণ। দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের অবজ্ঞা হিংসা ঘৃণা করাই সংখ্যাগরিষ্ঠদের একটা লক্ষন।
এবার ধর্ম প্রসঙ্গে আসি–ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার–চাপে পড়লে এটা আমরা সবাই স্বীকার করি। অর্থাৎ মনে মনে কে কি বিশ্বাস করল না করল তাতে অন্যের কিছু এসে যায় না। কিন্ত সমস্যাটা বাধে যখন এই বিশ্বাস কেউ অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে আসে, আর এই বিশ্বাসের জোরে অন্য কারো ক্ষতিসাধন করতে আসে। ধর্ম ঠিক তখনি সমালোচনা এবং বাধার সম্মুখীন হয়। বর্তমানে যে আস্তিক-নাস্তিক ক্যাচাল, তার কারণও শুধু এটাই।
ধর্মের মত সেএণ্ডক্স জিনিসটাও মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে কিভাবে কার সাথে কোন আসনে কতক্ষণ কী করবে না করবে, সেটা যার যার ব্যাপার। আমি সমকামী নই। পৃথিবীতে আমার মত মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে আমি ঠিক কোন যুক্তিতে সমকামিতার বিরুদ্ধাচরণ করব, বুঝে উঠতে পারি না।
একটা মেয়ে যদি এসে বলে আমাকে তার ভালো লাগে, আমার সোজা সাপটা উত্তর হবে–ওকে! আবার চোখা চোখি হলে একটা অর্থহীন হাসি দেব। তারপরও যদি সে বলে আমার সাথে প্রেম-ভালোবাসা-সেএণ্ডক্স করতে চায়, তাহলে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা ভদ্রভাবে বলে দিলেই হয়। উত্তর নেগেটিভ হলে সে যতক্ষণ না আমার উপর জোর করে ঝাপিয়ে পড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু ওটা করে ফেললে তখন আমাকে ব্যবস্থা নিতেই হবে। একই ভাবে একটা একটা সমকামী ছেলেও আমার প্রতি যদি ইন্টারেস্ট দেখায়, ব্যাপারটা ওই একই হবে। এখানে মেয়েটা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আমি গে। কিন্তু সেটা তার বোঝার কথা নয়। একই ভাবে ছেলেটাও জানার কথা নয় যে আমি গে নই। নিজেদের যখন সভ্য বলে দাবী করি, তখন সভ্য সমাজের দোহাই দিয়ে এইটুকু ভদ্র ব্যবহার আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না।
[এখানে উলটোটা যদি হয়, অর্থাৎ একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে তার ভালোলাগার কথা জানায়, জানাতেই পারে। কিন্তু ব্যাপারটা যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় তখন সেটা ‘ঈভ-টিজিং হয়ে যায়। এটা ছেলেদের মাথায় রাখা উচিত বলে মনে করি। কোনো সভ্য মানুষই একটা মেয়েকে তার শরীর সম্পর্কে বাজে ইঙ্গিত বা সেএণ্ডক্সের প্রস্তাব দেয় বলে জানা নেই।]
সবশেষে, সমকামিতা এবং সমকামীদের প্রতি আমার বিরূপ মনোভাব নেই। সমাজে নানান ধরনের মানুষ থাকে। থাকতেই পারে। যতক্ষণ কেউ বা কোনো রীতি-নীতি যদি না কারো ক্ষতি করছে, কারো অসুবিধার কারণ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছুতেই আমার আপত্তি নেই, সেটা হোক না কোনো ধর্ম বিশ্বাস, কিংবা কারো কোনো আচরণ।
এখন আপনি যদি সমকামিতাকে সাপোর্ট না করেন, সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করেন, নিশ্চয়ই আপনার কিছু যুক্তি আছে। শুনতে আগ্রহী।
বিশ্বাস হোক ব্যক্তিগত…ধর্ম হোক ব্যক্তিগত…মানবতা সার্বজনীন।
Leave a Reply