লিখেছেন আবুল কাশেম
উম হানি ও তাঁর মাতার ইসলাম গ্রহণ
মার্টিন লিঙ্গস্ মনে করেন, আবু তালেবের মৃত্যুর পর অথবা তার আগেই আবু তালেবের স্ত্রী ফাতেমা ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে এই ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ করেন। অনেকেই মনে করেন, আবু তালেবের স্ত্রী কখনই ইসলাম গ্রহণ করেননি। আর আমরা ওপরে একটা তিরমিজি হাদিসে দেখেছি যে, উম হানি ছিলেন একজন তুলাকা—যার অর্থ হচ্ছে যে উম হানি মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। মার্টিন লিঙ্গস ছিলেন একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম। তিনি ক্যাথলিক থেকে ইসলামে দীক্ষিত হন। তাঁর ইসলামী নাম হল আবু বকর সিরাজ আদ উদীন। মার্টিন লিঙ্গস্ যে ইসলামের গুণগান গাইবেন এবং মুহাম্মদকে উচ্চাসনে বসাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সে জন্য তাঁর লেখা মুহম্মদের জীবনী, যা তিনি দাবী করেন যে, সবচাইতে প্রাচীন উৎস থেকে নেয়া তথ্য থেকে লেখা, তা সমগ্র ইসলামী জগতে অত্যন্ত কদরের সাথে গ্রহণ করা হয়। এখন তাঁর বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেখা যাক (লিঙ্গস্ পৃঃ ১০১)।
আবু তালেবের বিধবা স্ত্রী ফাতেমা ইসলামে দীক্ষিত হলেন। এটা হয়েছিল আবু তালেবের মৃত্যুর আগেই অথবা পরে। তাঁর কন্যা উম হানি যিনি ছিলেন আলী এবং জাফরের ভগিনী সেই সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু উম হানির স্বামী হুবায়রা সর্বদায় একেশ্বরবাদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তা সত্যেও যখনই নবী তাঁর গৃহে আসতেন হুবায়রা নবীকে স্বাগতম জানাতেন। যদি তখন নামাযের সময় হত তখন গৃহের সব মুসলিমরা এক সাথে নামাজ পড়তেন।
ঐতিহাসিক তাবারি তাঁর ‘তারিখ আল তাবারি’ গ্রন্থে লিখেছেন (খণ্ড ৮, পৃঃ ১৮৬):
হুবায়রা বিন আবি ওহব এক অবিশ্বাসীই রয়ে গেলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন যে তার স্ত্রী উম হানি বিন্ত আবি তালেব (যার নিজস্ব নাম ছিল হিন্দ) মুসলিম হয়ে গেছেন তখন তিনি বললেন:
হিন্দ কি তোমাকে আর আকাঙ্ক্ষা করে? অথবা সে কি তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে? এই-ই দূরে থাকা—তার বন্ধন, (তারপর) তার চলে যাওয়া।
পূর্বেই ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতিতেও এই প্রসঙ্গে হুবায়রার একটি কবিতা দেওয়া হয়েছে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, তাবারি এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের সময়। অর্থাৎ মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পরই উম হানি ইসলাম গ্রহণ করেন—কিন্তু তাঁর স্বামী হুবায়রা ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং চিরজীবন অমুসলিম থেকে যান। উম হানির ইসলাম গ্রহণে হুবায়রা অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন এবং উম হানিকে ছেড়ে নির্বাসনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রিত মক্কায় মুসলিম অমুসলিম দম্পতির একত্রে বসবাস নিষিদ্ধ ছিল। আগেই লিখা হয়েছে যে, মুহাম্মদ হুবায়রাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। কাজেই মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রিত মক্কায় পৌত্তলিক হুবায়রার ভাগ্যে কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
দেখা যায়, তাবারি এবং ইবনে ইসহাক একই কথা লিখেছেন—উম হানি ইসলাম গ্রহণ করেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর, তার আগে নয়। মার্টিন লিঙ্গস কতটুকু সত্য লিখেছেন, তা ভাবার বিষয়।
তবে এই বিভ্রান্তির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এইভাবে: এমন হয়ত হয়েছিল যে, উম হানি মুহাম্মদকে খুশি করার জন্য গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হুবায়রাকে বিবাহের পর উম হানি ইসলাম ত্যাগ করে পৌত্তলিকতায় ফিরে গেলেন। আর মুহাম্মদ বিবাহ করেন খাদিজাকে। আল্লাহ যখন মুহাম্মদকে নবী বানালেন, তখন হয়ত মুহাম্মদ যখন কাবায় আসতেন, তখন উম হানির সাথে কিছু সময় কাটাতেন। আমরা আগেই দেখেছি যে, উম হানির গৃহ এবং কাবা একেবারে পাশাপাশি ছিল। নবীও তখন পরকীয়া প্রেম চালাতেন আর তাতে উম হানিরও সায় ছিল। তাই উম হানি তখন নবীর অবস্থানে এক গোপন মুসলিম হিসাবে থাকতে চাইতেন।
যাই হোক, এই সবই অনুমান। এই সব ঘটনার ইসলামি উৎস এতই বিপরীত তথ্য, তালগোল পাকানো এবং বিশৃঙ্খল যে, সত্য বের করা দুরূহ।
এতদসত্ত্বেও এটা পরিষ্কার যে নবী মুহাম্মদ উম হানিকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন—যদিও তার জন্য দরকার ছিল পরকীয়া প্রেমের। মনে হয়, নবী উম হানিকে (হিন্দ) যে পরিমাণে ভালবাসতেন, সেই পরিমাণে অন্য কোনো নারীকেই সেই ভাবে ভালবাসেননি—এমনকি তাঁর অগুনতি স্ত্রী ও উপপত্নীদের কাউকেও না।
(চলবে)
Leave a Reply