ঋগ্বেদের ৬ষ্ঠ মণ্ডলের ১৬ নং সুক্তের ১৩ নং ঋক–
“হে অগ্নি ! অথর্বা ঋষি শিরোবৎ বিশ্বের ধারণকারী পুষ্কর হইতে মন্থন করিয়া তোমাকে নিঃসারিত করিয়াছেন।”–রমেশচন্দ্র দত্তর অনুবাদ।
এই অথর্বা ঋষি হলেন সেই দধীচি ঋষির পিতা যে দধীচির অস্থি দিয়ে ‘বজ্র’ বানিয়ে ইন্দ্র বৃত্রাসুর নামক অসুরকে বধ করেছিলেন বলে হিন্দুধর্মে কথিত গল্প আছে। এই গল্পটা যে একেবারেই রূপকথা বা তিলকে তালা বানানো, তা পরের ১৪ নং ঋকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। আসলে কী হয়েছিল, সেটা এই ১৪ নং ঋকে উল্লেখ আছে স্পষ্ট ভাবে–“অথর্বার পুত্র দধীচি তোমাকে প্ৰজ্জ্বলিত করিয়াছেন। তুমি বৃত্ৰহন্তা ও পুরচিনাশক।”
১৪ নং ঋকে যাওয়ার আগে ১৩ নং ঋকটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। রমেশচন্দ্র নিজেই এই ঋক নিয়ে একটু ‘ফুটনোট’ দিয়ে রেখেছেন–“অথর্বা পুষ্কর হইতে অগ্নিকে মন্থন করিয়া উৎপন্ন করিয়াছিলেন, ইহার অর্থ কি? সায়ণ প্রজাপতিদ্বারা পদ্মপত্রের উপর জগতের সৃষ্টির পৌরাণিক কথা অবলম্বন করিয়া পুষ্কর অর্থে এখানে পদ্ম করিয়াছেন। সামবেদের টীকাকার মহীধর পুষ্কর অর্থে জল এবং অথর্বা অর্থে বায়ু করিয়া একটি অর্থ করিয়াছেন। ফরাসী পণ্ডিত লাংলোয়া পুষ্কর অর্থে করিয়াছেন অরণি কাষ্ঠের ছিদ্র যাহা হইতে অগ্নি উৎপন্ন হয়।”–পৌরাণিক রূপকথা সরিয়ে রাখলে লাংলোয়ার ব্যাখ্যাটাই বেশী বাস্তব বলে মনে হয়।
আগুন আবিষ্কারকে বলা হয় সভ্যতা-বিজ্ঞানের অন্যতম প্রথম ও সেরা আবিষ্কার। আর কাঠের ছিদ্রে আরেক খণ্ড কাঠ ঢুকিয়ে দুহাতে ঘষে আগুন জ্বালানোর সেই প্রথমদিকের কাহিনী কে না জানে! ভারতের আর্যরা বৈদিক যুগে সবে সেটা শিখেছিল। আর আর্যদের মধ্যে এই পদ্ধতিটার আবিষ্কারক খুব সম্ভবত দধীচির পিতা অথর্বা ঋষি। ফরাসী পণ্ডিত লাংলোয়ার ১৩ নং ঋকের ব্যাখ্যাটা সেটাই স্পষ্ট করে তোলে।
বেদের, বিশেষ করে ঋগ্বেবের, প্রথম দিকের অধিকাংশ অংশ জুড়ে আছে অগ্নি দেবতা। অধিকাংশ শ্লোক অগ্নিকে উদ্দেশ্যে করে রচিত হয়েছে। অন্যান্য সভ্যতার মত বৈদিক সভ্যতার প্রথম দিকে আগুনের গুরুত্ব যে কতখানি ছিল, সেটা এ থেকেই অনুমান করা যায়। ১৯ নাম্বার ঋকে আছে–“আমরা হব্যবাহক, দিবোদাসের শত্রুনিধনকারী, সৰ্ব্বজ্ঞ ও সাধুরক্ষক অগ্নিকে এস্থানে আনয়ন করিয়াছি।” সাধুরক্ষক অগ্নি…আগুন দিয়ে শত্রুকে পুড়িয়ে মারা কিংবা রাতে আগুন জ্বালিয়ে রেখে বন্য জন্তু-জানোয়ার থেকে রক্ষা পাওয়া–সে কথারই কি ইঙ্গিত দেয় না এই ঋক?
রমেশচন্দ্র আরেকটি কথা উল্লেখ করেছেন–“যে সমস্ত ঋষিগণ প্রথমে আর্য্যাবর্ত্তে অগ্নির যজ্ঞ বিশেষরূপে প্রচার করেন, অথর্বা ও তৎপুত্র দধীচি ও তাহাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন।” আগেই দেখলাম যে আর্যদের মধ্যে আগুন উৎপন্ন করার পদ্ধতিটা অথর্বার আবিষ্কার। শুধু এখানেই হয়তো অথর্বা থেমে থাকেন নাই, এই টেকনলজি আরো কী কী কাজে লাগিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়া যায়, সেটা নিয়েও হয়তো অথর্বা ভেবেছিলেন বা গবেষণা করেছিলেন। আর সেসব কাজে তার সহযোগী ছিলেন নিজ পুত্র দধীচি। পিতার কাছ থেকে শিখে দধীচি হয়তো আরো এগিয়ে নিয়েছিলেন এই গবেষণা। তারপর বৃত্রাসুরদের সাথে যুদ্ধের সময় ইন্দ্রকে সাহায্য করতে গিয়ে হয়তো অসাবধানতাবশতঃ নিজেই আগুনে পুড়ে বা আগুনজনিত কোনো দুর্ঘটনায় নিজেই মারা যান। আর তার এই অবদানটাই ১৪ নং ঋকে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে–“অথর্বার পুত্র দধীচি তোমাকে প্ৰজ্জ্বলিত করিয়াছেন। তুমি বৃত্ৰহন্তা ও পুরচিনাশক।” পরের অর্থাৎ ১৫ নং শ্লোকে আবার ঋষি পাথ্যর কথা উল্লেখ করা–“হে বর্ষণকারী অগ্নি ! তুমি দস্যুহন্তা ও প্রতিযুদ্ধে ধনবিজয়ী, ঋষি পাথ্য তোমাকে উদ্দীপিত করিয়াছিলেন।” খুব সম্ভবত দধীচি মারা গেলে এই আগুন নিয়ে গবেষণা বা আগুন জ্বালানোর ভার এসে পড়ে এই পাথ্য ঋষির উপর।
Leave a Reply