বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, গালাগালিরও একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে–যে দেয় বা যাকে দেয়া হয়, যে শোনে–উভয়দিকেই একটা প্রতিক্রিয়া হয়। যে গালি দেয়, বেশিরভাগই মা-বোন তুলে চ বর্গীয় গালি, সে-ও এক সময় হাত মেরে নিস্তেজ হয়ে যায়। আর যে শোনে, মন-মানসিকতা শক্ত না হলে, লজ্জায়-ঘৃণায়-অপমানে নীল হয়ে যায়, বাস্তবে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে, আর ফেসবুকে অনেকে গালি খেয়ে আইডি অফ করে দেয়।
গালির পরে আরেকটা জিনিস আছে–হুমকি। বিশেষ করে মৃত্যুর হুমকি। ইনবক্সে এ ধরনের মেসেজ আসলে কমবেশি সবার মনে প্রথমে একটা ধাক্কা লাগবেই। মনে আছে ফারামি যখন একের পর এক নাস্তিক কোতলের হুমকি দিত, তখন একজন পরামর্শ দিছিলেন যে পালটা হুমকি দিতে। ফান করে দিয়েও ছিলাম। প্রতিক্রিয়া সাথে সাথে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম, যখন এ ধরনের হুমকির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, তখনই অনেক ছাগু আমার সেই পোস্টের স্নাপশট পোস্ট করা শুরু করত; মানে তাদের সেটা খুব লেগেছিল, মনে রাখছে। অর্থাৎ এ ধরনের কাজে একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার ঘটে–অনেকেই ভয় পায়, হার্ডলাইনে লেখা বন্ধ করে দেয়, ধর্ম নিয়ে লেখা বন্ধ করে দেয়, ধর্ম নিয়ে পুরাতন লেখাগুলো অনলি মি করে দেয়, ব্লগের লেখা হাইড করে দেয়, অনেকে লেখালেখি, এমনকি আইডি পর্যন্ত অফ করে দেয়।
নিজে আইডি অফ না করলেও প্রথম দিকে কেমনে যেন চুপচাপ হয়ে যেতাম। এমনকি যাদেরকে আপন বা সমমনা মনে করতাম, তাদের কিছু বিরূপ মন্তব্যতেও থমকে যেতাম, লেখালেখিতে উৎসাহ পেতাম না। অনেকদিন হয়ে ওসব আর কেয়ার করি না। নিঃসন্দেহে এই সাহস ফিরে পাওয়ার মূল প্রেরণা ছিলেন তসলিমা নাসরিন। তারপর উনি যখন টুইটারের পাশাপাশি বাংলায় ফেসবুকে আমাদের সাথে যোগ দিলেন, তখন সাহস আরো বেড়ে যায়। অনেকেই হয়তো নীরবে ব্লগারদের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু যেখানে অন্যান্য সব স্বীকৃত লেখক-কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা কেউই যেখানে মৃত্যু ভয়ে বা জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে ব্লগার হত্যা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ করছেন না, উলটা ইনিয়ে বিনিয়ে ব্লগারদের লেখালেখিকে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন সেখানে একমাত্র উনাকেই দেখা যাচ্ছে সরব হতে–লেখেলেখি এবং লেকচার–সবখানেই ব্লগারদের পক্ষ হয়ে বলে যাচ্ছেন। যদিও অনেকে এখানেও মস্করা করছেন যে ব্লগার হত্যা হলেই উনি লেখার রসদ পান!
একটা মানুষ দুইযুগের বেশি সময় ধরে সারাক্ষণ মৃত্যু-হুমকি মাথায় নিয়ে, প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, কখনো কারো কাছে মাথা নত করেন নাই, কখনো লেখালেখি থামান নাই। অনেকে বলতে পারেন যে উনার তো নিরাপত্তা রক্ষী আছে। কিন্তু ঘরে-বাইরে সবখানে সারাক্ষণ নিরাপত্তা রক্ষী বেষ্টিত হয়ে থাকাটা বাইরে থেকে উপভোগ্য মনে হতেই পারে, কিন্তু আমরা ভুলে যাই এই বাড়তি নিরাপত্তাটাই সারাক্ষণ যে কোনো সময় আক্রমন ও মৃত্যুর কথাটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া। যারা দেশে থাকতে বাইরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জঙ্গিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, বা এখনো যারা ভয় পাচ্ছেন, তারা হয়তো কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছেন এই মৃত্যু-ভয় আসলে কী জিনিস।
প্রিয় রুদ্র বলে গেছেন–সবচেয়ে সুন্দর আমাদের এই বেঁচে থাকা… তসলিমা নাসরিনের লেখালেখি বা লাইফস্টাইল নিয়ে সবার ভিন্নমতকে সম্মান করলেও উনার এবং ব্লগারদের নিরাপত্তার দিকটা এবং পালটা ফাইট দিয়ে বেঁচে থাকাটা নিয়ে কেউ যখন স্থূল রসিকতা করেন তখন বিষয়টা এত দৃষ্টিকটু লাগে যে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
Leave a Reply