হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সামবেদীয়/যজুর্বেদীয়/ঋগবেদীয় দশসংস্কার, নিত্যকর্ম, মাসিক ও বার্ষিক কৃত্য এবং অশৌচ। এই বেদীয় দশসংস্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো–গর্ভাধান, পুংসবন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ ইত্যাদি। মুসলমানরা যে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার দাবী করে, তা মূলত হিন্দুধর্মের এইসমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে পাওয়া যায়। একজন হিন্দুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা যা করণীয়, তা সবই এই “ধর্মানুষ্ঠানের” মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং একটা সময়ে এসবই প্রচলিত ছিল এবং সামর্থ অনুযায়ী সবাই এসব পালন করত।
কয়েকদিন আগে “পঞ্চগব্য” নিয়ে একটা পোস্ট দেয়াতে হিন্দুরা বেশ ক্ষেপেছিল। পঞ্চগব্য হলো দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, গোমূত্র ও গোময়-এই পাঁচটি দ্রব্য বা এর মিশ্রণ। পোস্টে বলা হয়েছিল এটা পঞ্চগব্য একটা পরিমিত মাত্রায় মিশ্রিত করে মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানেই সবার আপত্তি দেখা গিয়েছিল। গোমূত্র এবং গোবর যে কেউ খেতে পারে–এই যুগের অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারছেন না। অথচ খবর নিলে জানা যাবে (আগেও ছিল) এখনো হিন্দুসমাজের কোথাও কোথাও প্রায়শ্চিত্ত বা শাস্তি হিসেবে পঞ্চগব্য পানের বিধান প্রচলিত আছে।
যাক সে কথা। সবাই জানতে চেয়েছিলেন আমাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ আছে কিনা। তখন উইকি থেকে দেখিয়েছিলাম প্রসাদ হিসেবে পঞ্চগব্য ব্যবহারের কথা। অনেকেই মানেননি। আজ আরেকটু বিস্তারিত দেখা যাক–
সামবেদীয়/যজুর্বেদীয়/ঋগবেদীয় দশসংস্কারের প্রথমেই আসে “গর্ভাধান”। সুনীল-সমরেশের অনেক বইতে পাবেন মন্ত্রজপ করতে করতে সঙ্গমের কথা। তবে এককালে সঙ্গম করা হত শুধু বাচ্চা পয়দা করার জন্য। ঋগবেদীয় গর্ভাধানে তুলনামূলকভাবে মন্ত্র বেশি এবং অনেক ভেষজের ব্যবহারের উল্লেখ আছে। সামবেদীয় গভাধানের নিয়মেও আগে অনেক মন্ত্রপাঠের কথা আছে–শেষের দিকে “পতি বধুর নাভিপদ্ম স্পর্শ পূর্ব্বক “ওঁ দীর্ঘায়ুষং বংশধরং পুত্রং জনয় সুব্রতে” অর্থাৎ হে সুব্রতে! তুমি দীর্ঘায়ু ও বংশধর পুত্র প্রসব কর, এই মন্ত্র পাঠ করিতে হয়।” তারপর মন্ত্র পাঠ করে পঞ্চগব্য সংশোধিত করে কোনো পতিপুত্রবতী নারীকে দিয়ে সেটা নিজের স্ত্রীকে পূর্বদিকে মুখ করে পান করাতে হয়। তারপর সঙ্গম…
আর যজুর্বেদীয় গর্ভাধানে “যথোক্ত দিনে পূর্ব্বাহ্নে কৃতনিত্যক্রিয়া হইয়া বিবাহপদ্ধ্যত্যুক্ত নিয়মে গৌর্য্যাদি ষোড়শমাতৃকার পূজা করত স্বীয় দক্ষিণে পত্নীকে বসাইয়া তাহার দক্ষিণস্কোন্ধোপরি দিয়া হস্ত দ্বারা হৃদয় স্পর্শ পূর্ব্বক “ওঁ পূষা ভগং তে সবিতা” ইত্যাদি মূলের লিখিত মন্ত্র জপ করিবে। ঐরূপে যথানিয়মে পঞ্চগব্য পান করাইয়া পরে নিষেক করিতে হয়।”
এছাড়া হিন্দু বিয়েতে আগে শুদ্ধ হয়ে নিতে গরুর চোনা খাওয়ানোর বিষয়টা নিয়েও কানাঘুষা শোনা যায়। সেটাও মূলত দুধ জাতীয় একটা জিনিসের মিশ্রনের মাধ্যমে। খুব সম্ভবত সেটাও পঞ্চগব্য। বড়দের জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু সঠিক ভাবে হ্যাঁ-না কিছুই বলে না।
=====================
“ধর্মানুষ্ঠান” – ভূধর চট্টোপাধ্যায়। কালিকা প্রেস, কলিকাতা, ১৮৯৫।


Leave a Reply