ইসলাম এবং কম্যুনিজম। অনেকেই এই দুটিকে একটার সাথে আরেকটার তুলনা করেন। এরকম তুলনামূলক কিছু লেখার শিরোনাম দেখেছি, ভিতরটা ভালো করে পড়ে দেখার সুযোগ হয়নি। তাই বুঝতে পারছি না, তুলনাটা কি ‘ভালো‘ অর্থে করে, নাকি ইসলামের সাথে কম্যুনিজমের তুলনা করে কম্যুনিজমকে বাঁশ দেয়, নাকি কম্যুনিজমের সাথে তুলনা করে ইসলামকে বাঁশ দেয়।
অনেকের কাছে আবার কম্যুনিজম শব্দটাই নেতিবাচক। অনেকের কাছে কেমন যেন রুক্ষ প্রকৃতির মনে হয়, আবার অনেকের কাছে ভীতিজনক। এর বাংলা হলো সাম্যবাদ। সাম্যবাদ বললে বিষয়টা বুঝতে সহজ হয়; আবার অনেকের আগ্রহ জন্মে বিষয়টি জানার জন্য। এর পেছনে অবশ্য, মনে করি, নজরুলের অবদান আছে—‘গাহি সাম্যের গান– মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। নাই দেশ–কাল–পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে–ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম মানে হলো ‘শ্রেণীহীন, শোষণহীন, ব্যক্তি মালিকানাহীন এমন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার স্থলে উৎপাদনের সকল মাধ্যম এবং প্রাকৃতিক সম্পদ (ভূমি, খনি, কারখানা) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে’ (উইকি থেকে)। ফেসবুকে কিছু মজার মিমি দেখছিলাম—দুটি গরু দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ ব্যাখ্যা করছে। তাতে কম্যুনিজম নিয়ে বলছে— ‘আপনার দুটি গরু আছে। রাষ্ট্র গরু দুটি নিয়ে গেল, এবং আপনাকে কিছু দুধ দিল।’ বাকি দুধ, যাদের গরু নেই, তাদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেবে রাষ্ট্র। এই হলো, সহজ কথায়,—সাম্যবাদ; ‘যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা–ব্যবধান।’
চিন্তা করুন, এমন একটা সমাজ, যেখানে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ছোট-বড় নেই। সবাই সমান। কেউ কাউকে হিংসা করছে না, কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই, কেউ কারো ক্ষতি করছে না, সবাই সমান ভাবে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে—ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! যারা এই আইডিয়ার কথা আধুনিক কালে বলেছেন, তারা দেখিয়েছেন যে, অতীতে মানুষ স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ ভাগ হয়ে এভাবেই বসবাস করত। তাদের সমাজেও কোনো ছোটবড় ছিল না। সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকত। তো অতীতের সেই মানুষগুলো, যাদেরকে আমরা আদিম মানুষ বলি, তারা যদি এভাবে বসবাস করতে পারে, তাহলে আমরা আধুনিক মানুষ হয়ে, শিক্ষাদীক্ষায় তাদের থেকে অনেক উন্নত হয়েও কেন সব বিভেদ-হানাহানি ভুলে একত্রে বাস করতে পারব না!
সবাই মিলে মিলেমিশে থাকার এরকম একটা চিন্তাভাবনা অনেক মহৎ একটা বিষয়—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। ধর্মীয় ভুজং-ভাজুং জিনিসটাকে সরিয়ে রাখলে ইসলামে মুহাম্মদের প্রথম দিকের চিন্তাভাবনাও খুব সম্ভবত এরকমই ছিল। তিনি যে সমাজে বড় হয়েছিলেন, সেখানে তিনি দেখে আসছিলেন যে, বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন মতবিরোধের জের ধরে গোত্রে গোত্রে নিত্য হানাহানি লেগেই থাকত। তিনি এই হানাহানি বাদ দিয়ে হয়তো সবাইকে একটি সূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন। যদিও সাম্যবাদের কোথাও মানুষ হত্যার বিধান থাকার কথা না, কিন্তু কম্যুনিজমকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে একটা শ্রেণী ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করেছেন, তেমনি মুহাম্মদ নিজেই প্রায় শ’খানেক যুদ্ধ করেছেন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই যুদ্ধ আজও থামেনি, আজও ইসলাম সম্পূর্নরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। কম্যুনিজমেরো বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়নি সর্বত্র। কোনো মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি বিন্দুমাত্র রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোথাও বিরাট গণ্ডোগোল আছে।
গণ্ডোগোল আছে ইসলামের একটি হিসাবেও—ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো যাকাত—‘প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর–নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরীব–দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়’ (উইকি)। এই হিসাবে ধনীরা গরীবদেরকে যাতাক দিতেই থাকবে। এক পর্যায়ে দুনিয়ায় আর গরীব থাকবে না। তখন কী হবে? যাকাত জিনিসটার প্রয়োজন ফুরাবে। ইসলামের একটা স্তম্ভ ধসে যাবে। এটা কি মুসলমানরা মেনে নিবে? আবার ইসলামে মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ আছে, অমুসলিমরা ইসলামের পথে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। অমুসলিম তো বটেই, অনেক মুসলমানও এটা মেনে নিবে না।
মেনে না নিলেই সংঘাত। সংঘাত থেকে হানাহানি–রক্তারক্তি। আগেই বলেছি, মতবাদ প্রতিষ্ঠায় রক্তারক্তি হলে মতবাদের কোথাও ভুল আছে। কম্যুনিজম আর ইসলামের সেই ভুলটা কী? ভুলটা হলো, দুইটা মতবাদই অবাস্তব!
সবাই সমান খাবে, সমান পরবে, সমান এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বে—এসব কল্পনাতেই ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু শুধু মসজিদে এসে এক কাতারে নামাজ পড়লেই তো আর ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। কে কী রকম পোশাক পরে, কে কী খেয়ে, কে কোন বিছানায় শুয়ে, কে কোন ঘরে বাস করে নামাজে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাও তো দেখতে হবে। বাস্তবে ওসবে মিলবে না। কে কী পোশাক পরবে, কে কী খাবে, কে কী রকম বিছানায় ঘুমাবে—এসব সাম্যবাদী রাষ্ট্র বা ইসলাম—কেউই ঠিক করে দিতে পারবে না। জোর করে চাপাতে এলেই সংঘাত বাধবে। তাই কম্যুনিজম আর ইসলাম—দুইটি বিষয়ই অবাস্তব এবং অসম্ভব।
দুনিয়ায় সবকিছু প্রতিনিয়ত একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই বিবর্তন সব খানে এক ভাবে হচ্ছে না। তাই স্থান কাল পাত্র ভেদে মানুষের রুচি, খাদ্য, পোশাক, চিন্তা, চেতনা, মতামত, মন–মানসিকতা একেকরকম হতে বাধ্য। আর এইযে বৈচিত্রময়তা, এটাই সৌন্দর্যের ভিত্তি, প্রকৃতির নিয়ম—এটাই বাস্তবতা। কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ দিয়ে এই বিবর্তনকে বাধা দেয়া বা বেঁধে রাখা অসম্ভব।
একটু চিন্তা করার সামর্থ আছে বলে চেষ্টা করি মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে, বৈচিত্রময়তাকে সম্মান করতে, অন্যের স্বাধীনতাকে, স্বাধীন মতবাদ, চিন্তা–চেতনাকে সমর্থন করতে…। শুধু সমর্থন করি না অন্যের ক্ষতি করাকে…। নাস্তিকদের সর্বোচ্চ মতপ্রকাশ করার অধিকারকে যেমন সমর্থন করি, তেমনি সমর্থন করি আস্তিকদের ধর্ম পালন করাকেও। কিন্তু মত প্রকাশের নামে যদি কেউ কারো ক্ষতি করার উস্কানি দেয়, বা ধর্ম পালনের নামে যদি কেউ কারো ক্ষতি করতে চাপাতি হাতে নেয়—এটা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।
Leave a Reply