লিখেছেন নিলয় নীল
পুরুষতন্ত্রের নিকট নারীর দুর্নামের ক্ষেত্রে মাতাকেও ছাড় দেয়নি বৌদ্ধধর্মীয় শাস্ত্র। আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করবো ৬১ নম্বর জাতক, যাকে অশাতমন্ত্র জাতক বলা হয়। এই জাতকের বর্তমান বস্তুতে বলা হয়, গৃহকর্মে উৎসাহী ব্রাহ্মণ যুবককে তার পিতামাতা পুনর্বার গুরুর নিকট পাঠায় নারীচরিত্রের দোষ অনুধাবন করে সংসার-বৈরাগ্য লাভের উদ্দেশে। মাতাপিতার পরামর্শে সে গুরুর নিকট অশাতমন্ত্র দীক্ষায় প্রত্যাশী হয়। অশাতমন্ত্র বলতে সহজ ভাবে বোঝানো হয় অমঙ্গল বিষয়ে সচেতনতার বিদ্যা, আর নারীরাই হল এই বিদ্যার কেন্দ্র অর্থাৎ অমঙ্গলের মূল।
গুরুর বৃদ্ধ মাতা জীবিত ছিল এবং গুরুই তার সেবা করতো। এজন্য লোকে গুরুকে ঘৃণা করতো কিন্তু মাতৃসেবা কেন ঘৃণ্য বিষয় হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা জাতকটিতে নেই। ব্রাহ্মণপুত্রকে গুরু তার মাতার সেবায় নিয়োগ করলেন। ব্রাহ্মণপুত্র সেবা করতে করতে গুরু মাতার প্রশংসা করতো এই ভাবেঃ “জরাগ্রস্ত হইয়াও আপনার কি অপরূপ দেহকান্তি, না জানি যৌবনকালে আপনি কীদৃীশি রুপলাবণ্যসম্পন্না ছিলেন।” এভাবে কিছুদিন রুপকীর্তন করার ফলে বৃদ্ধার মনে হল ব্রাহ্মণপুত্র প্রণয়প্রত্যাশী।
বৃদ্ধ মাতা ব্রাহ্মণপুত্রকে প্রণয়ে উৎসাহিত করলে ব্রাহ্মণপুত্র তার গুরুভীতির কথা জানান। বৃদ্ধা মাতা তখন তার পুত্র অর্থাৎ গুরুকে হত্যা করার জন্য বলে ব্রাহ্মণপুত্রকে উৎসাহিত করেন। কিন্তু তাতে ব্রাহ্মণপুত্র স্বীকৃত না হওয়ায় নিজেই কৌশলে নিজ পুত্রকে হত্যা করতে আগ্রহী হয়। জাতকের ভাষায় – “ স্ত্রীজাতি এমনি অসতী ও নীচাশয়া যে এতো অধিক বয়স্কা বৃদ্ধাও কামভাবের বশবর্তী হইয়া বোধিসত্তের ন্যায় ভক্তিশীল ও শুশ্রষাপরায়ণ পুত্রের প্রাণসংহারের জন্য প্রস্তুত হইলো।”
কিন্তু ব্রাহ্মণপুত্র তার গুরুকে তার মায়ের সব কিছু বলে দেয়। ব্রাহ্মণপুত্রের প্রণয় না পেয়েই লজ্জায় অপমানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় বৃদ্ধা মাতা। বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে গুরু তার বিদ্যার্থীকে জানায়ঃ “বৎস স্ত্রীজাতি মানেই অসতী এবং ইহাই অসতমন্ত্রের সারকথা। তোমার পরিবার আমার কাছে পাঠিয়েছে ইহার কারণ এই যে তুমি স্ত্রীজাতির দোষ জানিতে পারিবে। আমার মাতার চরিত্রে কি দোষ ছিল তাহা তুমি স্বচক্ষে দেখিতে পারিলে। ইহা হইতেই বুঝিতে পারিবে রমণীরা কীদৃীশি অসতী হতে পারে। এরপর বিদ্যার্থী ব্রাহ্মণ পুত্র নারী বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পর সংসারে ফিরে না গিয়ে প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) গ্রহণ করে। গুরু দ্বারা অশতমন্ত্র প্রাপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণ পুত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে নীতিগাথা:
নারীর চরিত্র হায়, কে বুঝিতে পারে?
অসতী প্রগলভা বলি জানি সবাকারে।
কামিনী কামাগ্নি তাপে জবে দগ্ধো হয়
উচ্চে নীচে সমভাবে বিতরে প্রণয়।
খাবার প্রস্তুতে বিচার নাই আগুনের ঠাই
নারী প্রেমে পাত্রাপাত্র ভেদ জ্ঞান নাই।
অতএব ত্যাজি হেন জঘন্য সংসার
সন্ন্যাসী হইবো এই সংকল্প আমার।
(চলবে)
Leave a Reply