মৎস্য পুরাণ ও ভগবত পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের সূত্র দিয়ে নিম্নোক্ত কথাগুলো অনলাইনে প্রচারিত হয়ে আসছে কিছুদিন ধরে-
//ব্রহ্মার কন্যা স্বরস্বতী হলেন বিদ্যার দেবী। স্বরস্বতীর রূপ দেখে তার বাবা ব্রহ্মা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। পিতার কামোদ্দীপনা থেকে বাঁচার জন্য স্বরস্বতী ভূমির চারিদিকে পালিয়ে বেড়ালেন,কিন্তু বাবার হাতে ধরা পড়লেন। স্বরস্বতী তার বাবা ব্রহ্মার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। অতঃপর ব্রহ্মা এবং তার কন্যা স্বরস্বতী স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় ১০০ বছর সহবাস করলেন। তারা স্বয়ংভূমারু নামে এক পুত্র এবং শতরূপা নামে এক কন্যার জন্ম দেন। অতঃপর তারাও দুজন দুজনের সাথে সহবাস করে এবং তাদের মিলনের ফলে ব্রহ্মা দুজন দৌহিত্র ও দুজন দৌহিত্রা লাভ করেন।//
সূত্র: মৎস্য পুরাণ ৩:৩২ । ভগবত পুরাণ ৩:১২-২৮
স্বয়ংভূমারু বানানে ভুল। এটা আসলে স্বয়ম্ভুব মনু, যারে ব্রহ্মা তার ডান হাত হতে এবং শতরূপাকে বাম হাত থেকে সৃষ্টি করেন। মনু আর শতরূপা ভাই-বোন। এদের মধ্যে বিয়ে হয় এবং তাদের ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে হয়। ভাগবত পুরাণে এমনই বলা আছে।
আসেন ভাগবত পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়টা আরেকটু বিস্তারিত দেখি-
শিব নারদকে বলতেছেন,
“…যিনি যাবতীয় জগতের প্রসবকত্রী, এবং সংসারের সারভূতা, সনাতনী, অতিশয় সূক্ষ্মা, মূল প্রকৃতি; তিনিই সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম; আমাদের উপাস্য; ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং আমি, যাঁহা হইতে উৎপন্ন হইয়া এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় নির্ব্বাহ করিতেছি। এই প্রকারে সেই মূল প্রকৃতি পরমেশ্বরী কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়, ইচ্ছা মাত্রেই ক্ষণে ক্ষণে সম্পন্ন করিতেছেন। সেই মহাদেবী, অরূপা হইয়াও, নিজ লীলাক্রমে তিনিই প্রসব করেন; এবং পালন করেন। তাঁহার মায়াতেই সকল সংসারসমুদ্রে বিমুগ্ধ হইয়া থাকে। অন্তকাল উপস্থিত হইলে আবার তিনিই সকলের বিনাশ করেন। সেই দেবী স্বকীয় লীলার দ্বারা পূর্ব্বকালে দক্ষ প্রজাপতির এবং হিমালয় কন্যা হইয়া জন্মলাভ করেন। অংশ দ্বারা তিনিই লক্ষ্মী এবং সরস্বতীরূপে বিষ্ণুর, আর সাবিত্রীরূপে ব্রহ্মার বনিতা হইয়াছেন।”
–এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব থেকে শুরু করে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যার থেকে সৃষ্টি, সেই পরম ব্রহ্মকে পরমেশ্বরী-জগতের প্রসবকত্রী-সারভূতা-সনাতনী-মূল প্রকৃতি ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা হচ্ছে, অর্থাৎ নারীরূপে দেখা হচ্ছে এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব কেউই পরমেশ্বর নয়, মানুষরূপধারী এক একজন দেবতা মাত্র।
এখানে আমরা লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে বিষ্ণুর, এবং সাবিত্রীকে ব্রহ্মার পত্মীরূপে দেখতে পাই। মৎস্যপুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ে এই সাবিত্রীকেই সরস্বতী নামে ডাকা হয়েছে। সেখানে বলা আছে-
“বিধাতা লোকসৃষ্টির নিমিত্ত সাবিত্রীকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া এই জগৎকে এই সকল তত্ত্বাত্মক করিয়া দ্বিবিধরূপে উৎপাদন করেন। তিনি জপে নিরত আছেন, এমন সময় তদীয় পবিত্র দেহ ভেদ করিয়া অর্দ্ধ স্ত্রীরূপ ও অর্দ্ধ পুরুষরূপ প্রাদুর্ভূত হইল। স্ত্রীরূপার্থ শতরূপা নামে বিখ্যাত হইলেন।…এই শতরূপাই সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী ও ব্রহ্মাণী নামে প্রসিদ্ধ।”
ব্রহ্মা একেই আত্মজা রূপে কামনা করেন। অনলাইনে একেই “সরস্বতী” নাম দিয়ে ব্রহ্মার সাথে বিয়ে এবং তাদের শতবর্ষ ধরে রমণের কথা বলা হয়েছে। যদিও মৎস্যপুরাণে এখানে “শতরূপা” নাম উল্লেখ করা আছে-
“…বিশ্বাত্মা ব্রহ্মা সেই প্রণামাবনতা অনিন্দিতা শতরূপার পাণি গ্রহণ করিলেন এবং তাহার সহিত তিনি অতীব কামাতুর হইয়া কাল কাটাইতে লাগিলেন। তিনি প্রাকৃত জনের ন্যায় সেই লজ্জিতা ললনার সহিত শতবর্ষ যাবৎ কমলগর্ভে থাকিয়া রমণ করিলেন। অনন্তর দীর্ঘকাল অতীত হইলে তাঁহার এক পুত্র জন্মিল। এই পুত্র স্বায়ম্ভুব মনু নামে অভিহিত।”
ভাগবত পুরাণে এখানে অন্যভাবে বলা আছে-
“…ব্রহ্মা আপনার বামাংশ হইতে একটি স্ত্রী উৎপাদন করিলেন; তাহার নাম শতরূপা; এবং দক্ষিণাংশ হইতে একটি মহাবাহু পুরুষ সৃষ্টি করিলেন, ঐ পুরুষের নাম স্বায়ম্ভুব মনু; উনি শতরূপাকে ভার্যারূপে গ্রহণ করিয়া তিন কন্যা ও দুই পুত্র উৎপাদন করিলেন…”
এবার দুর্গার কাহিনী দিয়ে শেষ করা যাক-
“…পূর্ণা প্রকৃতি আপন অংশ দ্বারা সাবিত্রী হইয়া ব্রহ্মাকে, আর লক্ষ্মী এবং সরস্বতী হইয়া বিষ্ণুকে প্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু মহাদেব পূর্ণা প্রকৃতিকে পত্মীভাবে অপ্রাপ্ত হইয়া পুনর্ব্বার দৃঢ় যোগাসন করিয়া বহুকাল ঘোরতর তপস্যা করিলে পরে মূল প্রকৃতি প্রসন্না হইয়া ত্র্যম্বকের নয়নপথে উপস্থিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, হে শম্ভো! তোমার কি অভিলাষ তাহা প্রকাশ কর। তোমার তপস্যায় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এই ক্ষণে ইচ্ছামত বর প্রার্থণা কর।”
এই বরের ফলেই উপরে উল্লেখিত পরম ব্রহ্ম-পরমেশ্বরী-জগতের প্রসবকত্রী-সারভূতা-সনাতনী-মূল প্রকৃতি- পরম প্রকৃতি যিনি, সেই দূর্গাকে পত্মীরূপে লাভ করেন, যার সতী, উমা, অন্নপূর্ণা, শ্যামা, পার্বতী প্রভৃতি আরো কিছু নাম আছে। লক্ষ্মী এবং সরস্বতীও এই দূর্গার আপন অংশ থেকে উৎপন্ন আরো দুইটা রূপমাত্র, কোন ভাবেই দূর্গা-শিবের কন্যা নয়।
Leave a Reply