“পাড়ার খালি পড়ে থাকা বাড়িগুলোয় হিন্দুরা ফিরে আসছে। কলকাতার শরনার্থী শিবির থেকে ফিরে আসছে নিজের দেশে, ফেলে যাওয়া ঘরে। জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে সব। খাঁ খাঁ করা উঠোনে রাস্তার নেড়িকুকুরগুলো শুয়ে ছিল। এখন মানুষে কলকল করছে। ছাদের রেলিং-এ থুতনি রেখে ওদের ফিরে আসা দেখি। শুকনো ব্রহ্মপুত্রে যেন জোয়ার এসেছে। মরা বাগান ফুলে রঙিন হয়ে আছে। হারানো জিনিসের জন্য ওদের কাউকে শোক করতে দেখি না। নিজের ভিটেটুকু পেয়েই ওরা খুশি। এর মধ্যেই কীর্তন গাইতে শুরু করেছে কোনও কোনও বাড়ি। মেয়েরা সন্ধে বাতি জ্বেলে উলু দিচ্ছে ঘরে ঘরে। আস্ত একটা শ্মশান আজ গা ঝেড়ে জাগল।
ওরা চলে আসার দিন সাতেক পর আমাদের কালো ফটক খুলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা আসে, পেছনে পনেরো ষোলোজন মুখ চেনা পাড়ার লোক। অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাই বাড়ির ভেতর হেসে, ওদের কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই, যেন জন্মের শত্তুরের বাড়ি ওরা বেড়াতে এসেছে। ওরা এ ঘরে ও ঘরে হাঁটে, আর বলে কই লুটের মাল কই! যার যা মাল উঠাইয়া লও।
পাড়ার মুখ-চেনা লোকেরা এক এক করে আমাদের কাঁসার বাসন, পেতলের কলসি, চেয়ার টেবিল উঠিয়ে নিয়ে যায়। মা সেলাই মেশিনের ছিদ্রে তেল ঢালছিলেন, তেলের কৌটা হাতেই ধরা থাকে, মেশিনটি আলগোছে একজন কাঁধে উঠিয়ে নেয়। হতবাক দাঁড়িয়ে থাকি আমি, মাও।
বাড়ি লুট করে চলে যাওয়ার পর মা বলেন, যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিকই আছে।
কথাটি বাবার উদ্দেশ্যে বলেন মা, আমি বুঝি। গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর বাড়িতে নতুন কিছু জিনিস দেখে মা বলেছিলেন এইগুলা কি কিনলা নাকি? কিনলা যদি পুরান জিনিস কিনলা ক্যান? পচা গলা গুড়ের ড্রাম দিয়া করবাটা কী!
বাবা মোজা খুলে জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিলেন, কথা বলছিলেন না।
–নাকি হিন্দু বাড়ি থেইকা লইয়া আইলা? মা নাক সিঁটকে বলেছিলেন। বাবা তারও উত্তর দেননি।”
— ‘আমার মেয়েবেলা’, তসলিমা নাসরিন।
——————————————
শহরের কথা ঠিক জানি না, তবে গ্রামাঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে দেশের কোন মুসলমান বাড়িতে কাঁসার বা পেতলের জিনিসপত্র ছিল না। মুসলমান বাড়িতে বাসন-কোসন বলতে ছিল মাটির তৈরী জিনিসপত্র। অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতেও খোলা উঠানে বসে মাটির থোরায় করে ভাত খেতে দেখা যেত। স্বাধীনতার পরে রাজাকার ছাড়াও অনেকের বাড়িতে এরকম অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। তসলিমা নাসরিন বাদে আর কেউ সেটা স্বীকার করেছেন কিনা, ঠিক জানা নাই।
আমার বাপ-দাদারাও সরাসরি রাজাকার না হলেও ঠিক এমন কাজ করেছিলেন। এখনো আমাদের বাড়ির আলমারিতে সেরকম পুরাতন কিছু কিছু জিনিস আছে। আশে-পাশের এলাকার অনেকেই ফিরে এলেও পরে আবার চলে গেছে। এখন প্রায় নাই বললেই চলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কয়েক বছর পর পর মাঝে মাঝে এসে তাদের বাপ-দাদার ভিটে-মাটি দেখে যায়। দু-চারদিন থাকে। আমরা আদর-যত্ন করে রাখি। ওসব জিনিসগুলা দেখিয়ে আমরা খুব গর্ব করে বলি- ওগুলা আমরা এনে গুছিয়ে রেখেছিলাম, নইলে তো লুটপাট হয়ে যেত!
Leave a Reply