লিখেছেন: ফারজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা)
প্রসঙ্গটি ব্র্যাক থেকে শুরু হলেও কিছু কথা না বললেই আজ নয়। অনেক কিছু নিয়ে বলতে হয়। এই কথা গুলো বহু গুণীজন বহু ভাবে বলে গেছেন। আর আমরা না দেখার ভান করে বলে গেছি আমার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগছে।
ধর্মানুভূতি, কি তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ঘটনা ১
মেয়েটা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো। ক্লাসের বেঞ্চে বসতে গেলে দেখে আগে থেকেই আরেকজন বেঞ্চের এক পাশ দখল করে বসে আছে। মেয়েটি প্রশ্ন করলো, আমি কি তোমার সঙ্গে বসতে পারি? পাশের মেয়েটি তাকে উত্তর দেয়, যদি মুসলমান হও তাহলে আমার পাশে বসো। ধরুন এই মেয়েটি যদি কোন মুসলিম পরিবারের না হয়ে কোন অমুসলিম পরিবারের সন্তান হতো, তাহলে তার কেমন লাগতো ? ঘটনাক্রমে আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে ছিল। আমি ৫/৬ বছর বয়সে কথাটা বুঝতে পারিনি। পরের দিন আমি সেই বেঞ্চে বসেছিলাম, আমার আরেক সহপাঠীর সঙ্গে আমিও একই আচরন করেছিলাম। শিশুরা একে অন্যকে দেখেই শিখে। আমার পাশের যে মেয়েটি আমাকে কথাটি বলেছিলো প্রথম ক্লাসেই, সেই মেয়েটি নিশ্চয়ই এমন একটি কথা তার পরিবার থেকেই শিখে এসেছিল। আজ এতদিন পরও আমি কথাটি মনে রেখেছি, কারন সেই আচরন আমার মনের মধ্যে গেথে বসে আছে। একবার ভাবুন, একজন অমুসলিম বাচ্চার সঙ্গে এই আচরণটি করলে তার কেমন লাগতো? ধর্মানুভূতি কি শুধু মুমিনের আর ইসলামের সম্পত্তি? অন্য ধর্মের লোকেদের ধর্মানুভূতি নাই?
ঘটনা ২
৫/৬ জন বন্ধু এক সঙ্গে বসা। এদের মধ্যে একজন অমুসলিম। কোন কারনবশত একজন মুসলিম আর একজন অমুসলিম বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া শুরু হলো। তখন মুসলিম বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠে ” শালা মালুর বাচ্চা, মুইত্তা পানি নেস না, আসছোস বড় বড় কথা কইতে। এই জন্যই কয় হিন্দুর বগলে ইট”; এইবার বলেন হিন্দু বন্ধুটির কেমন লাগে? বাংলাদেশ থেকে দিন দিন হিন্দুরা ভারতে চলে যাচ্ছে। আনন্দবাজার পত্রিকার তথ্য মতে, ১৯৪১ জনগণনার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু ছিল ২৮%। ১৯৫১ সালে ছিল ২২%, ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ১৩.৫% (মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭১ সালে জনগণনা হয়নি), ১৯৮১ সালে ১২.৫%, ১৯৯১ সালে ১০.৫% আর ২০১১ সালে ৯.৬%।
বাংলাদেশে কুরবানি ঈদে বড় বড় গরু জবাই দেয়া হয়, মুসলিম তার উৎসব করবেই। তবে আমার জানা মতে, ইসলামে দুম্বা বা ছোট প্রানী জবাই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। স্বয়ং সৌদি আরবে গরু কুরবানি হয় না। যাই হোক, আপনার প্রতিবেশী যে হিন্দু বা অমুসলিম, অথবা কারো ধর্মে প্রাণী হত্যা মহাপাপ.. সেখানে আপনি তার বাড়ির সামনে আয়েশ করে কসাই নিয়ে গরু কাটছেন। কি মনে হয় আপনার প্রতিবেশীর ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? সংখ্যালঘুর দেশত্যাগ নিয়ে বাংলাদেশে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। সংবেদী শিক্ষিত সুশীল সমাজের মানুষ এককাট্টা হয়ে দাঙ্গায় দুর্ভোগে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবু শত্রু সম্পত্তি আইনের জাঁতাকলে পড়ে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ অব্যাহত রেখেছে।
ঘটনা ৩
আপনি মুসলমান, খুব তো জন্মদিন করছেন। আপনি কি জানেন, জন্মদিন পালন করা ইসলামে নিষেধ। এই যে ঈদে মিলাদুন নবী, মুহাম্মদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছেন তা স্বয়ং সৌদি আরবেই কেউ পালন করে না। জন্মদিন পালন করে খ্রীষ্টান ধর্মাম্বলী আর হিন্দু ধর্মাম্বলীর লোকজন যেমন: শ্রী কৃষ্ঞের জন্মদিন। এছাড়া খ্রীষ্টানরা যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিনকে বড়দিন হিসেবে পালন করে। খ্রীষ্টান ধর্মের কিছু দল ২৫শে আগষ্টকে যীশুর জন্মদিন বলে মানে না। এমন কি তারা জন্মদিন পালন করে না। হিন্দুয়ানি রীতি পালন করবেন আবার হিন্দুরেই গালি দিবেন; কেন তাদের রক্তের রং কি সাদা? তাদের ধর্মানুভূতি নাই। পৌত্তলিক, প্যাগান, জরাষ্ঠ্রুবাদ আর আব্রাহামিক ধর্মের অনুকরণে গড়ে তোলা একটা ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন আপনাদের?
ঘটনা ৪
আমি যেই স্কুল কলেজে পড়ালেখা করেছি, প্রতিদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে এসেম্বলীতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো, তারপর প্রার্থনা করা হতো । আমি ঠোটস্থ বলতে পারি এখনো, ” রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার” এই দোয়া আবার ইংরেজীতে ও বাংলায় অনুবাদ করে পড়ানো হতো। আমরা পবিত্র দোয়া পাঠ করে ক্লাস করতে যেতাম। কোনদিন পাশের হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ছাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম না তাদের অনুভূতি কি? কোনদিন দেখি নাই এসেম্বলীতে গীতা, ত্রিপিটক বা বাইবেল পাঠ করতে; তাহলে আমরা কি শিখলাম? ইষ্ট এন্ড দা ওয়েষ্ট ইসলাম ইস দা বেষ্ট। আমার এখনও মনে আছে, আমার ক্লাসমেট যে খ্রীষ্টান ছিল, তাকে ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা দিতে হয়েছিল এসএসসি তে। কি মনে হয়? মেয়েটিকে যে বাধ্য হয়ে ইসলাম শিক্ষায় পরীক্ষা দিতে হয়েছিল তা কি সে মনের আনন্দে দিয়েছিল?
ঘটনা ৫
বাংলাদেশে লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয় নামে একটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি পীঠ বিদ্যালয়। এখানে ইসলামের ইতিহাসে যারা অনার্স ও মাষ্টার্স করছে তাদেরকে সাদা বোরখা পরে ক্লাস করতে হয় এবং তা বাধ্যতামূলক। তখন তো কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখি না। জিজ্ঞ্যেসও করতে দেখিনা, আপনারা যে সবাই বোরখা পরে ক্লাস করেন সেটা কি স্বইচ্ছায় নাকি আপনাদের কেউ জোর করছে?
ঘটনা ৬
ঢাকার রাস্তায় ইদানিং কিছু হুজুর ধরনের লোক হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা কোন মেয়ের মাথায় ঘোমটা না দেখলেই চিৎকার করে ওঠে পুরো রাস্তার মাঝে। একবার আমি রিকশার হুট তুলে বাসায় যাচ্ছি। হঠাৎ আমার রিকশাওয়ালা আমায় বললো, আফা সামনের একটু জায়গায় মাথায় ঘোমটা দিয়া লইন। এক বুইড়া ঝামেলা করে। আমি অবাক হয়ে রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। আমি বললাম, বুইড়া ঝামেলা করলে আমার কি? কিছুদূর যাবার পর টের পেলাম, রিকশাওয়ালা কি বলছিলো। হঠাৎ করে এক বৃদ্ধ কোথা থেকে উদয় হলো আর চিৎকার করে উঠলো, ঐ বদমাইশ মাইয়া তুমি মুসলমানের মাইয়া না, মাথায় কাপড় নাই কেন? আমি মাথায় কাপড় দেইনি সেজন্য সে পুরো রাস্তা চিৎকার করে মাথায় ওঠালো। এই দায়িত্ব তাকে কে দিয়েছিল? আমি যদি একজন বিধর্মী মহিলা হতাম, সে কি আমার পোশাক আশাক বা গায়ের চামড়া দেখে বুঝতো? বুঝতো না? তখন আমরা কেউ প্রতিবাদ করি না। বলিনা আমার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
ঘটনা ৭
আপনি মুসলমান, আপনার ধর্মই পৃথিবীর সেরা ধর্ম। পশ্চিমারা আর ইহুদীরা ষড়যন্ত্র করে আপনার ধর্মকে সন্ত্রাসের ধর্ম বানিয়ে দিচ্ছে। আপনি কি ধোয়া তুলসি পাতা? বিদেশে হারাম দেশের হারাম টাকার চাকুরী মাইনে এগুলো কি ইসলামে হালাল? নাকি শুধু টাকাই মজা লাগে, তাদের কায়দা কানুন সব হারাম? ফ্রান্সে ব্যাংকে এবং স্কুল কলেজে নিকাব নিষেধ, বোরখা নিষিদ্ধ নয়। আপনার কি ধারনা পর্দা প্রথা শুধু ইসলামেই আছে? ভাল করে দেখেন তো, খ্রীষ্টান ধর্ম পালনকারী মহিলা নানেরা কি পোশাক পড়ে? বলেন তো, যে সৌদি আরব সারা জাহানে মসজিদ তৈরী করার জন্য টাকা পাঠায়, সেই সৌদি আরবে কটা অন্য ধর্ম পালনের উপাসনালয় আছে? আপনি কি জানেন, মক্কায় মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষের প্রবেশ নিষেধ? প্যালেষ্টাইন দেশটাকে ইহুদীরা শেষ করে ফেলছে। মুসলমানদের মারছে। আগে বলেন, জেরুজালেমে কোন ধর্ম আগে এসেছিল? ইহুদী না ইসলাম? ইহুদীদের কারা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলো? আপনার দেশটা বাংলাদেশ। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর ঐ ইতিহাস, ঘোড়া নিয়ে দৌড়ায় আসলেন, আর লক্ষণ সেন নৌপথে পালিয়ে গেলেন পড়ে বড় হচ্ছেন। একবার ভেবেছেন, এই ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী আসলে ডাকাত ছিল। সে আপনার দেশে লুটপাট করতে এসেছিল। তার সঙ্গে শাহজালাল নামক ধর্ম ব্যাবসায়ীরা এসেছিল ধর্ম ব্যবসা করতে। দেশটাকে আমরা এভাবেই জামাতের হাতে তুলে দিচ্ছি। দেশ হয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান।
ঘটনা ৭
একটি মেয়ে বাসে উঠেছে। বেশ সাঁজগোজ করে। কলেজে অনুষ্ঠান ছিল। হঠাৎ বাসে এক মহিলা চিৎকার করে উঠলো , বেপর্দা মেয়ে মানুষ। বাপ মা এগুলা শিখাইছে? পর্দা করতে জানো না। মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গেল। এমন তো আগে কখনো ঘটেনি। এটা কি? আমি তো স্যালোয়ার কামিজ পড়া। আমার ওড়নাটাও ভালভাবে জড়িয়েছি গায়ে। তবে? আজকাল দেখছি ফেসবুকে অন্যের স্লিভলেস ব্লাউজ পড়া ছবি নিয়ে লোকজন কথা বলছে, অথচ এ ধরনের সমস্যা যে কোথা থেকে তৈরী হচ্ছে তারা তা বোঝে না। এক সময় বেলল্লাপণার কথা বলে প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখও যে বন্ধ করে দেবে, সে খেয়াল কি আছে বাঙ্গালীর?
ঘটনা ৮
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন গড়ে তোলা হচ্ছে জঙ্গী বাহিনী। নামাজ ঘরে বসে, বা তাবলিকের বাহানায় মানুষের মগজ ধোলাই হচ্ছে? তখন তো সুধী সমাজ আপনারা কেউ প্রতিবাদ করতে আসেন না।
ঘটনা ৯
বাংলাদেশ থেকে দাউদ হায়দার আর তসলিমা নাসরীনকে যখন দেশ ত্যাগ করতে হয়, তখন আপনাদের প্রতিবাদের মুখ থাকেনা। বলেন বেশ করেছে। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে লিখবে তাদের পরিণতি এমনই হবে। তাদের পরিণতি হবে স্যার হুমায়ুন আজাদ আর রাজীব হায়দারের মতো!! ইসলামের প্রতি আঘাত বলে ব্লগারদের; আসিফ মহিউদ্দীন, সুব্রত শুভ, রাসেল পারভেজ আর বিপ্লবরা গ্রেফতার করা হবে আপনাদের ধর্মানুভীতি আঘাতের বাহানায়। পর্যায়ক্রমে তথ্য প্রযু্ক্তি আইন করে তাদের আরো হয়রানি করা হবে। বাহ বাহ !! সত্যি স্যালুকাস !!
শেষ কথা :
এবার আসি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি প্রসঙ্গে। ভাল করে লক্ষ্য করুন, ওখানে পর্দা করতে না করেনি। নিরাপত্তাজনিত কারনে শুধুমাত্র নিকাব পরিধান করতে নিষেধ করেছে। নিকাবের আড়ালে কে আসে? কোন মানুষ? আসলেই সেই ছাত্রী নাকি অন্য কেউ? আপনি কি তাকে অন্যের সঙ্গে আলাদা করতে পারবেন? ইসলামে তো নারী পুরুষের এক সঙ্গে চলাই নিষিদ্ধ। এরা মহিলা কলেজে গেলেই পারে। তাহলে তো আর কোন সমস্যাই থাকছে না। আপনি মডারেট মুসলিম। ইসলামে মডারেট বলতে কিছুই নেই। ইসলামকে মানলে পুরোপুরি মানতে হবে নতুবা আপনি মুসলমানই নন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে, তা পালন করার দায়িত্ব ঐ প্রতিষ্টানের প্রতিটি মানুষকে। ভাবুন; নাকি ভাবলে আপনার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে ?
Leave a Reply