ব্যথা হচ্ছে মস্তিষ্কের একটি ইন্টারপ্রিটেশন বা রেসপন্স। দেহ কোথাও আঘাত পেলে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান স্নায়ুর মাধ্যমে ব্যথার খবর মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়, আর তাই আমরা ব্যথা পাই। স্নায়ু এখানে টেলিফোন লাইনের তারের কাজ করে। ডাক্তাররা তাই অপারেশনের কাটাকুটি করার আগে ঔষধ দিয়ে স্নায়ু সাময়িকভাবে অকেজো করে নেন। তাই যতই কাটাকুটি করা হোক, রোগী তা টেরই পায় না। এমনিভাবে প্যারালাইজড রোগীর হাত পায়ে যদি ড্রিল মেশিন দিয়েও ফুটো করেন তবু সে সামান্য ব্যাথাও অনুভব করবে না, কারণ তার স্নায়ু বিকল। এদিকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মানুষের মৃত্যু হয় তখনই, যখন তার মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যায়। মস্তিষ্ক বেঁচে থাকে পুষ্টি আর অক্সিজেন দিয়ে, যা এটা রক্তের মাধ্যমে পায়। অক্সিজেন ছাড়া মস্তিষ্ক ১০ সেকেন্ডের বেশি বাঁচে না। তাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে না বলেই মানুষ মারা যায়।
লিখেছেন অর্ণব খান
কোরান-হাদিসে মৃত্যুকষ্ট নিয়ে ভয়ানক সব কথা বলা আছে। যেমন, যে সবচেয়ে কম কষ্ট পেয়ে মারা যায়, তার কষ্টের তুলনা নাকি একটা চড়ুই পাখিকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত ফুটন্ত তেলে চুবিয়ে মারা বা একটা জীবন্ত গরুর সারা দেহের চামড়া টেনে ছিঁড়ে উঠিয়ে ফেলার মত।
এবার একটু যুক্তি দিয়ে আলোচনা করা যাক মৃত্যুকষ্ট কেমন হতে পারে। গভীরে যাবার আগে প্রথমে একটু
১. কষ্ট বা ব্যথা এবং
২. মৃত্যুর বেসিক ব্যাপারটা বুঝে নেয়া যাক।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হওয়া মৃত্যু অবশ্যই কষ্টদায়ক হবে। যেমন আগুনে পুড়ে মৃত্যু, পানিতে ডুবে মৃত্যু ইত্যাদি। তবে সেই কষ্টটা কেমন? আগুনে যখন চামড়া পুড়ে যায় তখন প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়। তবে কিছু সময় পর চামড়া সম্পূর্ণ পুড়ে গেলে প্রচন্ড ব্যথা আর থাকে না, কারণ স্নায়ুগুলো পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আর স্নায়ু না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যথাও থাকে না। তবে হাসপাতালে আগুনে পোড়া রোগীদের যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা যায়। এর কারণ চামড়ার নিচের টিস্যুতেও অল্প পরিমান স্নায়ু থাকে। এই ব্যথাটুকু আগুনে পুড়ে যাওয়ার সময় প্রাপ্ত ব্যথার তুলনায় কিছুই না। যদি রোগীকে মরফিন দিয়ে তার স্নায়ু সাময়িকভাবে অকেজো করে রাখা হয়, তবে সে আর সামান্যতম ব্যথাও পায় না। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভিকিটিম যখন আর দম আটকে রাখতে পারে না, তখন ফুসফুসে পানি ঢুকে যায়, আর ফুসফুস পুড়ে বা ছিঁড়ে যাবার মত অনুভূতি হয়। তবে খুব দ্রুতই ব্যথা চলে যায়, আর শান্ত একটা ভাব চলে আসে, এরপর সে জ্ঞান হারিয়ে মৃত্যুবরণ করে। পানিতে ডুবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং পরে উদ্ধারকৃত অনেক ব্যক্তির অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা যায়। কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও ডুবার সময় তারা যেটুকু কষ্ট পায় মৃত্যুর সময় নতুন করে আর কষ্ট পাবেনা কারণ তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
তবে ঘুমের ঔষধ খেয়ে মৃত্যু, লিথাল ইঞ্জেকশন দিয়ে মৃত্যু, ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে মৃত্যু, ঘরে শুয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বা ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু হলে তা মোটেই প্রচণ্ড কষ্টদায়ক হয় না। কারণ এসব মৃত্যুর ক্ষেত্রে শরীরের স্নায়ুগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়না যে শরীর ব্যাথা পেতে পারে, বরং কোন কারণে মস্তিষ্ক অক্সিজেন বা পুষ্টি বঞ্চিত হয়ে ব্যাথাহীন বা অল্প ব্যাথায় মৃত্যুবরণ করে। ব্যথা ব্যাপারটাই মস্তিষ্কের একটা ছলনা বা ডিফেন্স মেকানিজম যা বিবর্তনের একটা উপযোগ মাত্র। ব্যথা না থাকলে প্রাণীকুল তাদের শরীরের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হত না, ফলে তারা টিকে থাকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যেত। তাই ব্যাথার সাথে টিকে থাকার সম্পর্ক থাকলেও ব্যাথার সাথে মৃত্যুর সরাসরি সম্পর্ক নেই।
ব্যথা যে নিছক মস্তিষ্কের একটা ছলনা, তা যে কেউ ঘরে বসে সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে। যেমন, টেবিলের ওপর আপনার একটা হাত রাখুন। তারপর হাতটির ওপর খাড়া করে একটি কাগজ বা অন্য কিছুর তৈরি দেয়াল বানান যাতে আপনি নিজের হাত দেখতে না পান, কিন্তু টেবিলের অপর প্রান্তে আপনার বন্ধু আপনার হাত দেখতে পায়। এবার টেবিলে একটি প্লাস্টিকের হাত রাখুন। বন্ধুকে বলুন আপনার আসল হাত আর প্লাস্টিকের হাতের ঠিক একই জায়গায় দীর্ঘক্ষন ধরে মৃদু আঘাত করতে। আপনি ততক্ষণ প্লাস্টিকের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকুন। আপনার মস্তিষ্ক একসময় প্লাস্টিকের হাতটিকেই আপনার হাত বলে ধরে নেবে। বন্ধুটি যদি এই সময় প্লাস্টিকের হাতে সজোরে আঘাত করে কিন্তু আপনার আসল হাতে আঘাত না করে তবুও আপনি কঠিন ব্যথা পাবেন। এটাই মস্তিষ্কের ছলনা।
পরিশেষে বলা যায়, মৃত্যু নিয়ে ভয়ের কিছুই নেই, কারণ মৃত্যু শান্তির। আপনি চলে যাবেন অতল অনন্ত ঘুমের জগতে, মৃত্যুর সামান্য কষ্টের স্মৃতিটুকুও আপনার থাকবে না, ঠিক যেমন জন্মের সময় বা শিশু অবস্থায় প্রাপ্ত ব্যথার স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়!
Leave a Reply