লিখেছেন অর্ণব খান
ইলেক্ট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন তিনটি কণার নাম। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে অর্থাৎ মাটি, পানি, বায়ু, হাতি, ঘোড়া, চেয়ার, টেবিল, লোহা, পাথর ইত্যাদি সবকিছু, একদম সব সব সবকিছু যদি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়, তাহলে একসময় ইলেক্ট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন এই তিনটি কণা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এই তিন কণা দিয়েই জগৎ-সংসারের সকল বস্তু গঠিত। এই তিনটি কণা বিভিন্ন সংখ্যায় এবং বিভিন্ন ডিজাইনে একত্রিত হয়ে সোনা, রুপার মত ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ তৈরি করে।
এই কণাগুলো দিয়ে তৈরি একটা লোহার টুকরোকে আমরা নির্জীব মনে করি। অথচ এই টুকরোতেই অসংখ্য ইলেক্ট্রন তাদের বৈশিষ্ট অনুযায়ী বিভিন্ন সাইজের বৃত্তের আকারে সবসময় ঘুরছে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে এটিকে আর নির্জীব মনে হবে না। অথচ আমরা কেউ বলি না, এই লোহার টুকরোটির প্রাণ আছে। বাস্তবে দেখলাম, প্রাণ না থাকলেও এটি কিন্তু স্থির বা অচল নয়।
লোহা যেমন অণু-পরমাণু দিয়ে গঠিত একটি পদার্থ, আমাদের শরীরও অণু-পরমাণু দিয়ে গঠিত বিভিন্ন পদার্থের একটি সমষ্টি মাত্র। সমগ্র জীবদেহের মূল দু’টি পদার্থ হচ্ছে অ্যামাইনো এসিড এবং ডিএনএ। অ্যামাইনো এসিড এবং ডিএনএ সম্পর্কে এবার কিছু আলোচনা করতেই হবে, নইলে পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।
অ্যামাইনো এসিডগুলো বিভিন্ন সংখ্যায় এবং ডিজাইনে একত্রিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরি করে। এই বিভিন্ন প্রোটিনগুলোই শরীর গঠন করা থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল কাজ করে দেয়। গঠনের কথা বললে চোখ, নাক, কান, চামড়া, রক্ত ইত্যাদি প্রায় সব অঙ্গই প্রোটিন দিয়ে তৈরি। কাজের কথা বললে পরিপাক, অণুজীব থেকে প্রতিরক্ষা, নতুন প্রোটিন তৈরি, নতুন ডিএনএ তৈরি ইত্যাদি প্রায় সকল কাজই প্রোটিন করে দেয়। অন্যদিকে ডিএনএ হচ্ছে এইসব প্রোটিন তৈরির রেসিপি বই, ডিএনএ থেকে তথ্য নিয়েই প্রোটিন তৈরি হয়। অতএব বোঝা যাচ্ছে, প্রাণীদেহ মূলত অ্যামাইনো এসিড আর ডিএনএ-র পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ফসল।
এই প্রোটিন আর ডিএনএ কি অলৌকিক সৃষ্টি? না, তা নয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে প্রোটিন আর ডিএনএ তৈরি করতে পারেন। এসব প্রোটিন আর ডিএনএ-র কাজগুলোও স্বতস্ফূর্ত বা অটোমেটিক। চুম্বকের সামনে লোহা আনলে যেমন তা অটোমেটিক আকর্ষণ করে, তেমনি ল্যাবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করলে প্রোটিন আর ডিএনএ-গুলো অটোমেটিক ঠিক একই কাজ করে, যা তারা শরীরের ভেতর থাকলে করত। আচ্ছা, এমন কোনো পদার্থ কি আছে, যা প্রোটিনের কাজ করতে পারে, আবার ডিএনএ-র কাজও করতে পারে? হ্যাঁ, আছে, তার নাম আরএনএ। আরএনএ আর ডিএনএ-র গঠন প্রায় একই, শুধু একটির গাঠনিক একক একটু অন্যরকম। জড় থেকে জীব সৃষ্টির প্রথম ধাপই হচ্ছে এই আরএনএ তৈরি হওয়া।
গবেষণাগারে এমন আরএনএ অণু তৈরি করা গিয়েছে, যা সেলফ রেপ্লিকেটিং অর্থাৎ এটি নিজে নিজে ঠিক নিজের মত আরেকটি আরএনএ অণু তৈরি করতে পারে। এটাই কি জীবনের সংজ্ঞা নয়? এখানে তো অলৌকিক কিছু নেই, এসিড যেমন তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অনেক কিছু গলিয়ে ফেলে, এই আরএনএ অণুও এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নতুন অণু তৈরি করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানীরা নাহয় এমন আরএনএ তৈরি করেছেন, কিন্তু নিজ থেকে কি এমন আরএনএ তৈরি হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। উপযুক্ত পরিবেশে আরএনএ-র গাঠনিক উপাদানগুলো একসাথে থাকলে তা থেকে আরএনএ অণু তৈরি হতে পারে, ঠিক যেমন উপযুক্ত পরিবেশে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে পানি তৈরি হয়। এভাবেই একসময় এমন এক আরএনএ অণু তৈরি হয়েছিল, যা কিনা অ্যামাইনো এসিড জোড়া লাগিয়ে প্রোটিন বানাতে পারত। তখন থেকেই প্রাণের সূচনা হল। আরএনএ’র এই প্রোটিন বানাতে পারাটাও অলৌকিক কিছু না, কারণ এমন অনেক নির্জীব অনুঘটক আছে যারা আরএনএ-র মত এই প্রোটিন বানানোর কাজ করতে পারে। এরপর কীভাবে এই সরল প্রাণ থেকে জটিল প্রাণের উদ্ভব হল, সেটা বিবর্তন তত্ত্ব খুব ভাল করে ব্যাখ্যা করে দেয়। তাই নিজেদের সৃষ্টির ইতিহাস জানতে বিবর্তন বিষয়ক বই পড়তে হবে।
Leave a Reply