লিখেছেন গোলাপ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০ > পর্ব ২১ > পর্ব ২২ > পর্ব ২৩ > পর্ব ২৪ > পর্ব ২৫ > পর্ব ২৬ > পর্ব ২৭ > পর্ব ২৮ > পর্ব ২৯ > পর্ব ৩০ > পর্ব ৩১ > পর্ব ৩২ > পর্ব ৩৩ > পর্ব ৩৪ > পর্ব ৩৫ > পর্ব ৩৬ > পর্ব ৩৭ > পর্ব ৩৮ > পর্ব ৩৯> পর্ব ৪০ > পর্ব ৪১
স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় এসে কুরাইশদের ওপর যে সকল আক্রমণাত্মক অনৈতিক সহিংস বর্বর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন, তার বৈধতার প্রয়োজনে তিনি তাঁর রচিত ব্যক্তিমানস জীবনীগ্রন্থ কুরানের মদিনা পর্বে বারংবার ঘোষণা দিয়েছেন যে, মক্কায় অবস্থানকালে “কুরাইশরা মুহাম্মদ অনুসারীদের অন্যায়ভাবে তাঁদের ভিটে মাটি থেকে বিতাড়িত করেছে।” মুহাম্মদের এই দাবি যে ইসলামের হাজারো মিথ্যচারের একটি তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
আর মুহাম্মদকে বিতাড়িত করারপরিপ্রেক্ষিতে যে-উপাখ্যান মুহাম্মদ তাঁর স্বরচিত ব্যক্তিমানস জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ও তাঁর মৃত্যুপরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকরা মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণনা করেছেন, তা “আরব্য উপন্যাসের” গল্পের মতই উদ্ভট ও বিচিত্র! আর তা হলো:
মুহাম্মদের রচনা:
সুরা আনফাল (মদিনায়) – আয়াত ৩০
৮:৩০: আর কাফেরেরা যখন প্রতারণা করত আপনাকে বন্দী অথবাহত্যা করার উদ্দেশ্যে কিংবাআপনাকে বের করে দেয়ার জন্য তখন তারা যেমন ছলনা করত তেমনি, আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুত: আল্লাহর ছলনাসবচেয়ে উত্তম।
>>> স্পষ্টতই মহাজ্ঞানী সর্বজ্ঞ আল্লাহর নামে মুহাম্মদের এই উদ্ধৃতি একজন বিভ্রান্ত মানুষের র “অনুমান নির্ভর” উক্তি। যে-মানুষটি জানেন না, “কুরাইশরা তাঁকে বন্দী করতে চান? নাকি, হত্যা করতে? নাকি, দেশ থেকে বহিষ্কার করতে?”
আর ছলনা? ছলনা করার প্রয়োজন হয় কাদের?
ছলনা করার প্রয়োজন হয় ঐ ব্যক্তির, যিনি তাঁর প্রতিপক্ষের তুলনায় “অনেক দুর্বল”।
এই চমকপ্রদ অনন্ত মহাবিশ্বের স্রষ্টার (যদি থাকে) কোনো ছলনার প্রয়োজন নেই! কারণ (বলা হয়) তিনি অনন্ত শক্তির অধিকারী। অনন্ত শক্তির অধিকারী কোনো সত্ত্বা তার কর্ম সম্পাদনের জন্য “ক্ষুদ্র মানুষের” সাথে ছলনা করেন, এমন উক্তি সেই মানুষটির পক্ষেই করা সম্ভব যিনি মহাবিশ্বের বিশালতা ও তার স্রষ্টার ব্যাপারে “সামান্যতম ধারণা”ও রাখেন না।
আর মুহাম্মদের সাথে কুরাইশদেরও ছলনা করার কোনই প্রয়োজন নেই। কারণ সেই অবস্থায় মক্কায় মুহাম্মদের অবস্থান ছিল কুরাইশদের তুলনায় অত্যন্ত দুর্বল। কুরাইশরা ছিলেন মুহাম্মদ ও তাঁর সুদীর্ঘ ১২-১৩ বছরের অক্লান্ত চেষ্টার ফসল মাত্র ১২০-১৩০ জন (যাদের অনেকেই মুহাম্মদের আগেই আবিসিনিয়ায় ও মদিনায় পলায়ন করেছেন) অনুসারীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, “নবনিযুক্ত হাশেমী গোত্র প্রধান আবু লাহাব” এই ঘটনার তিন বছর আগেই (৬১৯ সাল) মুহাম্মদের ওপর থেকে সগোত্রীয় নিরাপত্তা সুবিধা (Clan protection) বাতিল করেছেন এবং মুহাম্মদের অনুসারীরা মুসলমানিত্ব ছেড়ে আবার তাঁদের পূর্ব ধর্মে প্রত্যাবর্তন করছেন – যার আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
মুহাম্মদের অনুসারীরা তাঁর নবীর নির্দেশে যখন নিজেরাই পলায়ন করছেন, তখন তাঁদেরকে যে “বহিষ্কার করার” কোনই প্রয়োজন নেই তা বোঝার জন্য কোনো মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
৬১৯-৬২২ সালের মক্কায় এই পলায়নরত দলেরই দলনেতা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ।
সুদীর্ঘ ১২-১৩ বছর যাবত “উপদ্রবকারী ব্যক্তিটি” যে-মুহূর্তে অত্যন্ত দুর্বল ও পলায়নরত অবস্থায়, তখন তাঁকে হত্যা অথবা বন্দি করে “অতিরিক্ত ঝামেলা”পোহানোর প্রয়োজন কুরাইশদের ছিল না। আর পলায়নরত (যে নিজেই পালাচ্ছে) কোনো ব্যক্তিকে কি বহিষ্কার করা সম্ভব?
যে-পরিস্থিতিতে মুহাম্মদের “নবী-জীবনের অবসান কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র” সেই অবস্থায় কুরাইশরা মুহাম্মদকে বন্দী অথবা হত্যা অথবা বহিষ্কার করার কিচ্ছা যে মদিনায় এসে কুরাইশদের ওপর মুহাম্মদের যাবতীয় আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বৈধতার প্রয়োজনে “মিথ্যাচার”, তা বলাই বাহুল্য।
কুরাইশরা যদি মুহাম্মদকে “হত্যা অথবা বন্দী অথবা বহিষ্কার” করতে চাইতেন, তবে তাঁরা তা বহু আগেই অতি সহজেই করতে পারতেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮) ও আল তাবারীর (৮৩৯-৯১৩) রচনার সংক্ষিপ্তসার:
মুহাম্মদের বাড়ির চারপাশে পাহারারত সমস্ত হৃষ্ট-পুষ্ট-সবল-সুঠাম বলিষ্ঠ কুরাইশ জোয়ানদের কিছু সময়ের জন্য “অলৌকিক উপায়ে আল্লাহ দৃষ্টিশক্তিরহিত করে দেয়”। আর মুহাম্মদ সেই বলিষ্ঠ জোয়ানদের “মাথার ওপর ধুলো ছিটিয়ে” অলৌকিক উপায়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে কুরানের যে বাণী মন্ত্রের মত জপতে জপতে পলায়ন করেন তা হলো এই:
“ইয়া-সীন। প্রজ্ঞাময় কোরআনের কসম। নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রসূলগণের একজন। সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। কোরআন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ, যাতে আপনি এমন এক জাতিকে সতর্ক করেন, যাদের পূর্ব পুরুষগণকেও সতর্ক করা হয়নি। ফলে তারা গাফেল। তাদের অধিকাংশের জন্যে শাস্তির বিষয় অবধারিত হয়েছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না। আমি তাদের গর্দানে চিবুক পর্যন্ত বেড়ী পরিয়েছি। ফলে তাদের মস্তক উর্দ্ধমুখী হয়ে গেছে। আমি তাদের সামনে ও পিছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা দেখে না [সুরা ইয়াসিন- ৩৬:১-৯]” [1] [2]
>>> কী তেলেসমাতি কাণ্ড! ‘মাথার উপর’ (চোখে নয়) ধুলা ছিটিয়ে অপেক্ষারত সমস্ত হৃষ্ট-পুষ্ট, সবল-সুঠাম ও বলিষ্ঠ কুরাইশ জোয়ানদের চোখের সামনে দিয়ে “তিনি” পলায়ন করেন!
মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (৭৮৪-৮৪৫) এর অতিরিক্ত বর্ণনা:
তারপর পথিমধ্যে ‘থোয়ার (Thawr)’ নামক এক গুহায় পলাতক মুহাম্মদ ও আবু বকরের আত্মগোপনকালে কুরাইশদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য মহান আল্লাহপাকের অপার কুদরতে গুহাটির প্রবেশ পথে অলৌকিক উপায়ে.
১) এক মাকড়শা এসে গুহামুখে জাল বিস্তার করে, ও
২) দুইটি বন্য কবুতর এসে গুহামুখে ডিম পারে!
গুহাটির প্রবেশ পথ ‘মাকড়শার জাল বিস্তার ও দুইটি বন্য কবুতরের ডিম পারা’অবস্থায় দেখে কুরাইশরা বিভ্রান্ত হন এই ভেবে যে, সেই গুহায় কোনোভাবেই কোনো মানুষের লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই তাঁরা সেই গুহার মুখে এসেও তা খানাতল্লাশ না করেই ফিরে যায়! এমন অলৌকিক কিচ্ছা আরব্য উপন্যাসের গল্পের চেয়ে কোনো অংশেই কম “উদ্ভট ও বিচিত্র” নয়! [3]
>>> আজ আমরা নিশ্চিতরূপে জানি “যেখানেই সাধু-বাবার অলৌকিকত্বের প্রচার” সেখানেই নিশ্চিত শুভংকরের ফাঁকি।সত্য হলো: কুরাইশরা শুধু মুহাম্মদ-অনুসারীদেরই নয়, “মুহাম্মদ”কেও বিতাড়িত করেননি। ধর্মরক্ষার খাতিরে মুহাম্মদ মদিনায় স্বেচ্ছানির্বাসনে বাধ্য হয়েছিলেন।
“তাঁদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে!”
মুহাম্মদ বিন ইশাক ও আল-তাবারীর বিশালায়তন গবেষণালব্ধ মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থের পর্যালোচনায় যে সত্যটি স্পষ্ট, তা হলো – “মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়ার কিচ্ছার”মতই “তাঁদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে” মুহাম্মদের এই দাবিরও আদৌ কোনো সত্যতা নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো “আইয়্যামে জাহিলিয়াত পর্বে”।
সংক্ষেপে:
মুহাম্মদের অসহনশীল, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক মতবাদের বিরুদ্ধে কুরাইশরা কঠোর জনমত ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁদের সেই প্রচেষ্টায় তাঁদের যে পরিবার সদস্য, প্রিয়জন ও বন্ধু-বান্ধবরা মুহাম্মদের মতবাদে একদা দীক্ষিত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আবার তাঁদের পূর্বধর্মে ফিরে আসেন। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মুহাম্মদ তাঁর ধর্মরক্ষার খাতিরে নিজ স্বার্থে নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে (৬১৫ সাল) তাঁর অনুসারীদের তাঁদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার আদেশ জারি করেন।
মোট ৮২ জন (মতান্তরে ১১ জন) প্রাপ্তবয়স্ক মুহাম্মদ-অনুসারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁদেরকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের বর্ণনায় আমরা আরও জানতে পারি যে, কুরাইশরা তাঁদের এই ধর্মান্তরিত আত্মীয়স্বজনদের “আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন”। যদি কুরাইশরা তাঁদেরকে বহিষ্কারই করে থাকেন, তাহলে তাঁরা তাঁদেরকে পুনরায় মক্কায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কেন করবেন?
এদিকে মুহাম্মদ তাঁর গোত্রপ্রধান ও অভিভাবক বৃদ্ধ, অসুস্থ ও শয্যাগ্রস্ত চাচা আবু তালিব মারফত কুরাইশদের “একটি মাত্র দাবি” (মুহাম্মদ যেন তাঁদের পূজনীয় দেব-দেবী ও পূর্বপুরুষদের কোনোরূপ অসম্মান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে) বারংবার প্রত্যাখ্যান করেন। মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, কুরাইশরা তাঁদের এই একটি মাত্র দাবিতে কমপক্ষে দুই বার আবু তালিবের সাথে “আনুষ্ঠানিক বৈঠক” করেছিলেন।
মুহাম্মদ কুরাইশ ও চাচা আবু তালিবের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে “তাঁর আল্লাহর নামে” কুরাইশদের পূজনীয় দেব-দেবী, পূর্বপুরুষ ও কুরাইশ জনপদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, শাপ-অভিশাপ, ঘৃণা ও অবমাননার প্রচার চালিয়ে যান। দীর্ঘ সাতটি বছর মুহাম্মদের যাবতীয় অবমাননা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, শাপ-অভিশাপ সহ্য করার পর বাধ্য হয়ে কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক হাশেমী গোত্রের বিরুদ্ধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কটের আশ্রয় নেন (৬১৬-৬১৯)।
মুহাম্মদকে বারংবার অনুরোধ/সাবধান ও তাঁর গোত্রপ্রধান ও অভিভাবক আবু তালিবের কাছে অভিযোগ ও বিহিতের নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার পর এটিই ছিল মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সংঘবদ্ধ “সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ” কঠিন পদক্ষেপ।
যে সমস্ত ইসলাম-বিশ্বাসী ও ইসলামে অবিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ কুরাইশদের “এই একটি মাত্র অহিংস পদক্ষেপ” গ্রহণ করাকে বর্বর ও অমানুষিক বলে সমালোচনা করেন, তাঁদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় যে, কুরাইশরা এর চেয়ে অধিকতর মানবিক অন্য কী পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন, তখন তাঁরা “ত্যানা প্যাঁচানো” শুরু করেন।
যাহোক, স্বাভাবিকভাবেই এই বয়কটের ফলে মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক হাশেমী গোত্র চরম দুরবস্থায় পড়েন। এই দুরবস্থা থকে পরিত্রাণের আশায় মুহাম্মদ কুরাইশদের সাথে সন্ধিস্থাপনের উপায় বের করেন। তিনি বরাবরের মতই তাঁর আল্লাহর নামে “এক ওহী বার্তা” আনয়ন করেন।
যে ওহী বার্তায় তিনি কুরাইশদের তিন দেবী লাত, মানত ও উজ্জাকে সম্মানিত করেন।
সেই বিখ্যাত ওহী বার্তাটি হলো সুরা আন-নজম এর ১৯ ও ২০ নম্বর (৫৩:১৯-২০) আয়াতের পর এবং ২১ নম্বর আয়াতের আগে:
৫৩:১৯-২০ – “তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওযযা সম্পর্কে। এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?
এরাই হলো সমুচ্চ যাদের মধ্যস্থতা অনুমোদিত।”
[53:19-20 – “Have you thought of al-Lat and al-Uzza and Manat the third, the other?
These are the exalted Gharanik whose intercession is approved.”]
মুহাম্মদের এই আচরণে কুরাইশরা স্বস্তি ফিরে পান এই ভেবে যে, মুহাম্মদ তাঁদের পবিত্র পূজনীয় দেব-দেবীদের আর কোনো অসম্মান করবেন না। দীর্ঘ নয় বছর (৬১০-৬১৯ সাল) তাঁদের দেব-দেবী ও পূর্ব-পুরুষদের যথেচ্ছ অবমাননা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার পর মুহাম্মদের এই সংযত আচরণের জন্য তাঁরা মুহাম্মদকে অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানান।
কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মুহম্মদ অতি দ্রুতই উপলব্ধি করেন যে, তিনি উক্ত উদ্ধৃতির মাধ্যমে তাঁর “নবী জীবনের যবনিকা” ঘটিয়েছেন।
সুদীর্ঘ নয়টি বছর “কুরাইশদের দেব-দেবীদের মিথ্যা” আখ্যা দেয়ার পর কুরাইশদের বয়কটের কারণে নত হয়ে কুরাইশদের “সেই দেব-দেবীদেরই প্রশংসা” করার অর্থই হলো – তাঁর গত নয়টি বছরের প্রচারণা ছিল মিথ্যা। যার সরল অর্থ হলো, “মুহাম্মদ কোনো নবী নয়, তিনি ভণ্ড – যে-আখ্যা কুরাইশরা সঙ্গত কারণেই মুহাম্মদর ওপর আরোপ করে এসেছেন সেই শুরু থেকেই (পর্ব ১৭-১৯)।”
এই যাঁতাকল পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টায় মুহাম্মদ ঘোষণা দেন যে, লাত, মানত ও উজ্জাকে সম্মান দেখিয়ে যে-বাণীটি তিনি উদ্ধৃত করেছেন, “সেই বাণীটি আসলে আল্লাহর নয়, শয়তানের।” শয়তান তাঁকে বিভ্রান্ত করে তাঁর মুখ দিয়ে এই বাণীটি উদ্ধৃত করিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে যা “শয়তানের বাণী/আয়াত (The Satanic Verses)” নামে বিখ্যাত।
অন্যদিকে আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাম্মদ অনুসারীরা এই ঘটনাটির “প্রথম অংশ” দূত মারফত জানতে পারেন। তাঁরা এই মর্মে খবর পান যে, কুরাইশরা মুহাম্মদের মতবাদ মেনে নিয়ে তাঁকে নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছে। এই খবরটি পাওয়ার পর ৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাম্মদ-অনুসারীর ৩৩ জনই ফিরে আসেন মক্কায়।মক্কার অদূরে আসার পর তাঁরা জানতে পারেন যে, তাঁদের জানা এই খবরটি সত্য নয়। কিন্তু তাঁরা আর আবিসিনিয়ায় ফিরে যাননি।
প্রশ্ন হলো,
কুরাইশরা কি এই আবিসিনিয়া-ফেরত মুহাম্মদ-অনুসারীদের ওপর কোনোরূপ শারীরিক অথবা মানসিক অত্যাচার চালিয়েছিলেন?
উত্তর: অবশ্যই নয়!
কুরাইশরা শুধু যে তাঁদের ওপর কোনোরূপ শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করেননি তাইই নয়, এই কুরাইশরাই তাঁদের নিরাপত্তার (Protection) ব্যবস্থা করেছিলেন। এই আবিসিনিয়া ফেরত মুসলমানেরা বহাল তবিয়তে অনেকগুলো বছর নিশ্চিন্তে মক্কায় বসবাস করেছিলেন। তারপর,
১) তাঁদের কিছু লোক এই ঘটনার সুদীর্ঘ তিন বছর পর (৬২২ সাল) মুহাম্মদের আদেশে মদিনায় হিজরত করেন এবং কুরাইশদের বিরুদ্ধে বদর ও ওহুদ যুদ্ধসহ যাবতীয় আক্রমণাত্মক নৃশংস কর্মকাণ্ডে অংশ নেন;
২) কিছু লোক পাঁচ বছরেরও বেশি পর বদর যুদ্ধের (৬২৪ সাল) পরে মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ ও অন্যান্য মুহাম্মদ অনুসারীদের সাথে মিলিত হন, এবং
৩) অবশিষ্টরা মক্কাতেই মৃত্যুবরণ করেন। [4] [5]
>>> যে প্রশ্নটি নিরপেক্ষ পাঠকবৃন্দ ও মুক্তচিন্তার মানুষ সচরাচর করে থাকেন, তা হলো এই “মক্কায় নব্য মুসলমানদের উপর কুরাইশদের সংঘবদ্ধ অকথ্য অত্যাচারের উপাখ্যান” ইসলাম-বিশ্বাসীরা গত ১৪০০ বছর ধরে উচ্চস্বরে প্রচার করে আসছেন তার কী কোনোই ভিত্তি নেই?
ইসলামের ইতিহাসের নিবেদিতপ্রাণ আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই লিখিত বর্ণনার আলোকে এই প্রশ্নের অতি সংক্ষেপ জবাব হলো,
“না! নেই। তাঁদের এই দাবীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই!”
আদি উৎসের বর্ণনায় এ বিষয়ে যে ঘটনাগুলোর উপাখ্যান উদ্ধৃত আছে, তা হলো:
১) পারিবারিক দ্বন্দ্ব:
কুরাইশরা মুহাম্মদের অসহনশীল, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক মতবাদের বিরুদ্ধে কঠোর জনমত ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাঁদের ধর্মান্তরিত পরিবার সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের বিভিন্ন কলা-কৌশলের মাধ্যমে পূর্বধর্মে ফিরিয়ে আনার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
“তাঁদের পরিবারের কোও সদস্য” মুহাম্মদের অনুসারী হলে সেই নব্য মুসলমানের অভিভাবক ও পরিবার সদস্যরা তাকে বিভিন্নভাবে পূর্বধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কোনো কোনো সময় পরিবারের অভিভাবক ও সদস্যরা তাঁদের পরিবারের এই ধর্মান্তরিত সদস্যদের ওপর শারীরিক ও মানসিক বলপ্রয়োগও করতেন। এই ঘটনাগুলো ছিল “একান্তই পারিবারিক বিষয়”।পরিকল্পিত ভাবে কুরাইশরা ইসলাম-বিশ্বাসীদের ঢালাও নির্যাতন করতেন, এমন কোনো ইতিহাস আদি উৎসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই শ্রেণীভুক্ত ঘটনার একটি উদাহরণ, যা জগতের প্রায় সকল ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতদের অতি পরিচিত, বহুল আলোচিত ও প্রচারিত তা হলো:
“ওমর (রাঃ) যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর বোন ও বোনের স্বামী ইসলাম গ্রহণ করেছে, তখন ওমর তাদের বাসায় গিয়ে তার বোনকে মারধর করেছিলেন।” [6]
>>> ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কারণে ক্রোধান্বিত হয়ে ভাই পৌত্তলিক ওমর মারধর করেছিলেন তার নব্য মুসলিম বোনকে। অনাত্মীয় কোনো কুরাইশ একক বা সংঘবদ্ধ হয়ে “ওমরের বোন”কে মারধর করতে যাননি।
২) মালিক-দাস দ্বন্দ্ব:
মুহাম্মদের অসহনশীল মতবাদে সাড়া দিয়ে দাসরা মালিকদের অবাধ্য হতো (“You are the one who corrupted him–”)। এতে মালিকরা হতেন আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত দাস মালিকরা এই অবাধ্য দাসদের বশে আনার জন্য শারীরিক শাস্তি প্রদান করতেন বলে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার যৎসামান্য বর্ণনা মুহাম্মদ ইবনে ইশাক লিপিবদ্ধ করেছেন।
এই শ্রেণীভুক্ত ঘটনার দু’টি উদাহরণ, যা জগতের প্রায় সকল ইসলাম-বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতদের মুখস্ত, বহুল আলোচিত ও প্রচারিত তা হলো:
ক) উমাইয়া বিন খালফ তার ক্রীতদাস হযরত বেলাল (রাঃ) কে মরুভুলমির মধ্যে নিয়ে গিয়ে উত্তপ্ত বালির ওপর শুইয়ে রাখতেন।
“একদা আবু বকর বেলালের এহেন দুরবস্থা দেখতে পেয়ে উমাইয়া বিন খালফকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন তুমি বেচারাকে শাস্তি দিচ্ছ?’
জবাবে উমাইয়া বললেন, ‘তুমিই সেই লোকদের একজন যে একে কলুষিত করেছে, তাই পারলে এই দুরবস্থা থেকে তাকে রক্ষা কর (‘You are the one who corrupted him, so save him from his plight that you see’)।” [7]
খ) বনী মাখজুম গোত্রের (আবু জেহেলের গোত্র) লোক ক্রীতদাস আমর বিন ইয়াসার ও তার পিতা-মাতাকে নির্মম অত্যাচার চালায়। [8]
>>> এই ঘটনাগুলো নিঃসন্দেহে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও মালিক-দাস দ্বন্দ্বের উদাহরণ। শুধুমাত্র ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে কুরাইশরা সংঘবদ্ধভাবেনব্য মুসলমানদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার-নিপীড়ন করতেন, এমন উদাহরণ আদি উৎসের নিবেদিতপ্রাণ মুহাম্মদ-অনুসারীদের বর্ণনায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
(চলবে)
[কুরানের উদ্ধৃতিগুলো সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ (হেরেম শরীফের খাদেম) কর্তৃক বিতরণকৃত বাংলা তরজমা থেকে নেয়া; অনুবাদে ত্রুটি-বিচ্যুতির দায় অনুবাদকারীর। কুরানের ছয়জন বিশিষ্ট অনুবাদকারীর পাশাপাশি অনুবাদ এখানে।]
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[1] “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ২২১-২২৫ http://www.justislam.co.uk/images/Ibn%20Ishaq%20-%20Sirat%20Rasul%20Allah.pdf
[2] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৬, ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৮, ISBN 0-88706-706-9 [ISBN 0-88706-707-7 (pbk)], পৃষ্ঠা (Leiden)- ১২৩২-১২৩৪
[3] মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (৭৮৪-৮৪৫) লেখক: “কিতাব আল-তাবাকাত আল-কাবির”
অনুবাদ – এস মইনুল হক, প্রকাশক- কিতাব ভবন, নয়া দিল্লি, সাল ২০০৯ (3rd Reprint).
ISBN 81-7151-127-9 (set). ভলুউম ১,পৃষ্ঠা ২৬৪-২৬৬
[4] Ibid ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৮
[5] Ibid আল-তাবারী, পৃষ্ঠা (Leiden) ১১৯৫-১১৯৬
[6] Ibid ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ১৫৬
[7] Ibid ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ১৪৪
[8] Ibid ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ১৪৫
Leave a Reply