স্রষ্টার খোঁজে
লিখেছেন : মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ
একসময় ভীষণ উদগীব হয়ে আমি আমার সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতাম। জন্মের পর থেকেই আমার চারিদিকে মোল্লা, চারিপাশে মোল্লা এবং আল্লাহ ছিল। খুব শিশুকালে যে আল্লাহকে চিনতাম সে আল্লাহ বড়ই দয়ালু, কিন্তু যত বড় হতে লাগলাম ততই নিষ্ঠুর এক আল্লাহকে চিনতে থাকলাম। এত ঘৃণা, এত হিংসা, এত জিঘাংসা, এত নিষ্ঠুরতা সৃষ্টিকর্তার মধ্যে থাকে কিভাবে? তখন আমি আমার মায়ের সাথে – যিনি আমার জন্মদাতা – সৃষ্টিকর্তার তুলনা খুঁজতে গেলাম। দেখতে পেলাম, আমার মায়ের মনের মধ্যে যে পরিমাণ দয়া, মমতা ও ভালোবাসা রয়েছে ইসলামের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মধ্যে তার ১০০ ভাগের এক ভাগ দয়া, মমতা ও ভালোবাসা নেই। সুতরাং আমি নতুন স্রষ্টার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। যেহেতু আমার জীবনটা ছিল মোল্লাময় – চারিদিকে ছিল মোল্লার বসবাস, আত্মীয়-স্বজনরা মোল্লা, দুনিয়ার চারিদিকে মোল্লা (আর মোল্লা ছাড়া যাদের চোখে পড়েছিল তাদের দেখেছি কেবল টিভির পর্দায়) সুতরাং আমি ইসলামের মধ্যেই ভালো আল্লাহর খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। একসময় ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দিলাম। সেটি ১৯৯৯ সালের কথা। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র হয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়াটা মাদ্রাসার হুজুরদের দৃষ্টিতে পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর অপরাধের মধ্যে একটি! আমার ক্লাসমেট মাসুদুর রহমান এবং নাসরুল্লাহ আমার বিরুদ্ধে মাওলানা আব্দুল হামিদের (আমার শিক্ষক) কাছে নালিশ করল। আমার বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হলো, কিন্তু শেষমেষ মেধাবী ও চরিত্রবান ছেলে হওয়ার কারণে এবং নবীপুর মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে হওয়ার কারণে সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম। ছাত্রশিবির করতে পারব না এই শর্তে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার হওয়া থেকে এবং শিক্ষকদের শাস্তি থেকে বেঁচেছি। তারপর একটু দয়ালু একজন ঈশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। আর নিজেকে বুঝ দিতে লাগলাম, ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার আল্লাহ হচ্ছেন সবচেয়ে দয়ালু, আমার শিক্ষকেরা যারা ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার আল্লাহর অনুসারী তারা সবচেয়ে ভালো মানুষ। কিন্তু জোর করে আর নিজেকে কতদিন বুঝ দেওয়া যায় বলুন? আমার শিক্ষকদের যে চরিত্র চোখ দিয়ে দেখেছি তাতে তাদেরকে মানুষ ভাবতেই ঘৃণা হতো। এরপর মনে হলো সালাফিদের আল্লাহ একটু দয়ালু। ভিড়ে গেলাম সালাফিদের দলে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার হুজুরদের কাছে সালাফি হওয়াটাও ভয়ংকর এক অপরাধ! সুতরাং এবারও আমি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হলাম, তবে ততদিনে লেখাপড়া শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে একটু উতরে গেলাম। যোগাযোগ হলো সৌদি আরব ভিত্তিক ইসলাম প্রচারকারী এনজিও সংস্থা আল ফোরকান ফাউন্ডেশনের সাথে। আল ফোরকান ফাউন্ডেশনের অধীনে বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪০০ টি মসজিদের একটির ইমাম হলাম আমি। এই সংস্থাটি সম্পূর্ণভাবে সৌদি আরবের বিভিন্ন ইসলামপন্থী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় পরিচালিত। সংস্থার প্রধান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান পড়াশোনা করেছেন বুয়েটে, এরপর তাবলীগের মাধ্যমে তিনি প্রথমে ইসলামপন্থী হলেন। বেশ কিছুদিন তাবলীগ করতে করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ইসলামের আরো গভীর বিষয়ে। চলে যান সৌদি আরবে। সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং সৌদি আরবের মূলধারার ইসলামপন্থী অর্থাৎ সালাফিদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এখানে উল্লেখ্য, সৌদি আরবের রাজপরিবার, সৌদির ইসলামিক উচ্চতর গবেষণা পরিষদ, সেখানকার মক্কা ও মদিনা সহ অন্যান্য মসজিদের ইমামগণ সবাই সালাফি ইসলামের অনুসারী। ইতোমধ্যেই জামায়াতের প্রতি আমার আগ্রহ তলানিতে ঠেকেছে, কারণ তাদের মধ্যে আমি যে আল্লাহকে খুঁজেছি সেই আল্লাহকে পাইনি। তাঁরাও সেই বর্বরতার কথাই বলে যা আমি পড়েছি কোরআনে, হাদিসে এবং সিরাতের গ্রন্থে। মধ্যপন্থী সালাফি বা সালাফি সমর্থক গোষ্ঠী আল ফোরকান ফাউন্ডেশনে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে আমি আবারো আশাহত হই। যে সালাফি ইসলামকে আমি একটু উদার বা একটু লিবারেল মনে করেছিলাম সেই সালাফি ইসলামও যে ভারতের দেওবন্দী হানাফি ইসলামের চেয়ে কোন অংশে কম না! তাহলে কোথাও কি আমি একটু দয়ালু ও প্রেমময় আল্লাহকে পাবো না?
নতুন কোনো আল্লাহর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম – হোক সেই আল্লাহ কোন ছোট্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। ২০০৭ সালে জাকির নায়েককে দেখে ভালো লাগল। আমি মাদ্রাসার ছাত্র থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দেখেছি, একজন কওমি মাদ্রাসার ছাত্র বা মসজিদের ইমাম হিসেবে কেবলমাত্র প্যান্ট-শার্ট পরাই হতে পারে আমার জন্য পৃথিবীর ভয়ংকরতম অপরাধ; যে অপরাধ করামাত্রই আমার সমাজের প্যান্ট-শার্ট পরা লিবারেল মুসলিমরা আমার উপরে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে! আর আমার জন্য দাড়ি কাটার ব্যাপারটা বাংলাদেশের ক্লিনশেভড মডারেট মুসলিমদের দৃষ্টিতে এডলফ হিটলারের হলোকাস্টের চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধ! পোশাকের ব্যাপারে জাকির নায়েক উদার। তিনি প্যান্ট-শার্ট ও কোট-টাই পরে ইসলাম প্রচার করেন। প্যান্ট-শার্ট ও কোট-টাই করার কারণে আমার মাদ্রাসার হুজুররা জাকির নায়েককে ‘ইহুদিদের দালাল, আমেরিকার সৃষ্টি’ বলে ফতোয়া দিয়েছিল। বেচারা জাকিরের জন্য মায়া হচ্ছিল! তাঁর অনুষ্ঠানে নারীরাও আমন্ত্রিত হয়। তিনি নারীদের প্রশ্নেরও উত্তর দেন। সুতরাং হয়ে গেলাম জাকির নায়েকের ভক্ত। কিন্তু একি দেখছি? জাকির নায়েক তো তাই-ই যা আমি দেখেছি সালাফিদের মধ্যে, যা দেখেছি দেওবন্দী হানাফিদের মধ্যে! জাকির নায়েকের আল্লাহ তো মোটেই উদার না! সেও তো দেখছি চরম বর্বর, এমনকি ও সা মা বিন লা দে নে রও পক্ষে সে! সুতরাং জাকির নায়েক তিন তালাক।
বাংলাদেশের স্কুলের ৫ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দুধর্ম শিক্ষা বইটা পড়লাম। মনে হতো লাগল, হিন্দু ধর্মের ভগবান একটু বুদ্ধিমান এবং দয়ালু। কিন্তু একি! ভগবানের কথাবার্তা তো দেখছি সব অবাস্তব এবং বিজ্ঞানবিরোধী! সুতরাং ভগবানও তালাক।
একদিন বাসে করে আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে পাশের সিটে উঠলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। সেটা ২০১২ সাল। ভিক্ষুর সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। আমার দাড়ি-টুপি দেখে এবং পরিচয় জানতে পেরে তিনি প্রথমদিকে আলাপ জামাতে চাইলেন না, কিন্তু শেষে আমার আন্তরিকতা দেখে তিনি একটু একটু কথা বলা শুরু করলেন। বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞানদান করলেন। আমি আমার ভিজিটিং কার্ড তাঁকে দিলাম। তাঁর ফোন নাম্বার চাইলাম। তিনি ফোন নাম্বার দিলেন। ওটুকু সময়ে তিনি আমাকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে যা বললেন তাতে আমি মুগ্ধ। এরকম একটি হিংসামুক্ত ধর্মের খোঁজই আমি করেছিলাম। মাঝসমুদ্রে ডুবন্ত একজন মানুষ যদি ছোট্ট একটা কাঠের টুকরা পায় সেটুকুই বা তার জন্য কম কিসের? পরবর্তী সময়ে সেই ভিক্ষুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমি জানিনা তার সিম হারিয়ে গেছিল নাকি তিনি ভয় পেয়েছিলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পোশাক এত ভয়ঙ্কর হতে পারে? আমাদেরকে কি খুবই ভয়ঙ্কর পোশাক পরিয়ে রাখা হয়েছে? অন্য ধর্মের মানুষেরা কি আমার মতো দাড়ি-টুপিওয়ালা হুজুরদের খুবই ভয় পায়? এত ভয়ংকর পোশাক আমার উপরে মডারেট মুসলিমরা চাপিয়ে দিল কেন? কি দোষ ছিল আমার?
অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ এই বাক্য দুটো আমার কাছে খুব পছন্দের ছিল। ২০১২ সাল থেকেই কোরবানির সময়ে গরু কাটাকাটি আমি করতাম না, তবে কর্মক্ষেত্রের বাধ্যবাধকতার কারণে অন্যদেরকে বাধা দিতে পারতাম না, অর্থাৎ আমি যে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলাম সেখানকার অন্যান্য শিক্ষক এবং আমার ছাত্ররা ঠিকই কোরবানির গরু জবাই করত। আমি সেসব কিছুর নেতৃত্বে থাকতে বাধ্য ছিলাম পেশাগত কারণেই। বৌদ্ধধর্ম নিয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করার পর মনে হলো, এটা খুবই অহিংস ঠিক, কিন্তু এটা কেমন যেন কাল্টের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। ব্যক্তিপূজা আমার পছন্দ না। তাছাড়া বৌদ্ধধর্ম এতটাই অহিংস যে, মসজিদ-মাদ্রাসার জেলখানায় দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পরে এত অহিংসা আমার ঠিক পছন্দ হলো না। অন্তত প্রতিরোধের জন্য হলেও একটু যুদ্ধের অনুমতি থাকা উচিত ছিল!
শুরু হলো খ্রিস্টধর্ম নিয়ে পড়াশোনা। এ সময়ে আমি মাদ্রাসার হুজুর এবং মাদ্রাসামনাদের মিথ্যাচার দেখে ক্রমেই অবাক হতে লাগলাম। মাদ্রাসার হুজুররা এবং মাদ্রাসামনস্ক আধুনিক শিক্ষিতরা সবসময় আমাদেরকে বলতেন, খ্রিস্টানরা টাকা দিয়ে দিয়ে মানুষকে খ্রিস্টান বানায়, খ্রিস্টানরা ওদের ধর্ম প্রচার করার জন্য পাগল হয়ে যায়। কিন্তু কই, আমিতো টাকা চাইনি, আমি কেবল খ্রিস্ট সম্পর্কে জানতে চেয়েছি, পড়তে চেয়েছি। তাঁরা তো দেখি আমাকে এড়িয়ে চলছে! আমার মনে হতো লাগল, এ আবার কেমন খ্রিস্টান, একজন ব্যক্তি তাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাইছে, ভালো লাগলে সে তাদের ধর্ম গ্রহণও করবে হয়তো, কিন্তু ওরা কেন এড়িয়ে যাচ্ছে? না, এটা কোন ভালো ধর্ম না। আমি তো ওদের কাছে একটা বইও ফ্রি চাইনি, আমি তাদের মেসেজ করে বলতাম, আমি টাকা দিয়ে বই কিনব, আমি খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য বই চাই এবং আমার মনে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য কোন একজন ফাদারের সাথে কথা বলতে চাই। আমার মনে যে অশান্তি চলছে সেটি থেকে আমি পরিত্রাণ চাই।
ক্যাথলিকদের মধ্যে কেউই এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যেও কেউই আমার মেসেজের জবাব দিল না। আমার মেসেজের জবাব দিল জে ডব্লিউ গ্রুপের কেউ একজন। এটাও খ্রিস্টধর্মেরই একটি বিদ্রোহী শাখা। বিদ্রোহীদের আমার বরাবরই পছন্দ, আর তাই শিশুকাল থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও আমার পছন্দ। সুতরাং যখন জানতে পারলাম জে ডব্লিউ খ্রিস্টধর্মের বিদ্রোহী শাখা তখন তাদেরকে পছন্দ হয়ে গেল। বিশেষ করে পছন্দ হলো যখন জানতে পারলাম, তাঁরা মধ্যযুগের রোমান ক্যাথলিকদের বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং তিন ঈশ্বরের বদলে একেশ্বরবাদের কথা বলছে। ঈশ্বরের সাথে অংশীদার স্থাপন করার (আরবিতে শির্ক) বিরুদ্ধেও তাঁরা কথা বলছে। এতদিন পরে বুঝি আমি ঠিকঠাক একটি ধর্মের সন্ধান পেয়ে গেলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার জন্মের দিন থেকে নিয়ে আমার ৩১ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ইসলাম নামক নিষ্ঠুর ঘৃণার আগুনে পুড়ছিলাম। আমাকে বলা হচ্ছিল তোমার মধ্যে এই ঘৃণা জমা করে রাখতে হবে, আমরা যখন চাইব তখন এই ঘৃণা তোমার কাছ থেকে নেব এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণাটাকে কাজে লাগাবো। জে ডব্লিউয়ের সাথে পরিচিত হবার পর মনে হলো, তাঁরা বৌদ্ধ এবং অন্যান্য খ্রিষ্টানদের চেয়ে ভালো। তাঁরা আমাকে বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। সৌদি আরবের মধ্যপন্থী সালাফি সংস্থা আল ফোরকান ফাউন্ডেশন (যেটায় আমি চাকরি করতাম) যদি লাখ লাখ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারে, বিভিন্ন দেওবন্দী অর্থাৎ কওমি মাদ্রাসার হুজুররা যদি বিনামূল্যে লাখ লাখ কপি বই বিতরণ করতে পারে, জামায়াতে ইসলামী এবং চরমোনাই পীর সহ অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামিক গ্রুপ যদি কোটি কোটি কপি ইসলামিক বই বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারে তাহলে খ্রিস্টানদের একটি বিদ্রোহী শাখা তারা একজন আগ্রহী ব্যক্তিকে বই দিলে সেটির দোষের কেন হবে?
যে ধর্ম অস্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে, যে ধর্ম এক গালে চড় দিলে অন্য গাল পেতে দিতে বলে, যে ধর্ম অস্ত্র নির্মাণ করে বা অস্ত্র নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন যেকোন রকমের প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করে সেটি বেশ চমৎকার ধর্মই হবে! এই যে কখনো আমি শিবির কর্মী, কখনো সালাফী, কখনো হানাফী, কখনো জাকির নায়েকী, কখনো বুদ্ধের অনুসারী, কখনোবা যীশুর ভক্ত হয়েছি কিন্তু সবসময়ই মনের মধ্যে একটি বিষয় খচখচ করত। এই যে ঈশ্বর সম্পর্কে সবাই বলছে বা কোন একজন ব্যক্তির অত্যাধিক ক্ষমতা সম্পর্কে বলছে এটাতো বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না। তাছাড়া এই যে জে ডব্লিউকে আমি ২০১৪ সাল থেকে পছন্দ করা শুরু করেছি তাঁরাও তো সেই আদম হাওয়ার গল্প, মুছার গল্প, নূহের গল্প বলছে যে গল্পগুলো অলরেডি কোরআনে লেখা আছে! কুরআনের গল্পগুলো যদি আমার আমি অবাস্তব মনে করি তবে একই গল্প বাইবেলে লেখা থাকলে সেটাই কেন বা অবাস্তব মনে হবে না? আমি কওমি মাদ্রাসায় বিজ্ঞান পড়িনি, মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানের বই নেই, কিন্তু আমি তো বাংলাদেশের স্কুলের বইগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে নিজের আগ্রহ থেকে অনেক বিজ্ঞান পড়েছি। সেসব বিজ্ঞানের বইয়ে যা পড়েছি সেগুলোকে সত্য মেনে নিলে মোহাম্মদের কথা, যীশুর কথা, বুদ্ধের কথা, হিন্দুদের ভগবানের কথা কোনটাকেই সঠিক মেনে নেয়া যায় না। এরই মধ্যে দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারলাম (যারা বাংলাদেশি নাস্তিক কিন্তু ইউরোপে থাকার সুবাদে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে ভালো জানতেন) যে, জে ডব্লিউয়ের ধর্মবিশ্বাসেও কিছু সমস্যা আছে যা জে ডব্লিউয়ের সদস্যরা যখন আমাকে তাদের ধর্মের দাওয়াত দিচ্ছিল তখন বলেনি। প্রত্যেক ধর্মীয় দলের লোকেরা এবং রাজনৈতিক দলের লোকেরা তাদের অন্ধকার দিকগুলো ঢেকে রেখে ভালো কথাগুলো মানুষকে শোনায়। একইভাবে প্রত্যেক পণ্য বিক্রেতাও তার পণ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো লুকিয়ে রেখে উপকারের দিকগুলো তুলে ধরে। একমাত্র সিগারেট কোম্পানিগুলোই ধূমপানের ক্ষতির কথা সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লিখে দেয়। যদি মসজিদের দেয়ালে লেখা থাকত ইসলাম ক্ষতির কারণ, যদি মন্দিরের দেয়ালে লেখা থাকত হিন্দুধর্ম ক্ষতির কারণ, যদি চার্চের দেয়ালে লেখা থাকত খ্রিস্টধর্ম ক্ষতির কারণ তবে ব্যাপারটা কতই না সুন্দর হতো!
দ্বৈত সত্তা নিয়ে বসবাস করা বড্ড কঠিন। প্রথম যেদিন মোহাম্মদের উরাইনা গোত্রের লোকদের উপরে চালিত বর্বর, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মাদ্রাসার বইয়ে পড়লাম সেদিনই আমি ইসলাম নামক সন্ত্রাস থেকে বেরিয়ে গেছি। এরপরে কত বছর হয়ে গেছে আমি বসবাস করেছি দ্বৈত সত্তায়! পেট এবং প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমি একদিকে মিথ্যুক, বর্বর, ধোঁকাবাজ মোহাম্মদের অনুসারী হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আর অন্যদিকে বিবেকের তাড়নায় আমি ইসলাম পরিত্যাগকারী একজন অহিংস মানুষ। একই ব্যক্তি হিংসা এবং অহিংসা দুটোকেই বহন করতে পারেনা। একই ব্যক্তি নিষ্ঠুরতা এবং দয়া দুটোকে একসাথে বহন করতে পারে না। ইসলামের আল্লাহ যখন বলেন, তিনি গাফুরুর রহিম অর্থাৎ তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু আবার তিনিই যখন বলেন তিনি শাদিদুল ইকাব এবং যু-ইনতিকাম অর্থাৎ তিনি কঠিন শাস্তিদাতা ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী তখন ব্যাপারটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়েছে। কারণ, আমিও আল্লাহর মতই একদিকে বর্বর মোহাম্মদের অনুসারী ধর্মব্যবসায়ী হুজুর আর অন্যদিকে মনের মধ্যে থাকা অহিংস একজন মানুষ এই দুই চরিত্রই ধারণ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। শেষমেশ আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, পরস্পরবিরোধী দুটি চরিত্র একই সত্তার মধ্যে ধারণ করা অসম্ভব। সুতরাং আল্লাহ দয়ালু এবং ক্ষমাশীল অথবা তিনি কঠিন শাস্তিদাতা ও প্রতিশোধপরায়ন এই দুটোর যেকোনো একটা সত্যি। একসাথে দুটোই সত্যি হতে পারে না। যখন বুঝেছি তখন অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিয়ে করেছি। দুই সন্তানের বাবা হয়েছি। দীর্ঘ ১২ বছর ইমামতি করে ফেলেছি। এখন উপায় কি? মুক্তি কি আদৌ সম্ভব?
একটা মানুষ কয়বার পাল্টে যেতে পারে জানিনা। তবে আমি অনেকবার পাল্টেছি। এই পাল্টে যাওয়াটাকে আপনি ‘পল্টি’ বললে আপনাকে আমি জ্ঞানপাপী বলতে একটুও দ্বিধা করব না। কোন একসময় ছাত্রশিবিরের পক্ষে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছি, কোন একসময় সালাফিদের দলে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছি, কোন একসময় দেওবন্দী আল্লাহ তথা কওমি মাদ্রাসার পক্ষে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছি। কখনো জাকির নায়েকের পক্ষে, কখনো সুফিবাদের পক্ষে, কখনো তাবলীগের পক্ষে, এমনকি কোন একসময় জে ডব্লিউয়ের পক্ষেও কয়েজনকে অনলাইনে দাওয়াত দিয়েছিলাম। আজ সেসব মনে পড়লে হাসি পায়। শুধু হাসি পায় না, অনেক সময় কষ্টও হয়। একজন মানুষকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া সেটি মানুষটার জন্য লঘু শাস্তি। তবে এটা একটা তুলনার বিচারে বলছি। একজন মানুষের মধ্যে ঘৃণা এবং হিংসা জমা রাখা বা ঘৃণা এবং হিংসা নিজের মধ্যে জমা রাখতে বাধ্য করা এটি একজন ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুদণ্ড দেয়ার শামিল। এখন তো আমার মনে হয়, যতদিন পর্যন্ত আমাকে মাদ্রাসা-মসজিদের কারাগারে বন্দি রেখে আমার মধ্যে ঘৃণা এবং হিংসা জমা রাখতে বাধ্য করেছিল মডারেট মুসলিমরা সেই সময়কার প্রতিটি দিনই ছিল আমার জন্য একেকটি ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দিন’।
এই যে হুজুররা আল্লাহ আল্লাহ করে আমি সেই আল্লাহ নামক স্রষ্টাকে দীর্ঘদিন খুঁজেছি। খুব আন্তরিকতার সহিত খুঁজেছি। এবং এ কথা সত্যি, আমি হুজুরদের আল্লাহর সন্ধান পেয়েছি। আল্লাহ নিজে নাস্তিক কিন্তু অন্যদেরকে তিনি আস্তিক বানান। আল্লাহ নিজে খুল্লামখুল্লা কিন্তু হুজুরদের জন্য তিনি সৃষ্টিশীল সবকিছু হারাম বানিয়ে রাখেন। আল্লাহ নিজে প্যান্ট-শার্ট পরেন কিন্তু হুজুরদের জন্য প্যান্ট-শার্ট হারাম করে রাখেন। আল্লাহ নিজে মদ, গাঁজা, সিগারেট, শুকরের মাংস সবই খান কিন্তু হুজুরদের জন্য এর সবকিছুই হারাম বানিয়ে রাখেন। আল্লাহর ডাবল স্টান্ডার্ড থাকে।
আমি দেখতে পাই, হুজুরদের যারা সৃষ্টি করেছে, হুজুরদের যারা মাদ্রাসায় পুষেছে এবং হুজুরদের মধ্যে যারা তাদের মধ্যেকার ব্যবসায়িক স্বার্থগত ঘৃণা ও ক্ষমতার রেষারেষির ঘৃণা জমা রেখেছে এবং হুজুরদের কাছে জমা রাখা ঘৃণা তুলে খরচ করেছে বা হুজুরদেরকে উস্কানি দিয়ে মাঠে নামিয়েছে তাঁরাই আল্লাহ। আমার শিক্ষকেরা, আমার ক্লাসমেটরা ওই আল্লাহদের পক্ষ নিয়ে রাস্তাঘাটে জি ha দ করতে নেমে মানুষ খুন করেছে এবং নিজেরাও খুন হয়েছে।
কয়েকদিন আগে দেখলাম ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলের একজন আল্লাহ যিনি ক্রিকেট খেলে পয়সা রোজগার করেন, ইসলামে চরমভাবে নিষিদ্ধ ছবি তোলা সেই ছবিও তিনি তোলেন, ভিডিওতেও অংশগ্রহণ করেন আবার তিনিই শ্যাম্পেইনের উৎসব বর্জন করেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটদলীয় আরেকজন আল্লাহ আছেন তিনি আবার ক্রিকেটের মতো হারাম খেলা খেলে জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি দাড়িটুপিও পরেন না কিন্তু প্রত্যেক দুটি বাক্যের একটিতেই তিনি সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ তথা আরবি বাক্য বলতে ছাড়েন না। তিনি বাঘের ছবি ঢেকে রেখে নিজের ইসলাম জাহির করেন, অথচ ইসলামে যদি বাঘের ছবি হারাম হয় তবে তাঁর নিজের ছবি তুলে আপলোড করাটাও হারাম তা তিনিও জানেন। কারণ, ইসলামে শুধুমাত্র বাঘ, গরু বা ছাগলই না, বরং যেকোন প্রাণীর ছবি তোলাই নিষিদ্ধ। সেই প্রাণীর সংজ্ঞায় মানুষও অন্তর্ভুক্ত।
ইরানের নারীঘাতক খোমেনীতন্ত্র যার দয়ার টিকে আছে তাঁকে আমি ইরানের আল্লাহ বলে মানি। কার দয়ায় সেটা বুঝতেই পারছেন। সৌদি আরবের ব র্ব র সালাফি রাজপরিবার যাদের দয়ায় টিকে আছে তাদেরকে আমি সালাফিদের আল্লাহ বলি। বুঝতেই পারছেন কাদের দয়ায় সৌদি আরবের সালাফি রাজপরিবার টিকে আছে। পাকিস্তানের গণ হ ত্যা কা রী শাসকগোষ্ঠী যে রাষ্ট্রের দয়ায় টিকে আছে সেই রাষ্ট্রের অধিনায়কদের আমি পাকিস্তানের আল্লাহ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। বাংলাদেশের যে সমস্ত মুসলমানেরা মদের সাথে হালাল মাংস খোঁজে, বাংলাদেশের যে সমস্ত মুসলমানেরা নিজেদের ছবি তোলে কিন্তু বাঘের ছবি ঢেকে রাখে, বাংলাদেশের যে সমস্ত মুসলমানরা সিনেমায় অভিনয় করে কিন্তু কথায় কথায় সুবহানাল্লাহ-আলহামদুলিল্লাহ বলে, বাংলাদেশের যে সমস্ত রাজনীতিবিদেরা দেশটা ভারত দখল করে নিল এবং ইসরাইল ষড়যন্ত্র করছে বলে থিওরি দেয় কিন্তু নিজেরা নিয়মিত মদ্যপান করে; এবং বাংলাদেশের যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা মানুষ খুন করার পরে মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের খাওয়ায় এরা সকলেই বাংলাদেশের হুজুরদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আমি মাদ্রাসার হুজুরদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে চিনে গেছি। আমি ইরানের আল্লাহকে, সৌদি আরবের আল্লাহকে, পাকিস্তানের আল্লাহকে এবং ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার আল্লাহকে চিনে ফেলেছি।
আমি কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমি একথা বিশ্বাস করি যে, মাদ্রাসার হুজুরদের ঈশ্বর আছে। মাদ্রাসার হুজুরদের ঈশ্বরেরা ক্রিকেট দলে, রাজনৈতিক দলে, ব্যবসায়ীদের দলে, অভিনেতাদের দলে এবং যুদ্ধবাজ স্বৈরশাসকদের দলে রয়েছে। মাদ্রাসার অনেক হুজুরই নাস্তিক, কিন্তু কেন তারা ইসলাম ত্যাগ করার ঘোষণা দিতে পারছে না আশা করি তার জবাব পেয়ে গেছেন।
ছবি : আল ফোরকান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ মুজিবুর রহমান (প্রয়াত)

Leave a Reply