(প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি থাকলেই কাউকেই শিক্ষিত বলা কি উচিত, যদি সে মুক্তচিন্তা করতে না পারে? কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করাটাই কি শিক্ষিত হবার পরিচায়ক? বিশ্বাস ভেঙে যাবে বলে প্রশ্ন করতে ভীত হলে শিক্ষিত ব্যক্তিকে সুশিক্ষিত বলা যাবে?
আরজ আলী মাতুব্বর। জন্ম ১৯০১, মৃত্যু ১৯৮৬ সালে। গ্রাম্য কৃষক। স্কুল-কলেজের ডিগ্রি তাঁর ছিলো না। পড়েছেন (তাঁর ভাষায়) “সেকালের পাঠশালার দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত।” কৃষিকাজের অবসরে নিজ উৎসাহে ও উদ্যোগে পড়াশোনা করেছেন দূর শহরের লাইব্রেরিতে পায়ে হেঁটে গিয়ে। তিনি স্ব-শিক্ষিত এবং সুশিক্ষিতও। তিনি কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন বলে মুক্তচিন্তা করতে পারতেন। ধর্মীয় রীতিনীতি ও কুসংস্কার বিষয়ে যতো প্রশ্ন এসেছে তাঁর যুক্তিমনস্ক মস্তিষ্কে, তিনি সেসবের উত্তর খুঁজেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, প্রচ্ছন্ন সরস কটাক্ষ করেছেন। ডিগ্রিধারী ক’জন শিক্ষিত লোক তা করে থাকে?
তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান ও নিজস্ব অনুসন্ধিৎসু বুদ্ধিবৃত্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে কয়েকটি বই রচনা করেন। ‘আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ১’-এ কোরবানি প্রসঙ্গে তিনি যে-প্রশ্নগুলো করেছেন এবং যেসব যুক্তির অবতারণা করেছেন, সেগুলো খণ্ডনযোগ্য নয় বলেই চিরন্তন ও অমলিন। বারবার পড়া যায়।)
কোন ধর্ম বলে, “জীবহত্যা মহাপাপ।” আবার কোন ধর্ম বলে,“জীবহত্যায় পুণ্য হয়।” জীবহত্যায় পাপ বা পুণ্য যাহাই হউক না কেন, জীবহত্যা আমরা অহরহই করিতেছি। তার কারণ¬ জগতে জীবের খাদ্যই জীব। নির্জীব পদার্থ যথা-সোনা, রূপা, লোহা, তামা বা মাটি-পাথর খাইয়া কোন জীব বাঁচে না। পশু-পাখী যেমন জীব, লাউ বা কুমড়া, কলা-কচুও তেমন জীব। উদ্ভিদগণ মৃত্তিকা হইতে যে রস আহরণ করে, তাহাতেও জৈব পদার্থ বিদ্যমান থাকে। কেঁচো মৃত্তিকা ভক্ষণ করিলেও উহার দ্বারা সে জৈবিক পদার্থ-ই আহরণ করে এবং মৃত্তিকা মল রূপে ত্যাগ করে।
জীব-হত্যা ব্যাপারে কতগুলি উদ্ভট ব্যবস্থা আছে। যথা-ভগবানের নামে জীব হত্যা করিলে পুণ্য হয়, অখাদ্য জীব হত্যা করিলে পাপ হয়, শত্রু শ্রেণীর জীব হত্যা করিলে পাপ নাই এবং খাদ্য জীব হত্যা করিলে পাপ-পুণ্য কিছুই নাই ইত্যাদি।
সে যাহা হউক, ভগবানের নামে জীব হত্যা করিলে পুণ্য হইবে কেন? কালীর নামে পাঁঠা বলি দিয়া উহা যজমান ও পুরোহিত ঠাকুরই খায়। কালীদেবী পায় কি? পদপ্রান্তে জীবহত্যা দেখিয়া পায় শুধু দুঃখ আর পাঁঠার অভিশাপ। কেননা কালীদেবীর ভক্তগণ যাহাই মনে করুন, পাঁঠায় কামনা করে কালীদেবীর মৃত্যু। যেহেতু কালীদেবী মরিলেই সে বাঁচিত।
জীবমাত্রেই বলির পাত্র নহে। আবার ধর্মে ধর্মে বলির জীব পার্থক্য অনেক। মুসলমানদের কোরবানির (বলির) পশু-গরু, বকরী, উট, দুম্বা ইত্যাদি। কিন্তু হিন্দুদের বলির পাত্র-ছাগল, ভেড়া, হরিণ, মহিষ, শূকর, গণ্ডার, শশক, গোসাপ এবং কাছিম।
ইসলামের বিধান মতে “কোরবানি” একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান। শোনা যায় যে, হজরত ইব্রাহিম (আঃ) স্বপ্নাদেশ মতে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করিয়া খোদাতা’লার প্রিয়-পাত্র হইয়াছিলেন। তাই মুসলমানগণ গরু, ছাগল, উট, দুম্বা ইত্যাদি কোরবানি দিয়া খোদাতা’লার প্রিয়-পাত্র হ’ন।
কোরবানি প্রথার মূল উৎস সন্ধান করিলে মনে কয়েকটি প্রশ্ন উদয় হয়। প্রশ্নগুলি এমন-
খ) খোদাতা’লা নাকি স্বপ্নে বলিয়াছিলেন-“হে ইব্রাহিম, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি কর।” এই “প্রিয়বস্তু” কথাটির অর্থে হজরত ইব্রাহিম তাঁর পুত্র ইসমাইলকে বুঝিয়াছিলেন এবং তাই তাহাকে কোরবানি করিয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের প্রিয়বস্তু তাঁর “পুত্র” ইসমাইল না হইয়া তার “প্রাণ” হইতে পারে না কি?
শোনা যায় যে, একদা আল্লাহতা’লা হজরত মুসার নিকট দুইটি চক্ষু চাহিয়াছিলেন। হজরত মুসা অনেক কোসেস করিয়াও কাহারোও কাছে চক্ষুর খোঁজ না পাইয়া পরের দিন (তুর পর্বতে গিয়া) আল্লাহর কাছে বলিলেন, সমস্ত দেশ খোঁজ করিলাম, কিন্তু কোন ব্যক্তিই আমাকে চক্ষু দিতে রাজী হইল না। তখন নাকি আল্লাহ বলিয়াছিলেন, হে মুসা! তুমি সমস্ত দেশ খোঁজ করিয়াছ সত্য, কিন্তু তুমি তোমার নিজ দেহটি খোঁজ করিয়াছ কি? তোমার নিজের দুইটি চক্ষু থাকিতে অপরের চক্ষু চাহিতে গিয়াছ কেন? হজরত মুসা নিরুত্তর হইলেন।
ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, নবীগণও কোন কোন সময় আল্লাহর বাণীর উদ্দেশ্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করিতে না পারিয়া ভ্রমে পতিত হইতেন। হজরত ইব্রাহিম বহির্জগতে তাঁর “প্রিয়বস্তুর” খোঁজ করিয়া তাঁর পুত্রকে পাইয়াছেন সত্য, কিন্তু তিনি তাঁর অন্তর্জগত খোঁজ করিলে কি পাইতেন?
গ) “কোরবানি” এই কথাটির অর্থ “বলিদান” না হইয়া “উৎসর্গ” হইতে পারে কিনা। ঈসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্তান উৎসর্গের নিয়ম আছে। কোন সন্তানকে তার পিতা-মাতা মহাপ্রভুর নামে উৎসর্গ করিতে পারেন। ঐরূপ উৎসর্গ করা সন্তানের কর্তব্য হয় – সর্বস্বত্যাগী হইয়া আজীবন ধর্মকর্ম ও মন্দির-মসজিদের সেবা করা। এই প্রথাটি ইহুদী জাতির মধ্যেও দেখা যায়। হজরত ঈসার মাতা বিবি মরিয়ম জেরুজালেম মন্দিরে উৎসর্গ করা একজন সেবিকা ছিলেন। সমস্ত নবীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন হজরত ইব্রাহিমের বংশধর। হজরত ইসমাইল, হজরত ইসহাক, হজরত ইয়াকুব, হজরত ইউসুফ, হজরত মুসা, হজরত ঈসা এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকলেই। ইসমাইল ও ইসহাক পুত্র, হজরত ইয়াকুব পৌত্র এবং হজরত ইউসুফ ছিলেন প্রপৌত্র। অন্যান্য নবীদের মধ্যেও সকলেই ছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর পূর্ববর্তী এবং হজরত ইব্রাহিমের অনুসারী। ছেলেদের খাৎনা (ত্বকচ্ছেদ) করার প্রথাটি হজরত ইব্রাহিম প্রবর্তন করিয়াছিলেন এবং তাহা অন্যান্য নবীগণও পালন করিয়া গিয়াছেন। বিশেষতঃ ইহুদী ও খৃষ্টিয়ানগণ উহা এখনও পালন করেন। কিন্তু স্বগোত্রীয় ও অনুসারী হইয়াও উহারা “কোরবানি” প্রথাটি পালন করেন নাই। কিন্তু হজরত ইব্রাহিমের আবির্ভাবের প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পর উহা প্রবর্তন হইল কেন?
ঘ) যাঁহারা স্বপ্নতত্ত্ব আলোচনা করেন, তাঁহারা জানেন যে, স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে যাহা কিছু দেখে, তার মধ্যে অধিকাংশই থাকে “রূপক”; হজরত ইব্রাহিমের স্বপ্নের কোরবানির দৃশ্যটা “রূপক” হইতে পারে কিনা?
উপরোক্ত বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, কোরবানি প্রথার ভিত্তিমূলক সুদৃঢ় নয়। একটি স্বপ্নের ভিত্তি করিয়া প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ পশুর জীবন নষ্ট হইতেছে। উপন্যাসকে ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করিলে যেরূপ ভুল করা হয়, স্বপ্নের রূপককে বাস্তব বলিয়া গ্রহণ করিলে সেইরূপ ভুল হইতে পারে না কি?
সে যাহা হউক, হজরত ইব্রাহিম যে একজন খাঁটি খোদাভক্ত ছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি যদি স্বপ্নাদেশের প্রিয়বস্তু বলিতে তাঁর নিজ প্রাণকে বুঝিতেন, বোধ হয় যে, তাহাও তিনি দান করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। আল্লাহর প্রেমে তিনি এত অধিক আত্মভোলা হইয়াছিলেন যে, তখন তাঁর কাছে স্ত্রী, পুত্র ও ধনরত্নাদির কোনই মূল্য ছিল না। তাই তিনি অম্লানবদনে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলের গলে ছুরি চালাইয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের সন্তান-বাৎসল্য যতই গভীর হউক আর না হউক, উহাদের সত্যের সন্ধান পৃ ৪৫ মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল, তাহা ‘পিতা ও পুত্র’; আজকাল যে সকল ব্যক্তি পশু কোরবানি করেন, তাহাদের সঙ্গে ঐ পশুর সম্পর্ক কি?
কোরবানির পশুর সঙ্গে কোরবানি দাতার সম্পর্ক শুধু টাকার। তাহাও অনেক ক্ষেত্রে সুদ, ঘুষ, চোরাবাজারী, লোক ঠকানো ইত্যাদি নানা প্রকার অসুদপায়ে অর্জিত। কাজেই কোরবানি দাতা মনে করেন – ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’, মাঝখানে লাভ হয় কোরবানি করার যশ।
দেখা যায় যে, কেহ কেহ কোরবানি দুই-তিন দিন পূর্বেই কন্যা-জামাতা ও আত্মীয়-বন্ধুদের দাওয়াত করেন এবং কোরবানির দিন সকাল হইতে আটা-ময়দা ও চাউলের গুঁড়া তৈয়ারে ব্যস্ত থাকেন। কোরবানির পশুর মাংস দিয়া মাংস-রুটির এক মহাভোজ হয়। হজরত ইব্রাহিম যখন ইসমাইলকে কোরবানি করিতে লইয়া গিয়াছিলেন, তখন কি বিবি হাজেরাকে তিনি আটার রুটি তৈয়ার করিতে বলিয়া গিয়াছিলেন?
কোরবানির পশুর জবেহ হইতে আরম্ভ করিয়া – মাংস কাটা, বখরা ভাগ ইত্যাদি ও খাওয়া- দাওয়া পর্যন্ত চলিতে থাকে যত রকম হাসি-তামাসা, গল্প-গুজব ও পান-সিগারেটের ধুম। হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির সাথে ইহার পরিবেশগত কোন সামঞ্জস্য আছে কি?
হজরত ইব্রাহিমের কোরবানির মূল বস্তু ছিল তাঁর “প্রাণ” কোরবানি করা। কেননা ইসমাইল তাঁর প্রাণ সমতুল্যই ছিলেন। বিশেষতঃ তাঁর ঔরসজাত বলিয়া তিনি তাঁর প্রাণের অংশীদারও ছিলেন (ছিয়াশী বৎসর বয়স্ক সুবৃদ্ধ ইব্রাহিমের একই মাত্র সন্তান ইসমাইল); তাই ইসমাইলকে কোরবানি করার মানে হজরত ইব্রাহিমের প্রাণকে কোরবানি করা। আর আজকাল যে কোরবানি করা হয়, তাহাতে কোরবানির পশুর সাথে কোরবানি দাতার কোনরূপ স্নেহ বা মায়ার বন্ধন থাকে কি?
হজরত ইব্রাহিম আল্লাহর নির্দেশ মানিয়া শুধু কোরবানিই করেন নাই, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে চলিতে যাইয়া তিনি নাকি ভীষণ অগ্নিকুণ্ডেও পতিত হইয়াছিলেন। হজরত ইব্রাহিমের পদাঙ্ক অনুসরণ বা তাঁর কৃতকর্মের অনুকরণ করাই যদি তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্য হয়, তবে তিনি যেই তারিখে অগ্নিকুণ্ডে পতিত হইয়াছিলেন, সেই তারিখে তাঁহারা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেন না কেন?
হজরত ইব্রাহিম তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় বস্তুই কোরবানি করিয়াছিলেন। বর্তমান কোরবানি দাতাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রিয় বস্তু কি দশ-বিশ টাকা মূল্যের একটি পশু? হজরত ইব্রাহিমের খোদাভক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ইসমাইল পাইয়াছিলেন। তাই সে নিজেকে কোরবানি করার বাণী শ্রবণে মহানন্দে তাহাতে সম্মতি দিয়াছিলেন এবং পিতার ছুরিকার নীচে স্বেচ্ছায় শয়ন করিয়াছিলেন। আর বর্তমান কোরবানি প্রথায় পশুর কোন সম্মতি থাকে কি? একাধিক লোকে যখন একটি পশুকে চাপিয়া ধরিয়া জবেহ করেন, তখন সে দৃশ্যটা বীভৎস বা জঘন্য নয় কি?
মনে করা যাক যে, মানুষের চেয়ে বেশী শক্তিশালী এক অসুর জাতি পৃথিবীতে আবির্ভাব হইয়া, তাহারা পুণ্যার্থে মহেশ্বর নামক এক দেবতার নামে জোরপূর্বক মানুষ বলি দিতে আরম্ভ করিল। তখন অসুরের খাঁড়ার (ছুরির) নীচে থাকিয়া মানুষ কি কামনা করিবে? ‘মহেশ্বরবাদ ধ্বংস হউক, অসুর জাতি ধ্বংস হউক, অন্ধ-বিশ্বাস দূর হউক’ ইহাই বলিবে না কি?
হজরত ইব্রাহিম দ্বিধাহীন চিত্তেই ইসমাইলের গলে ছুরি চালাইয়াছিলেন। কিন্তু বলির শেষে দেখিলেন যে কোরবানি হইয়াছে একটি দুম্বা, ইসমাইল তাঁর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। ঐ সময় দুম্বা কোরবানি না হইয়া প্রকৃত পক্ষে যদি ইসমাইলই কোরবানি হইতেন তবে তাঁহার অনুকরণে মুসলিম জাহানে আজ কয়টি কোরবানি হইত?
হজরত ইব্রাহিমের কোরবানি দেওয়া হইল বটে, কিন্তু ইসমাইল কোরবানি হইলেন না এবং যে দুম্বাটি কোরবানি হইল, তাঁর কেনা নয় এবং পালেরও নয়। অধিকন্তু উহা কোথা হইতে কিভাবে আসিল, সত্যের সন্ধান পৃ ৪৬ তাহাও তিনি জানিলেন না। ঘটনাটি আজগুবি নয় কি?
কোরবানি প্রথায় দেখা যায় যে, কোরবানির পশুর হয় “আত্মত্যাগ এবং কোরবানি দাতার হয় সামান্য স্বার্থত্যাগ।” দাতা যে মূল্যে পশুটি খরিদ করেন, তাহাও সম্পূর্ণ ত্যাগ নহে। কেননা মাংসাকারে তার অধিকাংশই গৃহে প্রত্যার্বতন করে সামান্যই হয় দান। এই সামান্য স্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে যদি দাতার স্বর্গলাভ হইতে পারে, তবে কোরবানির পশুর স্বর্গলাভ হইবে কিনা? যদি না হয়, তবে ঐ সকল পশুর আত্মত্যাগের সার্থকতা কি? আর যদি হয়, তবে সকল পশুর হইবে কিনা; অর্থাৎ অসদুপায়ে অর্জিত (হারাম) অর্থে দেওয়া কোরবানির পশুর স্বর্গ লাভ হইবে কিনা? যদি না হয়, তবে ঐ সকল পশুর অপরাধ কি?
বাইবেল তথা তৌরাত পুণ্যার্থে বাহুল্যরূপে গোহত্যার বিবরণ পাওয়া যায়। হজরত ইব্রাহিম ঐ মতের প্রবর্তক বা সমর্থক ছিলেন এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ) ঐ মত সমর্থন করিয়া গিয়াছেন। অতি প্রাচীনকাল হইতেই মানুষ গোপালন করিয়া আসিতেছে – দুগ্ধপ্রাপ্তির ও কৃষিকাজের জন্য। কিন্তু মরুময় আরবদেশে কৃষিকাজ “নাই” বলিলেই চলে। সুতরাং ওদেশে দুগ্ধবতী গাভী কাজে লাগিলেও বলদগুলি কোন কাজেই লাগে না। তাই আরব দেশের লোকে পূণ্যার্থেই হউক আর ভোজার্থেই হউক,বাহুল্যরূপেই গোহত্যা করিতেন। কাজেই ঐ দেশীয় ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও গোহত্যার ব্যবস্থা দেখা যায়। পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষ চিরকালই কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে গোজাতি মানুষের পরম উপকারী পশু। কৃষিকাজের সহায়ক বলিয়া আর্যগণ “গোহত্যা” অন্যায় মনে করিতেন। তাই তাহাদের ধর্মশাস্ত্রেও “গোহত্যা মহাপাপ” বলিয়া উল্লেখ আছে। আর্যগণ মনে করিতেন গাভী আমাদিগকে দুগ্ধ দান করে, সুতরাং সে মাতৃ-সমতুল্যা এবং বলদ কৃষিকাজের সহায়ক হইয়া আমাদিগকে প্রতিপালন করে, তাই সে পিতৃ-সমতুল্য, কাজেই উহারা আমাদের সম্মানের ও পূজার পাত্র। অধিকন্তু হিন্দুগণ ছাগ ভক্ষণ করে, অথচ দুগ্ধদাতৃ বলিয়া ছাগী ভক্ষণ করে না। কিন্তু “দুগ্ধদাতৃ” বলিয়া কোন পশুর প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞতা নাই।
কৃষি প্রধান দেশগুলিতে আজও ব্যাপক গরুর দ্বারা কৃষিকাজ চলিতেছে। যদিও কচিৎ ট্রাক্টরাদি যান্ত্রিক চাষাবাদের চেষ্টা চলিতেছে, উহা কবে যে গরুর চাহিদা মিটাইবে, তাহা আজও বলা যায় না। সুতরাং কৃষি প্রধান দেশগুলিতে “গোহত্যা” ক্ষতিজনক নয় কি?
Leave a Reply