অনেক নিরামিষাশী ঘাসফুস-জীবী হিন্দু দাবি করেন, ওই বলি-টলির ব্যাপার তাঁদের সনাতন ধর্মে নেইকো, ওসব পরবর্তীকালের তন্ত্রের আমদানি। কিন্তু সে কথা পুরোই ঘাপলা। ঋগবেদ, যা বেদের মধ্যে প্রাচীনতম বলে ধরা হয়, তাতেও বলির উল্লেখ আছে। আর যজুর্বেদকে তো একরকম বলির হ্যান্ডবুকই বলা চলে। কোন দেবতার উদ্দেশ্যে কোন প্রাণী বলি দিতে হবে, এসব বিস্তারিত বলা আছে সেখানে। চাষের আগে অমুক দেবতাকে তুষ্ট করে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য অমুক প্রাণী বলি, খরার সময় বৃষ্টির দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য অমুক প্রাণী বলি, ইত্যাদি ইত্যাদি। বৈদিক যুগে আর্যরা বেশ টপাটপই বলি লাগাতেন। তারপর ধরুন গিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা, যা বড় বড় রাজারা নিজেদের রাজচক্রবর্তী প্রমাণ করার জন্য করে থাকতেন – যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, যে ঘোড়ার পাহারাদার হয়েছিলেন অর্জুন। যজ্ঞের শেষে যখন সেই সারা ভারত ট্যুর করে আসা ঘোড়াটিকে বলি দেওয়া হল, তখন তার মাংস দেখভালের দায় পড়েছিল দ্রৌপদীর উপর। সনাতন ধর্মের যাগযজ্ঞে এই একটা ভাল ব্যাপার ছিল, স্ত্রীকে স্বামীর সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে যজ্ঞে সাথেসাথে থাকতে হত আর অনেক দায়দায়িত্বও পালন করতে হত, স্ত্রী পাশে না থাকলে সেই যজ্ঞের ফল ঠিকমত মিলত না।
সময় নেই — তাড়াতাড়ি পাঁঠা উৎসর্গিত হয়ে কপালে সিঁদুর, গলায় জবার মালা পরে হাড়িকাঠে পড়লো, বাড়িসুদ্ধ সকলের ‘মা’ ‘মা’ রবের প্রচণ্ড চিৎকারে নিরুপায় নিরীহ জীবের শেষ আর্তকণ্ঠ কোথায় ডুবে গেল, লালুর হাতের খড়গ নিমিষে ঊর্ধ্বোত্থিত হয়েই সজোরে নামলো, তার পরে বলির ছিন্নকণ্ঠ থেকে রক্তের ফোয়ারা কালো মাটি রাঙ্গা করে দিলে। লালু ক্ষণকাল চোখ বুজে রইল। ক্রমশঃ ঢাক ঢোল কাঁসির সংমিশ্রণে বলির বিরাট বাজনা থেমে এলো। যে পাঁঠাটা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল আবার তার কপালে চড়লো সিঁদুর, গলায় দুললো রাঙ্গা মালা, আবার সেই হাড়িকাঠ, সেই ভয়ঙ্কর অন্তিম আবেদন, সেই বহুকণ্ঠের সম্মিলিত ‘মা’ ‘মা’ ধ্বনি। আবার লালুর রক্তমাখা খাঁড়া উপরে উঠে চক্ষের পলকে নীচে নেমে এলো,—পশুর দ্বিখণ্ডিত দেহটা ভূমিতলে বার-কয়েক হাত-পা আছড়ে কি জানি কাকে শেষ নালিশ জানিয়ে স্থির হ’লো; তার কাটা-গলার রক্তধারা রাঙ্গামাটি আরও খানিকটা রাঙ্গিয়ে দিলে।
পাঁঠাকে ফেলিয়া ঠাকুর মহাশয় তাহাকে সেই খোঁটায় বাঁধিলেন। তাহার পর তাহার মুখদেশ নিজের পা দিয়া মাড়াইয়া জীয়ন্ত অবস্থাতেই মুণ্ডদিক হইতে ছাল ছাড়াইতে আরম্ভ করিলেন। পাঁঠার মুখ গুরুদেব মাড়াইয়া আছেন, সুতরাং সে চীৎকার করিয়া ডাকিতে পারিল না। কিন্তু তথাপি তাহার কণ্ঠ হইতে মাঝে মাঝে এরূপ বেদনাসূচক কাতরধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল যে, তাহাতে আমার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তাহার পর তাহার চক্ষু দুইটি! আহা! আহা! সে চক্ষু দুইটির দুঃখ আক্ষেপ ও ভর্ৎসনাসূচক ভাব দেখিয়া আমি যেন জ্ঞান-গোচরশূন্য হইয়া পড়িলাম। সে চক্ষু দুইটির ভাব এখনও মনে হইলে আমার শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমি বলিয়া উঠিলাম— ‘ঠাকুর মহাশয়! ঠাকুর মহাশয়! করেন কি? উহার গলাটা প্রথমে কাটিয়া ফেলুন। প্রথম উহাকে বধ করিয়া তাহার পর উহার চর্ম্ম উত্তোলন করুন।’
ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন—‘চুপ! চুপ! বাহিরের লোক শুনিতে পাইবে। জীয়ন্ত অবস্থায় ছাল ছাড়াইলে ঘোর যাতনায় ইহার শরীরের ভিতরে ভিতরে অল্প অল্প কাঁপিতে থাকে। ঘন ঘন কম্পনে ইহার চর্ম্মে একপ্রকার সরু সরু সুন্দর রেখা অঙ্কিত হইয়া যায়। এরূপ চর্ম্ম দুই আনা অধিক মূল্যে বিক্রীত হয়। প্রথম বধ করিয়া তাহার পর ছাল ছাড়াইলে সে চামড়া দুই আনা কম মূল্যে বিক্রীত হয়। জীয়ন্ত অবস্থায় পাঁঠার ছাল ছাড়াইলে আমার দুই আনা পয়সা লাভ হয়। ব্যবসা করিতে আসিয়াছি, বাবা! দয়ামায়া করিতে গেলে আর ব্যবসা চলে না।’
Leave a Reply