বছর পাঁচেক আগে প্রথম নিউইয়র্কে আসার পরে উঠেছিলাম এক বাঙালি বাড়িওয়ালার বাসায়। বোরখাওয়ালী চলে যাওয়ার পরে বাসা পরিবর্তন করি। আবার বিয়েটিয়ে করে মুভ হয়েছিলাম আরেক বাঙালি বাড়িওয়ালার বাসায়। দুইটা বাসাতেই একই সমস্যা–শীতকালে এরা ঠিকমতো ‘হিট’ দেয় না। শীতকালগুলা কাটছিল খুব কষ্টে। ঘরের মধ্যেও সারাক্ষণ শীতের পোশাক পরে থাকতে হতো। সুবিধার মধ্যে বাসাটা ছিল সিটির কাছাকাছি, তাই কাজে যাওয়া-আসাতে সময় লাগত কম, আর ছিলাম আরেকটা ফ্যামিলির সাথে শেয়ারে, তাতে ভাড়া কম পড়ত।
প্রথম দিকে নানান জায়গায় কাজ খুঁজেছি, করেছি। পরে ঘুরেফিরে আতরের দোকানে কাজটা মোটামুটি ‘পার্মানেন্ট’ হয়ে যাওয়ার পরে মনে হলো–এমনিতেই বেশি দিন বাঁচবো না। যে কয়দিন আছি, নিজের মতো করে একটু হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকি। নতুন বাসা খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু সিটির কাছাকাছি যে ভাড়া সেটায় পোষাবে না। বাধ্য হয়ে সিটি থেকে একটু দূরে বাসা নিতে হলো। কাজে যাওয়া-আসায় সময় একটু বেশি লাগলেও ভাড়াটা কম।
নতুন বাসায় নতুন সমস্যা! বাঙালিদের বাসায় যে সমস্যা ছিল, এখানে সমস্যাটা উলটা–পুরান আমলের বাড়ি, হিটিং সিস্টেমও পুরানো। হিটার যখন অন করে তখন ঘর এতো গরম হয়ে যায় যে জানালা খুলে দিতে হয়। রুমের আর্দ্রতার কোনো মা-বাপ থাকে না। বিশুকে সমস্যাটার কথা বললাম।
বিশু সমাধান নিয়ে হাজির। বললো–কিছু টাকা খরচ করতে হবে… এক ধরনের মেশিন পাওয়া যায় কিনতে… রুমের আর্দ্রতা যেমন চাই, তেমনটা করে দেবে। কিন্তু দাম দেখে একটু ইতস্তত করছিলাম দেখে বলল, তাহলে প্রাকৃতিক উপায় আছে। কী সেটা? উদ্ভিদের শরণাপন্ন হতে হবে। বলছিল ‘এরিকা পাম’-এর কথা। কয়েকটা কিনে ঘরের কোণে কোণে বসিয়ে দিতে হবে। শোকেস দিয়ে হুদাই ঘর না ভরে এগুলা বরং অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
২) মে মাসের শেষ প্রায়, জুন এসে গেলো। কিন্তু নিউইয়র্কে গত সপ্তাহেও ঠাণ্ডা ছিল। সবে একটু একটু করে গরম পড়তে শুরু করেছে। সাধারণত এমন হয় না। ৪-৫ বছর ধরে এখানে আছি, এমনটা আগে সেভাবে দেখি নি। এপ্রিলেই গরম পড়তে শুরু করত। অনেকেই বলছে–জলবায়ুতে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। এটা তারই প্রভাব।
দেশের আবহাওয়াতেও ব্যাপক প্রভাব এবং পরিবর্তন এসেছে। প্রতিদিন কয়েকবার করে দেশের ‘ওয়েদার রিপোর্ট’-এ চোখ বুলাই। শীতকালে নিউইয়র্কের ওয়েদার রিপোর্ট দেখার সময় ভালো করে দেখি ‘ফিল’ কতো ডিগ্রি হচ্ছে? যেমন তাপমাত্রা হয়তো শূণ্যের কাছাকাছি, কিন্তু ফিল হচ্ছে -১৫ ডিগ্রি। গরম কালে উলটা–এবং সেটা দেশে আরো বেশি। প্রায়ই খেয়াল করেছি–তাপমাত্রা হয়তো ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু ফিল হচ্ছে ৪২-এর মতো। নিউইয়র্কে এতটা পার্থক্য হয় না–এখানে হয়তো ৩০ ডিগ্রিতে ৩৫ পর্যন্ত ফিল হতে পারে। এর মূল কারণ–নিউইয়র্কের চেয়ে বাংলাদেশের আর্দ্রতা বরাবরই বেশি। (আবার ঢাকার চেয়ে কোলকাতাতে আরো বেশি।)
ছোটোবেলার কথা ভাবছিলাম। মাঝের বছরগুলোতে দেশের তাপমাত্রা কি আসলেই এতটা বেড়েছে? মনে হয় না। Trading Economics থেকে গত ১০ বছরের গড় তাপমাত্রার একটা স্নাপশট দিচ্ছি–
তাহলে আমাদের ছোটোবেলায় ওই তাপমাত্রায় যতটা গরম অনুভব হতো, এখন তারচেয়ে এতো বেশি অনুভব হচ্ছে কেনো? আবার শীতকালেও দেখা যায় শীত বেশি পড়ছে। কারণটা কি ওই ‘হিউমিডিটি’? ওটার তারতম্যের জন্যেও গরমকালে বেশি গরম অনুভব হচ্ছে? জনসংখ্যা বাড়ছে, গাছপালা কাটা হচ্ছে, জমিজমা-পুকুর ভরাট করে নতুন নতুন বসতবাড়ি হচ্ছে, বিল্ডিং বেশি হচ্ছে–এরকম আরো অনেক কারণ থাকতে পারে…
৩) দেশের বাড়ির কথা মনে পড়লে মাঝে মাঝে গুগল ম্যাপে গিয়ে দেখি। গাছপালার ব্যাপারটা মাঝে মাঝে মনে হয় বেড়েছে প্রচুর। যেখানে খোলা মাঠ বা জমি ছিল, সেখানে নতুন নতুন বাড়িঘর, আর এসব বাড়িঘরের চারদিকে প্রচুর নতুন নতুন গাছ। এছাড়া পুরানো বাড়িঘরের চারদিকের গাছগুলোও মনে হয় আরো বড় হয়েছে, কেউ কেউ আরো গাছ লাগিয়েছে–মাঝে মাঝে অন্ধকার অন্ধকারই মনে হয় গাছপালার জন্য। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
বিশু যখন এরিকা পামের কথা বলছিল, তখন গুগল করছিলাম ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এরিকা পাম জাতীয় আরো অনেক আছে যেসব উদ্ভিদ ঘরের হিউমিডিটি ঠিক রাখতে সাহায্য করে।–Boston Fern, Spider Plant, Peace Lily, Rubber Plant, Chinese Evergreen, Snake Plant, Dracaena Marginata, Bamboo Palm, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো একটা নাম পেলাম–অনেকের ভুরু কুঁচকে যেতে পারে–Ocimum tenuiflorum অর্থাৎ Indian Basil–সোজা বাংলায় তুলসী গাছ।
এগুলো দেখতে দেখতে আরেকটা ভিন্ন ব্যাপার মনে হচ্ছিল– এরিকা পামের পাতাগুলা দেখে প্রথমে ভাবছিলাম–আরে, এতো দেখি বেতের পাতার মতো পাতা। আবার ভাবলাম–নাকি সুপারি পাতা… নাকি খেঁজুর পাতা… নাকি নারকেল পাতা… আর ব্যাম্বু পাম তো পুরাই ছোটখাটো একটা বাঁশের ঝাড়!
৪) ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছিল। অনেকের হয়তো মনে আছে–ছোটোদের মার্বেল খেলাটা আমাদের দেশের বড়রা খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তাদের চোখে অবশ্য সবচেয়ে খারাপ খেলা ছিল পয়সা দিয়ে জুয়া খেলা। ধরা পড়লে মাইর একটাও মাটিতে পড়ত না। খেলতে হতো একেবারে বাঁশ বা বেতঝোপের মধ্যে গিয়ে। তবে তেঁতুলের বিচি দিয়ে জুয়ার মতো খেললে সেভাবে মাইন্ড না করলেও মার্বেল খেলাটাও একটু লুকিয়ে লুকিয়েই খেলতে হতো। আর সেজন্য পছন্দের জায়গাগুলো ছিল সবার চোখের আড়ালে–বাঁশঝাড় বেতঝোপের আশেপাশে, কিংবা তালগাছ খেজুর গাছ, নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা ভিটে বা পুকুর পাড়। গরম কালে এই জায়গাগুলাই ছিল সবচেয়ে ঠাণ্ডা। খেলা বাদেও গরমকালে এরকম জায়গাগুলাতেই পোলাপানের আড্ডা হতো সবচেয়ে বেশি।
আর খোলা পায়খানার যুগে প্রায় সবার বাড়ির পেছনেই বেতঝোপ বা বাঁশঝাড় থাকত–এসবের আড়ালেই খোলা পায়খানা… বিল্ডিং বাড়ি হওয়ার আগে বা এখনো অনেকের টয়লেট মূল ঘর থেকে আলাদা–বাড়ির পেছন দিকটায়–গাছপালার আড়ালে। তবে আগেকার মতো এখন আর খেজুর গাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছ, বাঁশঝাড়, বেতঝোপ, তালগাছ সেভাবে চোখে পড়ে না। বেশিরভাগই কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে। অনেকে ওসব জায়গায় নতুন গাছ লাগিয়েছে বটে, তবে সেগুলা ব্যবসায়িক দিকটা মাথায় রেখে–বেশিরভাগই মেহগনি গাছ বা এই জাতীয় গাছ। কেউ কেউ হয়তো নানান ফলের গাছও লাগিয়েছেন।
৫) মনে আছে–ছোটোখাটো ঝোপ-ঝাড়ে প্রচুর ফার্ন চোখে পড়ত। বিশুদের বাড়ির একপাশেই ছিল ফনিমনসার বিশাল ঝাড়। এছাড়া ছিল নাম না জানা আরো অনেক প্রকার গাছ-গাছালি। তখন হয়তো সেগুলোর কদর বুঝতাম না। আমাদের অজান্তেই সেগুলা যে আমাদের কতো বড় উপকার করত–এখন ভেবে অবাক হই!
বৃক্ষরোপন সপ্তাহ আসতেছে, নানান কর্মসূচী নেয়া হবে, নানান প্রচারণা চালানো হবে। বর্ষাকালে অনেকেই হয়তো আবার নতুন নতুন গাছের চারা লাগাবেন। কিন্তু এই যে সত্যিকারের ‘পরিবেশ বান্ধব’ গাছপালা–এগুলার ব্যাপারে মনে হয় না সরকার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে–কারো তেমন কোনো আইডিয়া আছে। বিজ্ঞান আসলে কী বলে–আমার জানা নেই। নিজের অভিজ্ঞতা বা যা দেখে এসেছি, যা অনুভব করে এসেছি–সেটাই বলার চেষ্টা করলাম।
Neel
ছোটবেলায় যেখানে ছিলাম সেখানে আমাদের বাসা থেকে একটু দূরেই ছিল মোটামুটি বিশালাকৃতির একটি খেলার মাঠ । মজার ব্যাপার হলো মাঠটি ছিল পুরোপুরি লাল মাটির । তাই মাঠটি ‘লালমাটি’ নামেই পরিচিত ছিল । লালমাটিতে সহজে কেউ যেত না কারণ চারদিকে ছিল অসংখ্য বাঁশ ঝাঁড় । আমরা প্রায় প্রতিদিন বিকালে সেখানে যেতাম শুধুমাত্র মার্বেল খেলার জন্য । আপনার লেখাতে মার্বেলের প্রসঙ্গ আসাতে ছোটবেলার কথাগুলো মনে হয়ে গেল ।