বনানীতে আগুন লাগছে, সবাই কমবেশি ‘বাঁশি’ বাজাচ্ছে, আর পাল্লা কিনা চুপ! আসলে নাস্তিকতাও যখন একটা ‘ধর্ম’, তখন এই চুপ থাকাও একধরনের বাঁশি বাজানো। আবার এই যে সব নীরবতা ভঙ্গ করে দুই পয়সা কামানোর লোভে ব্লগ লিখতে বসছি–এটাও এক ধরনের বাঁশি বাজানো।
বনানী অগ্নিকাণ্ড নিয়ে এত কাহিনী, এত নিউজ, এত পোস্ট, এত স্যাটেলাইট, এত হেলিকাপ্তার, এত পোস্ট, এত আবেগ, এত দোষারোপ, এত স্ট্যান্টবাজি, এত… নাহ, এত দালালীর কথা ভাবতে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।
আপাতত একটা কৌতুক মনে পড়ছে। একটা বহুল প্রচলিত, পুরানো, বল্টু কৌতুক। এর অনেকগুলো ভার্সন আছে। একটা উল্লেখ করি–
বল্টু লঞ্চে করে যাচ্ছে। পাশে এক চীনা ও এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক।
হঠাত চীনা ভদ্রলোকটি তার ফোন পানিতে ছুড়ে মারলেন।
বল্টু অবাক হয়ে বলল–এত দামী ফোনটা ফেলে দিলেন!
চীনা ভদ্রলোকটি বললেন–ধুর, এটা কোনো ব্যাপার হলো… এগুলো আমাদের দেশে অনেক আছে!
একটু পরে অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক কয়েকটি টাকার বান্ডিল পানিতে ফেলে দিলেন।
বল্টু আবার অবাক হয়ে বলল–এতগুলো টাকা ফেলে দিলেন!
অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বললেন–ধুর, এটা কোনো ব্যাপার হলো… এগুলো আমাদের দেশে অনেক আছে!
এরপর বল্টু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাচ্চা ছেলেকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিলেন।
এই দেখে চীনা ও অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন–এ কী করলেন! বাচ্চা ছেলেটিকে পানিতে ফেলে দিলেন!
বল্টু বলল–ধুর, এটা কোনো ব্যাপার হলো… এগুলো আমাদের দেশে অনেক আছে!
কৌতুকটি কোথাও কোথাও এখানে শেষ হয়। আবার কোথাও কোথাও আরেকটু যোগ হয়। যেমন–
তারপর বল্টু লঞ্চ থেকে নেমে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছে। এমন সময় বাচ্চা ছেলেটি নদী থেকে উঠে এসে এসে বলল–বাবা, টাকা আর ফোন দুটোই পেয়েছি।
২) জ্ঞানী-গুণীরা বলেছেন, আজাইরা কিছু ঘটে গেলে মাথা গরম না করে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হবে দোষটা কার উপর চাপানো যায়। বনানী অগ্নিকাণ্ডের পর এটাই প্রথমে হয়েছে–সব দোষ জনগণের। তারা রাস্তায় নামলো কেন, তারা সেলফি তুললো কেন, তারা হাসলো কেন…
মজার ব্যাপার হলো–ওই জনগণরেই আবার দেখা গেছে পানি নিয়া ছোটাছুটি করতে, পানির পাইপ কাঁধে তুলে নিতে… রানাপ্লাজা ধ্বসে গেলেও জনগণই বেশি কাজ করছে। এর মধ্যে কেউ কেউ থাকবে যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত খোঁচাবে, কেউ কেউ দু হাত তুলে মোনাজাত ধরবে, কেউ কেউ সেলফি তুলবে, কেউ কেউ এমনি দেখবে, কারো কারো কাছে এগুলাই আবার বিনোদনের অংশ… কেউ ট্রল করবে, কেউ মজা নিবে, কেউ পোস্টের পর পোস্ট দিয়ে যাবে, কেউ ব্লগ লিখবে… আসলে ১২ রকমের মানুষ… বিচিত্রতাই তো প্রকৃতির সৌন্দর্য… তাই না?
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে–আমার নিজেরও হাসি পাচ্ছিলো… এখন আর মানবতাবাদী-মানববাদীদের মতো এত সহজে মানবতা চ্যাগান দিয়ে ওঠে না। বিষয়টা আক্কেলের নয়… অভ্যস্ততার… এরকম দুর্ঘটনা দেখতে দেখতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই হয়তো কোনো বিকার নাই…

৩) দোষারোপের পর আসে আবেগ। দমকমবাহিনীর পাইপের ফুটা বন্ধে এগিয়ে আসা ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া বাচ্চা নাঈমের ছবিটা আমাদের আবেগকে সেইরাম নাড়া দিতে সমর্থ হয়েছে।

প্রথমত, এই ধরনের দুর্ঘটনার স্থল থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়াটাই বেশি জরুরী। তারপর কেউ বলছে না, দমকলবাহিনীর পাইপ ফুটা কেন? ফুটা পাইপ নিয়ে এরা আগুন নেভাতে আসে কেন? এই ধরনের প্রশ্ন তুললে হয়তো আবার দেশদ্রোহী ট্যাগ খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই দেশপ্রেমিকরা এসব দেখেও না দেখার ভান করবে।
৪) আবেগের পর আবার আবেগের জোয়ার নিয়ে আসে স্ট্যান্টবাজি। এই কাজে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগুনে আহত সবার চিকিৎসা ফ্রি-তে হবে। এই পর্যায়ে এসে আসলে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা–মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা। আমার মনে হয় খাদ্যের পরেই চিকিৎসাটা বেশি জরুরি। একটা রাষ্ট্র যদি তার জনগণরে এগুলা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা যায় নির্দ্ধিধায়। এরকম রাষ্ট্র যারা চালায়, তারাও রাষ্ট্রের পরিচালক হিসাবে ব্যর্থ। সুষমসমাজব্যবস্থা হলে দুনিয়ার কোনো মানুষেরই তার মৌলিক চাহিদার ঘাড়তি থাকার কথা নয়। এগুলা তখনই হয় যখন রাষ্ট্রের চাকুরেরা দুর্নীতিবাজ হয়। অথচ এসব নিয়ে আমরা কেউ সরব নই!
দুর্ঘটনারে আমরা ‘এক্সিডেন্ট’ হিসাবে জানি। কিন্তু এটা জানি না যে, দুর্ঘটনা বেশিরভাগ সময়েই দুর্নীতির ফল। এই যে বনানীতে আগুন–শোনা যাচ্ছে বিল্ডিংটা যথাযথ নিয়ম মেনে মানা হয় নি। তাহলে এই বিল্ডিং কাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে গড়ে উঠল, আগুন লাগার আগে এসব কেন কারো নজরে এলো না… আমাদের দেশের প্রতিটা অলিতেগলিতে অব্যবস্থাপনা… আগে
দুর্নীতি মাঝে মাঝে ফল দিত। ইদানিং ঘনঘন দিচ্ছে… এই আরকি…
৫) আমাদের দেশে আগে কানারে হাইকোর্ট দেখানো হত, এখন হাইকোর্টের পাশাপাশি স্যাটেলাইট, পদ্মাসেতু, ইত্যাদি উন্নয়নসহযোগে দেখানো হয়। অথচ দেশটা দিনদিন ভাঁগাড়ে পরিনত হচ্ছে, বসবাসের অযোগ্য দেশের তালিকায় আমরা একেবারে উপরের দিকে আছি। গ্রামে গিয়ে নিজে ভেজালবিহীন খাবার নিজের জমিতে উৎপন্ন করে খাবেন, সেই অবস্থাও আর নেই–মাটি পর্যন্ত দূষিত হয়ে গেছে।
তো দেশে কিছু ঘটলে কেউ কেউ স্বাভাবিক ভাবে সরকারের দেখানো উন্নয়ন (দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অযোগ্যতা) নিয়ে প্রশ্ন তোলে। [স্বাভাবিক নয় কি?] এই প্রসঙ্গে কেউ কেউ আগে জান ও মালের নিরাপত্তা না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় খাতে সরকারের বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে–এই হিসাবে বনানী অগ্নিকাণ্ডে দমকলবাহিনীর ফুটা পাইপ আর স্যাটেলাইট বিষয়টাও আসছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি স্যাটেলাইট টানলে আবার বঙ্গবন্ধুও চলে আসে। কারণ স্যাটেলাইটের নামটাও আবার বঙ্গবন্ধুর নামে কি না। মনে পড়ছে–আস্তিক বা লীগার নাস্তিকদের সাথে তর্কের সময় বিদেশের ভালো কিছুর উদাহরণ দিলে তারা বিষয়টা এভাবে এড়িয়ে যেত যে–আমাদের দেশটা ইউরোপ-আমেরিকা নয়, তাই দেশের কোনো ব্যাপারে ইউরোপ আমেরিকার উদাহরণ দেয়া উচিত হয়। এদেরকেই আবার দেশের দুর্নীতি-দুর্ঘটনার সময় বিদেশের খারাপ খারাপ উদাহরণ টানতে দেখি। বনানী অগ্নিকাণ্ডে এরা ইংল্যান্ডের একটা অগ্নিকান্ডের উদাহরণ টেনে বলছে যে, ইংল্যান্ড এত উন্নত হওয়ার পরেও তাদের বিল্ডিংয়ে আগুন লাগলে ৬০ ঘণ্টা লাগে নেভাতে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে আরো দ্রুত আগুন নেভানো হয়েছে। দালালি পেশাটাকেও এরা দিন দিন অনুমোদিত তিনতলার জায়গায় চোখের নিমিষে তেইশতলা বানিয়ে ফেলছে! সামনে না জানি আরো কতো তলা হয়!!
[প্রথমে উল্লেখ করা কৌতুকটির সাথে আশে-পাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ঘটনাগুলোর সাথে কোনো প্রকার মিল পেলে সেটা নিতান্তই কাকতাল-বকতাল। আর মিল না পেলে বুঝবেন আপনি আক্কেলওয়ালা একজন প্রাণী, আপনার যথেষ্ট আক্কেল হয়েছে–ইংরেজিতে যাকে বলে–ম্যাচিউরড… ম্যাচিউরিটি…]
Leave a Reply