কোনো এক নাস্তিকের আবলামি দেইখা অন্য কোনো নাস্তিক আজ পর্যন্ত নাস্তিকতা ত্যাগ কইরা, মানে নাস্তিক থিকা প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী আস্তিক হইছে? অন্তত আমি কাউরে দেখি নাই। সেই যে এক সাদাইয়া কোথায় জানি গোলাগুলি করছিল, পরে জানা গেলো সে নাস্তিক–ওই ঘটনার পরেও কোনো নাস্তিক কি নাস্তিকতা ত্যাগ কইরা নাস্তিক থিকা আস্তিক হইছিল? মনে হয় না।
সাধারণত ওরকম কেন হয় না? কারণ–আস্তিকরা যেহেতু তাদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও প্রথা মেনে সমস্ত কাজ সম্পাদন করে, তাই তাদের কর্মের দায় তাদের ধর্মের উপর গিয়ে পড়ে। এদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নাই, সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা। আবার অন্যদের দৃষ্টিতে খারাপ–এমন কোনো কাজ করলেও শয়তানের উপর দোষ চাপায়। নাস্তিকরা উলটা–ব্যক্তি কেন্দ্রিক…
কোনো আস্তিক যখন প্রথাগত ধর্ম ত্যাগ করে নাস্তিক হয়, তখন সে একই সাথে ধর্মীয় বিধি-বিধান, প্রথা, ইত্যাদিও ত্যাগ করে একজন স্বতন্ত্র মানুষে পরিনত হয় এবং নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে পরিচালিত হয়। তখন তার সমস্ত কাজকর্মের দায় একান্তই তার নিজের, কেননা নাস্তিকদের কোনো নির্দিষ্ট ম্যানুয়াল নেই যা মেনে সে তার কাজকর্ম করে। এ কারণে কোনো নাস্তিক আবলামি করলে অন্য কোনো নাস্তিক সেটার দায় গ্রহণ করে না।
২) এবার নারীবাদ-নারীবাদী প্রসঙ্গ :
তার আগে অনলাইনে বহুল প্রচলিত দুইটা বিতর্কিত প্রশ্ন–প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী হয়েও কি নারীবাদী হওয়া যায়? বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর পরেও কি নারীবাদী হওয়া যায়?
হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থে নারীবাদের একটা সহজ-সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা আছে–নারী-পুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারে বিশ্বাসই হলো নারীবাদ। আর এই সাম্য ও সমান অধিকারে যিনি বিশ্বাস করেন, তিনিই নারীবাদী।
এবার প্রশ্ন–প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস রেখে, ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলেও কি
নারী-পুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারে বিশ্বাস রাখা সম্ভব, অর্থাৎ নারীবাদী হওয়া যায়?–এই প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে নানান মতামত দেয়া সম্ভব। তবে যারা বলেন যে–প্রথাগত আস্তিক হয়েও নারীবাদী হওয়া যায়, তাদের কাছে একটা পালটা প্রশ্ন তুলে ধরা যায়–নারীবাদ প্রথাগত ধর্মগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক কি না? অর্থাৎ আপনি যে ধর্মে বিশ্বাসী, সেই ধর্ম নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেয় কি না…
ইসলাম ধর্মে নারী পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পায়, আর হিন্দু ধর্মে একেবারেই পায় না। (অনেকে ভারতের উদাহরণ তুলে বলতে পারেন যে, ভারতে হিন্দু নারী-পুরুষ বাপের সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায়–এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, আমরা কথা বলছি ধর্ম নিয়ে, আর রাষ্ট্রীয় আইন ধর্ম নয়।) নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে ধর্ম থেকে আর বেশি উদাহরণ দিয়ে শুধু শুধু পোস্ট বড় করার মানে নেই, কারণ ধর্মের একটা ফুটাই যথেষ্ঠ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নারীবাদ নারী-পুরুষের যে সাম্য ও সমান অধিকারের কথা বলে সেটা প্রথাগত ধর্ম সমর্থন করে না।
৩) এবার বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। অনেকের মতে পোশাক-পরিচ্ছদ একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কে কতটুকু কাপড় পরবে, কে কতটুকু খুলবে–এগুলা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। (এই পর্যন্ত একমত।) এই হিসাবে বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর ইত্যাদিকেও ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ধরতে চান। কিন্তু বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর কি আসলেই ব্যক্তিগত, না কি এগুলা ধর্মীয় প্রথা? ধর্ম যদি না বলত তাহলে কি কেউ এগুলা পরত? ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কোনো নারী কি শাঁখা-সিঁদুর পরবে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী কোনো নারী কি বোরখা-হিজাব পরবে? বা কোনো অবিবাহিত হিন্দু নারী কি সবসময় শাঁখা-সিঁদুর পরে ঘুরে বেড়ায়? হ্যাঁ, কেউ কেউ মজা করে, বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে, বা অভিনয়ের সময় মাঝে মাঝে পরতে পারে–কিন্তু এগুলা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
৪) আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন‘ পড়ে আমরা কী করি? মুসলমানদের নিয়া হাসাহাসি করি। কেন করি? তাদের স্ববিরোধিতা বা হিপোক্রেসি দেখে। নাস্তিক তো বটেই, অনেক মুসলমানও এই ঘটনাগুলো দেখে হাসে।
এখন কেউ প্রথাগত আস্তিক হয়েও যদি আবার নারীবাদ সমর্থন করে–করতেই পারে… অর্থাৎ আস্তিক হয়েও নিজেকে আবার নারীবাদী বলতে পারে, বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর পরেও নারীবাদী সাজতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ওই আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’-এর মতোই স্ববিরোধী-হিপোক্রেসি। আস্তিক হয়ে বা বোরখা-হিজাব, শাঁখা-সিঁদুর পরে নারীবাদী হওয়া যায় কি না–সেই ব্যাপারে জাজমেন্টাল না হয়ে শুধু একটা কথাই বলা যায়– বিষয়টা শেষ পর্যন্ত হাস্যকর। (আপনার যেমন হাস্যকর হওয়ার অধিকার আছে, তেমনি হাস্যকর কোনো কিছু নিয়া হাসাহাসি করাও অধিকার আমার আছে।)
৫) আপনি নারী-পুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারে বিশ্বাস করেন, নারীবাদ সমর্থন করেন–কিন্তু আপনি যদি ওই ‘হাস্যকর’ টাইপের কেউ না হন, তাহলে ধরে নিচ্ছি আপনি নাস্তিক। অর্থাৎ আগে নাস্তিক, তারপর নারীবাদী… তাহলে অন্য কোনো নারীবাদীর কোনো কর্মকাণ্ড যদি আপনার কাছে আবলামী মনে হয়, তাহলে এই আবলামী ওই নারীবাদীর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার না মনে করে ওই আবলামিটাকে পুরা নারীবাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে নারীবাদ থেকে সরে যাওয়ার মতো আবলামি কেন করেন?
আর হুমায়ুন আজাদ বাংলায় এত সহজ করে নারীবাদ ও নারীবাদী-এর সংজ্ঞা বানিয়ে দেয়ার পরেও যারা বুঝেও না বোঝার ভান করেন বা মনে করেন যে–নারীবাদ হলো পুরুষতন্ত্রের মতোই আরেকটা ব্যাপার–নারীতন্ত্র, বা নারীবাদকে যারা পুরুষতন্ত্রের বিপরীত কিছু হিসাবে দেখেন বা দেখাতে চান, ভেবে দেখলাম–তাদেরকে গালি দেয়ার চাইতে তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করাই উত্তম।
Leave a Reply