কিষ্কিন্ধ্যা হলো রামায়ণে বর্ণিত বানরদের দেশবিশেষ বা তার রাজধানী। সুগ্রীবের বড়ভাই বালি এই দেশের রাজা। কিন্তু সুগ্রীবেরও ক্ষমতার লোভ। বালি এটা বুঝতে পারে। ছোট ভাই বলে একেবারে প্রাণে না মেরে রাজধানী থেকে তাড়িয়ে দেয়। সুগ্রীব তার সচিব হনুমান আর তার দলবল নিয়ে বাইরে চলে যায়।
রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলে রাম-লক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে এই কিষ্কিন্ধ্যায় এসে হাজির হলে সুগ্রীবের চোখে পড়ে। সুগ্রীব মনে করে তার বড়ভাই বালি তাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তচর পাঠিয়েছে। তখন হনুমান বলে, আগেই তথ্য না জেনে ভুল বোঝা ঠিক নয়। তাই সে খবর আনতে তপস্বীর বেশ ধরে রাম-লক্ষণের সামনে হাজির হয়–
যান হনুমান বীর তপস্বীর বেশে।
পরম গৌরব ভাবে উভয়ে সম্ভাষে।।
কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডর ২য় অধ্যায়ে দেখা যায়, হনুমানের সাথে রাম-লক্ষণের পরিচয় হয়। নিজেদের পরিচয় দেয়, সীতার হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী বলে। এবং এও বলে যে এক মুনি পরামর্শ দিয়েছে যে সুগ্রীব সীতার খোঁজ এনে দিতে পারে। তাই তারা সুগ্রীবের খোঁজ করছে। তখন হনুমান বলে, তুমি সুগ্রীবরে রাজ্য পাইয়ে দিলে সে-ও তোমার সীতারে উদ্ধার করে দেবে–
সুগ্রীব পাইবে রাজ্য সাহায্যে তোমার।
সুগ্রীব করিবে তব সীতার উদ্ধার।।
এই হলো সুগ্রীবের সাথে রামের চুক্তি।
এবার বালি আর সুগ্রীবের কাহিনী শোনা যাক–
বালি আর সুগ্রীব হলো অক্ষয় রাজার দুই ছেলে। রাজা মারা গেলে মন্ত্রীরা নিয়ম মেনে বড়ভাই বালিকে রাজা বানাইলো। সুগ্রীবের মুখেই শোনা যাক–
জ্যেষ্ঠ ভাই বালিরাজা বিক্রম-সাগর।
ধর্ম্মে কর্ম্মে সদা রত, সমরে তৎপর।।
মন্ত্রিগণ তাঁহারে দিলেন রাজ্যভার।
পরে বালি দিল মোরে রাজ্য-অধিকার।।
পরস্পর পরম সৌহৃদ্যে করি বাস।
না জানি বিরোধ, সদা হাস্য পরিহাস।।
–এখানে লক্ষ্যণীয়, সুগ্রীব নিজেই রামের কাছে বলতেছে যে তার বড়ভাই বালি ধার্মিক এবং সাহসী। ছোটভাইকেও বঞ্চিত না করে রাজ্যের অধিকার দিল। তারপর তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না, দুইজনেই শান্তিতে বাস করতে লাগল।
এরপর মায়াবী আর দুন্দুভি নামে দুই দানব রাজ্য আক্রমন করলে বালি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে যায়। সুগ্রীবকে পিছে পিছে আসতে বলে। দানব দুইটি একটি সুডঙ্গের ভিতর লুকালে বালি সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করে আর নিজে না ফেরা পর্যন্ত সুগ্রীবকে সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথে পাহারা দিতে বলে। ভিতরে বালি দুই দানবের সাথে যুদ্ধ করে। বাইরে থেকে সুগ্রীব ভিতরের চিৎকার শুনে মনে করে বালি মারা গেছে। সে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ পাথর দিয়ে বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে এসে প্রচার করে যে তার বড়ভাই বালি মারা গেছে এবং নিজে রাজা হয়ে বসে।
যুদ্ধশেষে বালি ফিরে এসে দেখে তার ভাই সুগ্রীব রাজা হয়ে বসে আছে। একে তো সে সুড়ঙ্গের দ্বার বন্ধ করে পালিয়ে এসেছে, তারপর আবার রাজ্যে এসে তাকে মৃত ঘোষণা করে রাজা হয়ে বসেছে–এসব দেখে বালি স্বাভাবিক ভাবেই রেগে যায় এবং সুগ্রীবকে তাড়িয়ে দেয়।
এরপরের কাহিনী দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর মত খুব সোজা–রাম দেখল সুগ্রীব-হনুমান ছাড়া সীতাকে উদ্ধার করা যাবে না। ওদিকে সুগ্রীবকে রাজা না বানালে সে-ও সীতা-উদ্ধারে সাহায্য করবে না। রাম প্রতিজ্ঞা করল বালিকে হত্যা করে সুগ্রীবকে রাজা বানাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পরামর্শ করা হলো যে সুগ্রীব বালির দরজায় গিয়ে আকথা-কুকথা বলে বালিকে ক্ষেপিয়ে দেবে। বালি বিরক্ত হয়ে বাইরে এসে সুগ্রীবের উপর চড়াও হবে। আর তখন গাছের আড়াল থেকে রাম এক বাণে বালিকে স্তব্ধ করে দেবে–
করিবে তোমার সঙ্গে সমর আরম্ভ।
এক বাণে বালিকে করিব আমি স্তব্ধ।।
প্লান মাফিক সব কিছুই হচ্ছিল। কিন্তু রাম ধনুকে বান সংযোজন করে যেই মারতে যাবে তখন দেখলে দুই ভাইয়ের চেহারা, বেশভূষা একই রকম। তখন কাকে মারতে কাকে মেরে ফেলেন, এই ভয় আর বান নিক্ষেপ করল না–
দেখেন শ্রীরাম বাণ করিয়া সন্ধান।
উভয়ের বেশ ভূষা বয়স সমান।।
চিনিতে নারেন রাম সুগ্রীব বানরে।
বালিকে মারিতে পাছে নিজ মিত্র মরে।।
ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো–বালির হাতে ভীষণ প্যাদানি খেলো সুগ্রীব। কিন্তু–
তখনি সে সুগ্রীবের বধিত পরাণ।
সহোদর ভাই বলি দিল প্রাণদান।।
অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে তখনি সুগ্রীবকে মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু আপন ভাই বলে প্রাণে না মেরে ছেড়ে দিল। সুগ্রীব ওই ফাঁকে পালিয়ে গেলো।
রাম পরে সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলল। তখন নতুন প্লান হয়–
চিহ্ন বিনা নাহি চেনা যায় সুগ্রীবেরে।
চিহ্ন দিতে শ্রীরাম কহেন লক্ষ্মণেরে।।
লক্ষ্মণ দিলেন পুষ্পমালা তার গলে।
করিলেন সাত বীর যাত্রা শুভকালে।।
অর্থাৎ, পরের দিন সুগ্রীবের গলায় মালা দিয়ে নিয়ে গেল যাতে মালা দেখে তাকে চেনা যায়। পরের দিন আবার একই ভাবে দুই ভাইয়ে মল্লযুদ্ধ লাগে। কিন্তু–
সুগ্রীব হইতে বালি দ্বিগুণ প্রখর।
একটি চাপড়ে তারে করিল কাতর।।
বাল বজ্রমুষ্টি যে মারিল তার বুকে।
অচেতন সুগ্রীব, শোণিত উঠে মুখে।।
সুগ্রীবের অচেতন দেখিয়া সম্মুখে।
শ্রীরাম ঐষিক বাণ যুড়েন ধনুকে।।
সশঙ্ক সুগ্রীব প্রায় করে পলায়ন।
আড়ে থাকি রাম বাণ করেন ক্ষেপণ।।
দশদিক আলো করি সেই বাণ ছুটে।
বজ্রাঘাত সম বাণ বালি-বক্ষে ফুটে।।
বুক ধরি বাল রাজা করে হাহাকার।
কোন্ জন করিল এ দারুণ প্রহার।।
বুকে পৃষ্ঠে ভার সে নাড়িতে নারে পাশ।
এক বাণে পড়ে বালি, ঘন বহে শ্বাস।।
পড়িলেক বালি রাজা ইন্দ্রের নন্দন।
গায়ের ভূষণ খসে, অঙ্গের বসন।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের থাকিল বিষাদ।
ধার্ম্মিক রামের কেন হইল প্রমাদ।।
রামায়ণের বাংলা অনুবাদক কৃত্তিবাস পণ্ডিত পর্যন্ত এই ঘটনায় অবাক হলেন! ওদিকে হিন্দুরা এহেন কুকর্মকে রামের অনেক বীরত্বপূর্ণ কাজ বলে উল্লেখ করে। তারা প্রচার করে যে বালি নাকি অধার্মিক, অসৎ, দুশ্চরিত্র সর্বোপরি একজন খারাপ মানুষ ছিলেন। কিন্তু এরকম কোনো কথা রামায়ণে পাওয়া যায় না, বরং শুরুতে ছোট ভাই সুগ্রীবের মুখেই বালির গুণকীর্তন করতে দেখা যায়। যে ভাই রাজা হওয়ার পরে ছোট ভাইকেও রাজ্যর ভাগ থেকে বঞ্চিত না করে রাজের অধিকার দিয়েছিল, বিপদ কালে সুগ্রীব সেই ভাই বালির কথা শোনে নাই, উলটা বিপদ বুঝে বড়ভাইকে একা ফেলে নিজে পালিয়ে এসেছিল, সব না জেনেই বড় ভাইয়ের শ্রাদ্ধ করে নিজে রাজা হয়ে বসেছিল। বালির একটাই দোষ, সে রাগ করে ছোট ভাইকে রাজধানী থেকে বের করে দেয়। আর এটাকে সুগ্রীব অপমান হিসাবে ধরে প্রতিশোধ নিতে বালিকে হত্যা করার প্লান করে!
বালির মহত্ব আরো অনেক বলার বাকি–বান বুকে নিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বালি রামচন্দ্রকে বলছেন–
বানর হইতে কার্য্য করিবে উদ্ধার।
তবে কেন আমারে না দিলে এই ভার।।
এক লাফে পারাবার হইতাম পার।
এক দিনে করিতাম সীতার উদ্ধার।।
এরকম মহৎ বালির মৃত্যুকে রাম আবার তুলনা করতেছে পশুবধের সাথে–
ঘাস খায়, বনে চরে, নাহি অপরাধ।
তবু মৃগ মারিতে রাজারা হয় ব্যাধ।।
অর্থাৎ, পশুরা ঘাস খায়, বনে চরে, কোনো অপরাধ নাই। তবুও রাজারা তাদের মারে। তাতে কোনো অপরাধ নাই! রাম আরো বলতেছে, তার হাতে মৃত্যু হয়ে বালি নাকি পাপমুক্ত হল এবং সে স্বর্গে যাবে!
পেয়েছিল রামচন্দ্র বালিকে বোকা।
স্বর্গ-মূলার লোভে দিল আরেক ধোকা।।।
পুনশ্চঃ বালির পাপ হিসাবে রাম বালির পরদার গ্রহণের কথা উল্লেখ করছে–
আমার রাজ্যেতে থাকি কর পরদার।
সেই পাপে মম রাজ্যে পাপের সঞ্চার।।
কার স্ত্রী হরণ করেছিল বালি? আমরা তো জানি সুগ্রীবই আগে বালির শ্রাদ্ধ করে বালির স্ত্রী তারাকে নিজের শয্যাসঙ্গিনী করেছিল। কেউ এটা একটু ক্লিয়ার করতে পারবেন?
Leave a Reply