লিখেছেন: ওমর ফারুক লুক্স
ঘটনাটা আপনাদের অনেকেরই বিশ্বাস হবে না; কিন্তু আমি এ রকম দেখেছি। উত্তর ও মধ্য ইউরোপের গ্রামাঞ্চলে এরকম ঘটনা এখনও অহরহ দেখা যায়। আপনারা যারা স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় থাকেন অথবা বেড়াতে এসেছিলেন, তারাও নিশ্চয়ই আমার মতো এমন ঘটনা দেখেছেন। ২০০৭ সালের গ্রীষ্মকাল। আমি তখন ইউনিভার্সিটির প্রজেক্টের কাজে দুই মাসের জন্য নরওয়ের টাঙ্গেন এ অবস্থান করছিলাম। পুরো সপ্তাহ পাথরের কাজ করতাম, সপ্তাহ শেষে উইকেন্ডে বেরিয়ে পড়তাম ড্রাইভে। অসলো থেকে লিলি-হামার, নদীর তীর ঘেষে আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে একটি। হাইওয়ে, মাঝে মাঝে আবার গ্রামের রাস্তা, ধীরে গাড়ি চালাতে হয়।
একবার একটা ফলের দোকান দেখে থামলাম, ভাবলাম কিছু তাজা ফল কিনে খাওয়া যাবে। রাস্তার পাশে টং এর মতো ছোট্ট একটা দোকান। দোকানে সাজানো আছে আঙ্গুর, স্ট্রবেরী, পীচ ফল সহ বিভিন্ন রকমারি ইউরোপীয়ান ফল আর পানীয়। টং এর মাঝখানে একটা ক্যাশবাক্স। বাক্সে কিছু টাকাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দোকানে কোন দোকানী নেই। একটু অবাক হলাম। রাস্তার পাশে এরকম খোলা দোকান, টাকাসহ খোলা ক্যাশবাক্স কিন্তু কোন দোকানী নেই,- এমন দৃশ্য আমি আগে দেখিনি। হাতে সময় ছিলো তাই ভাবলাম, পাগল দোকানদারটাকে খুঁজে বের করি। দোকানের পেছনে একটু দূরে একটা ছোট্ট বাড়ি, আশে পাশে আর কোন বাড়ী নেই। ভাবলাম, দোকানীকে এই বাড়ির ভেতরেই পাওয়া যেতে পারে। বাড়িতে ঢুকে ডাক দিতেই এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। ইংরেজীতে বললাম, এই ফলের দোকানটি কি আপনার? সে বললো, হ্যা। আমি বললাম, আমি কিছু ফল কিনতে চাচ্ছি, কিন্তু দোকানেতো কেউ নেই। বৃদ্ধ বললো, সব ফলেরই প্যাকেটে ওজন মেপে দাম লেখা আছে। দরকার মতো ফল নিয়ে হিসেব করে টাকা ক্যাশবাক্সে রেখে যাও। আমি খুব অবাক হলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি দোকানে নেই, এভাবে তোমার টাকা বা ফল কতটা নিরাপদ। সে বললো, নরওয়েতে এভাবেই কৃষকরা দোকানদারী করে। এই এলাকায় কোন চোর নেই। আজ পর্যন্ত আমার দোকান থেকে কিছু চুরি হয়নি। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে কিছু ফল নিয়ে বাক্সে টাকা রেখে চলে এলাম। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সেই বৃদ্ধ কৃষককে আমার শেষ প্রশ্নটি করার জন্য লজ্জাবোধ করি। বাঙ্গালী বলেই হয়তো আমার মাথায় এমন প্রশ্ন এসেছিলো। তারপর থেকে ইউরোপের রাস্তাঘাটে অসংখ্য সৎ এবং অন্যকে বিশ্বাস করার মতো মানুষ দেখেছি। কিন্তু তাকে কোন প্রশ্ন করিনি আপনি কেন সবাইকে বিশ্বাস করেন।
এবার আসি আসল কথায়, মানুষ নিজে সৎ হবে এবং অন্য সবাইকে বিশ্বাস করবে এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টোটা। কারণ, আমাদের দেশে অসৎ মানুষই বেশি। কেউ একজন তার ট্যাক্সিতে বা রাস্তায় অনেক টাকা বা মূল্যবান কিছু কুড়িয়ে পেলে সেটা ছবিসহ পত্রিকায় আসে। কিন্তু ইউরোপে বিশেষ করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় এটা হাস্যকার ঘটনা। কেউ টাকা বা গয়না পেলে তার মালিককে ফিরিয়ে দেবে বা পুলিশের কাছে জমা দেবে এটাই স্বাভাবিক। এটা পত্রিকায় আসার মতো খবর নয়। কেউ চুরি করেছে, সেটাই বরং পত্রিকায় আসার মতো ঘটনা। মানুষ ভালো কাজ করবে, সৎ জীবন যাপন করবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি জীবনে একবারও অসৎ কাজ করে সেটাই অস্বাভাবিক এবং সেটাই খবর।
Leave a Reply