লিখেছেনঃ ফারাজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা)
ঘটনা -১
আমার বয়স তখন ৫ বছর। খুব নিকট আত্মীয়ের একজন জাতীয় পার্টি করতেন। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের সব মেয়ে শিশুদের ভোরে এসে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য এরশাদ সেদিন কোন একটি সভায় যোগ দিবেন। আর সে সভায় শিশুরা তার গলায় পরিয়ে দেবে ফুলের মালা। এরশাদের সকাল ৮টার সময় আসার কথা। তাই ভোর ৬টায় ঘুম থেকে তুলে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলেন তিনি। খু্ব কাছের আত্মীয় বলে আব্বু-আম্মু না করতে পারলেন না। সবাই সবচেয়ে সুন্দর জামা পড়ে এরশাদের গলায় ফুলের মালা দিতে গেলাম। অপেক্ষা করছি আর করছি, এরশাদ তো আর আসেন না। তিনি এলেন সকাল ১১টার সময়। তারপর দেখলাম, আমরা শিশুরা সব বসে আছি, আমাদেরকে আর এরশাদের গলায় মালা দিতে ডাকা হলো না, চাটুকারেরা নিজেরাই এরশাদের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। আমরা এতগুলো শিশু রোদের মাঝে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম এরশাদের জন্য, এরশাদের তা চোখেই পড়লো না। তিনি ফুলের মালা গলায় নিয়ে ঘন্টাব্যাপী ভাষণ দিতে শুরু করলেন। তবে ভাগ্যিস, সেদিন আমাকে মালা পরাতে হয়নি, নতুবা সারাজীবন মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণাবোধ থাকতো।
ঘটনা – ২
সময়টা ১৯৯০ সাল। চারিদিকে কেন যেন ভীষণ হৈ চৈ। মামারা ছুটে বাসা থেকে নেমে যায়। পুলিশকে ঢিল মেরে এসে আবার দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়। কখনও কখনও টিএসসির সামনে অথবা জিরো পয়েন্টের মন্চ্ঞে গান গায়, ”এরশাদ গেলো এরশাদ গোলো, লোটা কম্বল লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বনে”; অত বুঝতে পারতাম না; শুধু বুঝতাম হরতাল আর ১৪৪ ধারা নামের কি যেন চলছে, রাস্তায় যাওয়া যাবে না। বাসায় কিছু ম্যাগাজিন আসে এরশাদের ছবি সহ। ছোটদের পড়া নিষেধ। নিষেধ বললে, আগ্রহ যেন আরো বাড়ে। খাটের নীচে বসে এরশাদ কে নিয়ে লেখা জিনাত – মরিয়মের কাহিনী পড়া বা ব্যাঙ্গ করা কার্টুন দেখে কিছুই বুঝতাম না; কেন বড়রা এসব দেখে হাসাহাসি করেন। দেশের নাকি হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছেন এরশাদ। দেশের টাকা চুরি কিভাবে করে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতাম। একদিন শুনলাম ডাঃ মিলন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। আন্দোলন নাকি আরো প্রখর হয়। একদিন খবরের কাগজে দেখলাম নূর হোসেনের পিঠে লেখা ”গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক”; এই নূর হোসেনকে নাকি গুলি করে মেরে ফেলেছে কারা!! মাকে জিজ্ঞাসা করলাম স্বৈরাচার কি মা? মা যা বুঝালেন আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। একদিন খুব ভোরে মামা আর বাবা চিৎকার করে রাস্তায় নেমে গেলেন। বললেন, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল। আমার ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো। দুটো পরীক্ষা আন্দোলনের কারনে দিতে হলো না। আমি এতেই খুশী ছিলাম।
ঘটনা -৩
১৯৯৭ সাল। আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী। যেই মামা এরশাদের পতন ঘটানোর আন্দোলনে নেমেছিলেন তার বিয়ে। বিদেশ থেকে ৭ বছর পর ফিরলেন। মামা বিয়ে করতে দেশে এসেছেন। ঐ সময় চারিদিকে বিয়ের ধুম পড়েছে। মামার বউভাতের জন্য কোন কমিউনিটি সেন্টার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সব রিজার্ভড। আর মামার কেন যেন বদ্ধ কমিউনিটি সেন্টার পছন্দ না। বিদেশ বিদেশ ভাব। যাই হোক, আমি মামাকে বললাম, চলো চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট ভাড়া করি। গেলাম, পরিচিত চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট রমনা রেস্তোরায়। বন্ধুরা সবাই আড্ডা দিতাম একসময়। মামার বেশ পছন্দ হলো। ঠিক করা হলো, রমনা রেস্তোরায় চাইনিজ নয়, বরং কন্টিনেন্টাল খাবার সার্ভ করা হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পুরো রেষ্টুরেন্ট ভাড়া করলাম আমরা।
বউ ভাতের দিন গিয়ে দেখি রেষ্টুরেন্টের ঝিলের পাশের দিকটা কারা যেন দখল করেছে। রেষ্টুরেন্টের ম্যানেজার, আমাদের কাছে এসে ক্ষমা চাইছেন। বললেন, আর বলবেন না ম্যাডাম এক্স রাষ্ট্রপতি সাহেব নিজে ফোন করলেন, না করতে পারলাম না, একটু এডজাষ্ট করে নেন প্লীজ। স্যার, আপনার সঙ্গে পারসোনালি কথা বলতে চায়। আমিতো রেগে চিৎকার করতে করতে বাসায় ফোন দিলাম। সর্বনাশ হয়েছে, মামার বিয়ের অনুষ্ঠানে এরশাদ এসছে। মামা নিশ্চয়ই আমার উপর রেগে যাবেন। মামাও বউকে নিয়ে পারলারে গেছেন। আসতে দেরী করছেন, আমি গেষ্ট রিসিভ করছি আর কটকট করে এরশাদের দিকে তাকাচ্ছি। এরশাদ আমার কাছে এসে বললেন, আর এক ঘন্টার মধ্যে আমরা চলে যাব। আমি কোন কথা না বলে মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর সেই নিকট আত্মীয় চলে এসেছেন, এরশাদকে জ্বী স্যার, জ্বী স্যার করছেন। আর আমি রাগে কাঁপছি। কিছুক্ষণ পর এরশাদ আমার কাছে এসে মিষ্টি হেসে বলেন, আপনার বিয়ের কি হলো? আমি ভীষণ রেগে বললাম, আমার বিয়ে না, মামার বিয়ে। আবারো মৃদু হেসে চলে গেলেন এরশাদ। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস গেল, মামা আসার আগে। মামা এলেন মামীকে সঙ্গে নিয়ে। বললাম, জানো নাতো এরশাদ এসেছিলো। আমি বলেছি যত তাড়াতাড়ি পারেন, এখান থেকে চলে যান। মামা বললেন, কই ভিডিও করেছো? আমি বললাম, কাকে? মামা বললেন, কেন এরশাদকে? আমি বললাম, আমি ভিডিওম্যানকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম, যেন এরশাদের কোন ফুটেজ না থাকে। মামা বললেন, খুব খারাপ করেছো। জানো এক্স প্রেসিডেন্ট আমার বউ ভাতের ভিডিওতে থাকলে কত প্রেসটিজের ব্যাপার হতো। আমি আর মামার বউভাতে আনন্দ করতে পারলাম না সেদিন। মামাকে কেমন অচেনা মনে হলো।
ঘটনা – ৫
আবারো রাষ্ট্রপতি হয়ে ইসলামের সেবা করতে চান এরশাদ। আজ এরশাদ হেফাজতিদের পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। শাহবাগে যা হয় তা নাকি বেদায়াতি কারবার। ইসলামকে পছন্দ না করলে তাদের দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে বলেন এরশাদ। এরশাদ সঙ্গে নিয়ে বর্তমান সরকার জোট গঠন করে, আর এরশাদ প্রেসিডেন্ট পদ না পাওয়ায়, সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দিতে চান। ব্লগারদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান এরশাদ।
সমাপ্তি : ছেলেবেলা থেকে এরশাদকে স্বৈরাচারী, স্বার্থপর আর খারাপ মানুষ হিসেবে দেখে এসেছি আমি। আজো এরশাদকে দেখলে কেন যেন নাক মুখ কুঁচকে যায়। মনে হয়, আমার সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষটাকে দেখছি। বিষাক্ত সাপকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু এরশাদকে বিশ্বাস করা যায় না। এরশাদেরা কখনোই দেশকে ভালবাসেনা। নিজের স্বার্থে দেশের যেকোন সর্বনাশ তারা মানুষকে বোকা বানিয়ে হাসি মুখে করেন। এই এরশাদরা আমার দেশের মানুষকে আর কতদিন বোকা বানিয়ে লুটপাট করবে আমি তা জানি না।
https://www.facebook.com/khansnigdha/posts/10151541772208104
Leave a Reply