লিখেছেন- আসিফ মহিউদ্দীন
শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বইমেলা, বাংলা একাডেমী এই বিষয়গুলো বাঙালীর অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। গতবেশ কয়েকবছর ধরেই দেখছি, আমাদের এই বিষয়গুলোকে ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে আমাদের একটি বাণিজ্যমনা প্রজন্ম সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইদানিং গ্রামীন ফোন, ওয়ারিদ, বাংলা লিঙ্কের মত রক্তচোষা গোষ্ঠীগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনকে বিক্রি করে পকেট ভারী করবার চেষ্টা করছে, করেই চলেছে।
আমাদের বাণিজ্যিক অপন্যাসিকরা ক্রমাগত অপন্যাস লিখে কামিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা, বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সব দখল করছে ধীরে ধীরে। আমি নিশ্চিত, কিছুদিন পরে সস্তা সাহিত্যিকরা বিভিন্ন কোম্পানীর টিশার্ট পরে বই মেলায় ঘুরবে, সেই কোম্পানীর পক্ষে প্রচার চালাবে। এরপরে তারা ভাষা শহীদদের দখলে নেবে। শহীদ বরকতকে কিনে নেবে গ্রামীন ফোন, দেখা দেখি শহীদ জব্বারকে কিনবে বাংলালিঙ্ক। এরপরে বিজ্ঞাপন আসবে, “শহীদ বরকতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চান? এখুনি ‘sroddha’ লিখে মেসেজ করুন 1952 নম্বরে। আপনার শ্রদ্ধা পৌছে যাবে শহীদ বরকতের কাছে মাত্র দুইটাকা ৩০ পয়সার বিনিময়ে”।
অথবা “শহীদ মিনারে ফুল দিতে চান? আপনার আর ভীড় ঠেলে শহীদ মিনারে যেতে হবে না। আপনি ঘরে বসে এসএমএস করুন, বাংলালিঙ্ক আপনার ফুল পৌছে দেবে শহীদ মিনারে”।
বাণিজ্য বাণিজ্য এবং বাণিজ্য!!! আমরা কি কিছু বিষয় টাকাপয়সা আর বাণিজ্য থেকে উপরে রাখতে পারি না?
আপনারা যারা ব্যাবসায়ী মহল আছেন, অনুগ্রহ করে আপনাদের টাকা কামাবার ধান্ধা আপনাদের কাছেই রাখুন। জনাবদের প্রতি সবিনয়ে অনুরোধ, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি আপনাদের “প্রডাক্ট” নয়, আমাদের আবেগ আপনাদের বিক্রি বাড়াবার উপকরণ নয়। দয়া করে অফ যান।
সহব্লগার আরিফ জেবতিক বিডিনিউজে একটি কলাম লিখেছেন। সেখানে লেখা কয়েকটি লাইন দৃষ্টি আকর্ষণের দাবী রাখেঃ
“স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে এই বইমেলাকে রাজধানীর আগারগাও অঞ্চলে নিয়ে আসা। আগারগাও এলাকাকে ঘিরে মেলার বলয় তৈরি হয়েছে। দেশের সবচাইতে বড় মেলা-আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলা আয়োজিত হয় এখানে। এর বাইরে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে সারাবছর জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠের নানান মেলা তো লেগেই আছে। পাশের আইডিবি ভবনে সফটওয়্যার ও কম্পিউটার সামগ্রীর মেলা আরেকটি বড় বার্ষিক আয়োজন, যেখানে প্রতিবছরই বিপুল লোক সমাগম হয়। সব মিলিয়ে আগারগাও এলাকা মেলার জন্য ঢাকা শহরের একটি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।”
অর্থাৎ আমরা বুঝলাম, এখন থেকে আমাদের বইমেলাকে বাণিজ্যমেলার জায়গায় বইমেলার আয়োজন করতে হবে। অর্থাৎ বইমেলা হয়ে উঠবে দ্বিতীয় স্তরের বাণিজ্যমেলা, বাণিজ্যমেলার বি-টিম। বেশ বেশ!
আরিফ জেবতিক আরো বলেছেনঃ
” একুশে বইমেলার নতুন ব্যবস্থাপক হিসেবে বানিজ্য মন্ত্রনালয়কে ভাবা যেতে পারে। মেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য বানিজ্য এবং বই পণ্য হিসেবেই প্রকাশিত হয়, সুতরাং এই মেলা আয়োজনের দায়িত্বটা বানিজ্য মন্ত্রনালয়কে দেয়া উচিত। ”
বইমেলা সরিয়ে নেবার আরো কিছু কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, বইমেলায় এত লোকের জায়গা হচ্ছে না। তাকে সবিনয়ে জানাচ্ছি, শহীদ মিনারে ২১ এর প্রথম প্রহরে ফুল দেবার সময়ও এত লোকের জায়গা হয় না। তা এই বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞ মতামত কি হবে? শহীদ মিনারকে কোথায় স্থানন্তর করলে আপনার মনমতো হয়?
আরিফ জেবতিক সাহেব ব্যাবসায়ী মানুষ, তিনি আমার চাইতে ব্যাবসা অবশ্যই বহুগুন ভাল বোঝেন। কিভাবে বই বেচতে হয়, কিভাবে পাঠক আকর্ষণ করতে হয়, এই সব বিষয়ে তিনি অবশ্যই অভিজ্ঞ মানুষ সন্দেহ নাই। কিন্তু তাকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি, আমাদের প্রবল আবেগের এই জায়গাগুলো অন্তত বাণিজ্যমুক্ত রাখুন। দয়া করুন।
বইমেলা আলু পটল বেচবার জায়গা নয় যে টুকরীতে বই নিয়ে আজ এখানে, আবার কেউ এসে খেদিয়ে দিলে কাল ওখানে বই বেচে বেড়াতে হবে। পাঠক(খদ্দের) ধরা, বই গছানো, অপন্যাস লিখে বিক্রি বাড়ানো, বুদ্ধিবৃত্তিক বেশ্যাবৃত্তি করে টাকা কামানো, মার মার কাট কাট ব্যাবসা করা বইমেলার কিছু প্রকাশকের কাছে মূল উদ্দেশ্য হতে পারে, তবে বাঙালীর কাছে বইমেলার আবেগ অন্যরকম। বইমেলা কোন বাণিজ্যমেলা নয়, কোন কম্পিউটার মেলা নয়। আমাদের ভাষা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি কোন বাণিজ্যিক উপকরণ নয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বইমেলাকে নিয়ে যে কোন ষড়যন্ত্র বাঙালী রুখে দেবেই।
আপনার কিছু বক্তব্যের সাথে আমি একমত, যে বইমেলার অব্যবস্থাপনার একটা প্রতিকার অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু বইমেলাকে এইভাবে ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদ আমার অবশ্যই জানাতে হবে। আপনার বেশিরভাগ বক্তব্যের আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে আমাদের শেকড়গুলোকে গ্রামীন ফোন, ওয়ারিদ, বাংলালিঙ্কের মত রক্তচোষা কোম্পানী গুলোর অনবরত বাণিজ্যিকীকরণের নিন্দা জানাচ্ছি।
Leave a Reply