মানব সভ্যতার আজকের যেই উৎকর্ষ, এই বিপুল সম্ভাবনাময় মানব সম্প্রদায় সর্বক্ষেত্রে যেভাবে পুরো পৃথিবী জয় করেছে, এই পর্যন্ত আসতে আসতে সবসময়ই দুটো প্রশ্নের উত্তর তাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে। সে দুটো হচ্ছেঃ
১) আমরা(মানুষ) কোথা থেকে এসেছি, আর কোথায় যাবো?
২) আমরা এখানে এসেছি, এখন আমরা কি করবো? আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি?
এই দুই প্রশ্ন কোন সাধারণ প্রশ্ন নয়, মানুষের অস্তিত্বের সাথে জড়িত এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর অত্যন্ত জটিল এবং দুর্বোধ্য মানব মস্তিষ্ক বিভিন্নভাবে দিয়েছে, এখনও দিয়ে যাচ্ছে। এই দুই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে করতে মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছে সাহিত্য, সৃষ্টি করেছে কবিতা। এই দুই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে গিয়ে তারা সৃষ্টি করেছে ধর্ম, সৃষ্টি করেছে বিজ্ঞান। এই দুই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে সমাজ গঠন করেছে, রাষ্ট্র তৈরি করেছে, আইন তৈরি করেছে। এই দুই প্রশ্নের উপরেই সৃষ্টি হয়েছে দর্শন, সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞান।
আমরা দেখি আমাদের শিশুদের দেখা শোনার জন্য সর্বদাই একজন লোক দরকার হয়, সেই কাজের বুয়া বা লোকটি শিশুটিকে পানির কাছে যেতে দেয় না, আগুনের পাশে যেতে দেয় না। একজন শিশুর জন্য তার পাশে অবশ্যই একজন অভিভাবক প্রয়োজন। নাহলে অপরিণত মস্তিষ্কের, বুদ্ধির শিশুটি যেকোন বিপদে পরতে পারে।
মানব সভ্যতা যখন শিশু ছিল, অপরিণত এবং অজ্ঞান ছিল, তখন তার প্রয়োজন হয়েছে ধর্মের। ধর্ম একটা দীর্ঘ সময় মানুষের অভিভাবকত্ব করেছে, তাকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সেই সময়ে ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। মূলত, ধর্ম মানুষকে বুঝিয়েছে যে, সে মানব সভ্যতার এই দুই মূল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রবর্তকরা তাদের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছে কল্পকাহিনী, বানিয়েছে কল্পিত আল্লা-ভগবান-ঈশ্বর। রচনা করেছে আদম হাওয়া গন্ধমের উপাখ্যান, অথবা জিউস হেরা এপোলোদের স্বর্গ, অথবা শিব কৃষ্ণ দুর্গার গল্প।
ধর্ম আমাদের জানাচ্ছে, ধর্ম আমাদের এই দুই মূল প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি দিয়েছে। তারা বলছে, আমরা স্বর্গ থেকে এসেছে এবং স্বর্গ বা নরকে ফিরে যাবো। এবং আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ঈশ্বরের জয়গান করা, তার তোষামদি করা।
কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, ধর্মের বর্ণিত এই উত্তরগুলো আদৌ সঠিক নয়। এই পর্যন্ত যতগুলো ধর্ম এবং ধর্মপুস্তক এসেছে, সবগুলোই ভুলে ভরপুর, এবং সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক একটা ধর্ম এক একটা সময়ে এসেছে। বাইবেল কোরআন গীতায় কখনই ডায়নোসরদের কথা বর্নিত থাকার কথা নয়। কারণ বাইবেল কোরআন গীতার অনেক পরে ডায়নোসর আবিষ্কার হয়েছে। অথচ ঈশ্বরের এত বিশাল অপুর্ব এক সৃষ্টির কথা এই সকল ধর্মগ্রন্থের কোথাও উল্লেখ হয় নি, সেটা হতেই পারে না। এই সময়ে যদি কোন ধর্মগ্রন্থ নাজিল হয়, অবশ্যই সেখানে ডায়নোসরের কথা চলে আসবে। অর্থাৎ ঈশ্বর সে সময়ে জানতেন না যে তিনি একদা ডায়নোসর নামের কিছু প্রানী সৃষ্টি করেছিলেন!
আবার কোন ধর্মগ্রন্থেই সরাসরি বলা নেই, পৃথিবী গোল, এবং পৃথিবী সুর্যের চারিদিকে ঘুরছে। অথবা আলোর গতি কত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞানীগন গলদঘর্ম হয়ে এক একটা বিষয় আবিষ্কারের ঠিক কদিন পরেই ধার্মিকগন তাদের ধর্মপুস্তকে ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন। এই পর্যন্ত ধর্মপুস্তক থেকে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয় নি, ধর্মপুস্তক কোন নোবেল পায় নি। তাই বুঝতে বাকি থাকে না যে ধর্মপুস্তকগুলো শুধুই সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত কিছু উপদেশ গ্রন্থ ভিন্ন কিছু নয়।
মানব সভ্যতার এই দুই প্রশ্নের উত্তরে ধর্মগুলো আমাদের যা জানাচ্ছে, আমার মতে সেসব অর্থহীন বালখিল্য ছাড়া আর কিছুই না। হ্যা, সেগুলো গল্প হিসেবে চমৎকার তাতে কোন সন্দেহ নাই। আমার খুব ভাল লাগে আদম হাওয়ার গল্প পড়তে, এবং মহাভারত রামায়ন বাইবেল কোরআন সবই আমার অত্যন্ত প্রিয় রুপকথার বই। এবং যদি সত্যিই ঈশ্বর বলে একজন ভদ্রলোক আকাশে আরশে বসে আমাদের দেখভাল করতো এবং আমাদের প্রার্থণা অনুসারে আমাদের ফলাফল দিতো, আমি অবশ্যই খুব খুশি হতাম। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এইগুলো সবই রুপকথা। শিশুদের জন্য এই রুপকথাগুলো অবশ্যই ভাল, তবে প্রাপ্তবয়ষ্ক কেউ এই সব রুপকথায় বিশ্বাস করে কোন কল্পিত ঈশ্বরকে সারাদিন ধরে স্তুতি, তোষামদি করতে থাকলে তার মানসিক বুদ্ধি নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলবো।
সবচাইতে সমস্যায় পরতে হয় তখনি, যখন ধর্ম নিজেকে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের রক্ষক বলে ঘোষণা করে। আমি আমার নৈতিকতা কোন কোরআন হাদিস থেকে শিখতে রাজি নই। আমি একজন সামাজিক মানুষ, এবং মনে করি, অন্যের ক্ষতি না করে নিজের অধিকার সমুহকে উপভোগ করার সমস্ত অধিকার আমার রয়েছে। নৈতিকতার শিক্ষার জন্য আমাকে মসজিদে ছুটতে হয় নি, আমাকে টুপি পরা মোল্লা বা টিকিওয়ালা পুরোহিতদের দারস্থ হতে হয় নি। আমি জানি একটা মেয়েকে ধর্ষণ করা অন্যায়, আমি জানি একজন ক্ষুধার্তকে খাবার দেয়া ভাল কাজ। এই বিষয়গুলো জানার জন্য আমাকে কোরআন হাদিস বাইবেল গীতা খুলে সারাদিন বসে খুঁজে দেখতে হয় নি। পেছনের পকেটে কোরান হাদিস নিয়ে ঘুরতে হয় নি, একটু পর পর কোরান খুলে দেখতে হয় নি এই বিষয়ে কোরানে কি বলা আছে। আমি একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে জানি কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়।
আর ধর্ম যখন নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের স্বঘোষিত রক্ষক বনে যায়, আমরা দেখি একজন নারীকে শরীয়া আইনের নামে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলতে, আমরা দেখি উইচ হান্টের নামে একজন নারীকে পুড়িয়ে মারতে, আমরা দেখি সতিদাহের নামে একজন নারীকে মৃতস্বামীর চিতায় তুলে দিতে। আমরা দেখি আল্লা-ঈশ্বর-ভগবানের রাজত্ব কায়েমের নামে জিহাদ ক্রুসেড বা শিবসেনাদের হুংকার, আমরা দেখি গনিমতের মাল নাম দিয়ে যুদ্ধবন্দীদের ধর্ষণ, আমরা এরকম হাজারো বিষয় দেখি, এবং দেখে দেখে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।
আমার মতে মানব সভ্যতা এখন প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়েছে। তার হাত ধরে তাকে ঠিক বেঠিক বুঝিয়ে দেবার জন্য কোন ধর্মের প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ দেখা যাচ্ছে, ধর্মের মন্দ দিকগুলো ক্রমশই ভাল দিক গুলোরকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা মূল্যবোধের রক্ষক হিসেবে ধর্ম বহুকাল আগেই নিজের গুরুত্ব হারিয়েছে। এখন আমাদের ঐ দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে, বিশেষ করে বিজ্ঞান এবং দর্শনে। কারণ ধর্ম যেই উত্তরগুলো দিচ্ছে সেগুলো আদৌ কোন উত্তর নয়, এক ধরণের প্রবোধ।
–আসিফ মহিউদ্দীন
Wednesday, February 8, 2012 at 12:20pm
http://www.facebook.com/atheist.asif/posts/310432439004191
Leave a Reply