হুতোমপ্যাঁচার ভাগ্য ভালো–কিন্তু এ কথা কেন মনে হইল যে হুতোমপ্যাঁচার ভাগ্য ভালো?
//বেশ্যাবাজীটি আজকাল এ সহরে বাহাদুরীর কাজ ও বড়মানুষের এলবাত পোষাকের মধ্যে গণ্য। অনেক বড়মানুষ বহুকাল হলো মরে গেচেন, কিন্তু তাদের রক্ষিতার বাড়ীগুলি আজও মনুমেন্টের মত তাঁদের স্মরণার্থে রয়েছে—সেই তেতলা কি দোতলা বাড়ীটি ভিন্ন তাদের জীবনে আর এমন কিছু কাজ হয় নি, যা দেখে সাধারণে তাদের স্মরণ করে। কলকেতার অনেক প্রকৃত হিন্দু দলপতি ও রাজারাজড়ারা রাত্রে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখেন না। বাড়ীর প্রধান আমলা, দাওয়ান মুচ্ছুদ্দিরা যেমন হুজুরদের হয়ে বিষয় কৰ্ম্ম দেখেন—স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাঁদের উপর আইন মত অর্শায়, সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন? এই ভয়ে কোন কোন বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ীর ভিতরের ঘরে পূরে চাবি বন্ধ করে বাইরের বৈঠকথানায় সারা রাত্রি অবিদ্যা নিয়ে আমোদ করেন, তোপ পড়ে গেলে ফরসা হবার পূর্ব্বে গাড়ী বা পাল্কী করে বিবিসাহেব বিদায় হন—বাবু বাড়ীর ভিতর গিয়ে শয়ন করেন।–স্ত্রীও চাবি হতে পরিত্রাণ পান। ছোকরাগোছের কোন কোন বাবুরা বাপ-মার ভয়ে আপনার শোবার ঘরে স্ত্রীকে একাকিনী ফেলে আপনি বেরিয়ে যান; মধ্য রাত্রি কেটে গেলে বাবু আমোদ লুটে ফেরেন ও বাড়ীতে এসে চুপি চুপি শোবার ঘরের দরজায় ঘা মারেন, দরজা খোলা পেলে বাবু শয়ন করেন। বাড়ীর আর কেউই টের পায় না যে, বাবু রাত্রে ঘরে থাকেন না। পাঠকগণ! যারা ছেলে বেলা থেকে “ধৰ্ম্ম যে কার নাম, তা শোনে নি, হিতাহিত বিবেচনার সঙ্গে যাদের সুদূর সম্পর্ক, কতকগুলি হতভাগা মোসাহেবই যাদের হাল” তারা যে এই রকম পশুবৎ কদাচারে রত থাকবে, এ বড় আশ্চাৰ্য নয়! কলকেতা সহর এই মহাপুরুষদের জন্য বেশ্যাসহর হয়ে পড়েছে, এমন পাড়া নাই, যেখানে অন্তত দশ ঘর বেশ্যা নাই, হেয় প্রতি বৎসর বেশ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে বই কমছে না। এমন কি, এক জন বড়মানুষের বাড়ীর পাশে একটি গৃহস্থের সুন্দরী বউ কি মেয়ে বার কবার যো নাই, তা হলে দশ দিনেই সেই সুন্দরী টাকা ও সুখের লোভে কুলে জলাঞ্জলি দেবে—যত দিন সুন্দরী বাবুর মনস্কামনা পূর্ণ না করবে, তত দিন দেখতে পাবেন, বাবু অষ্ট প্রহর বাড়ীর ছাদের উপর কি বারান্দাতেই আছেন, কখন হাসচেন, কখন টাকার তোড়া নিয়ে ইসারা কোরে দেখাচ্চেন। এ ভিন্ন মোসাহেবদেরও নিস্তার নাই; তাঁরা যত দিন তাঁরে বাবুর কাছে না আনতে পারেন, ততদিন মহাদায়গ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, হয় ত সে কালের নবাবদের মতে “জান বাচ্চা এক গাড়” হবার হুকুম হয়েচে! ক্রমে কলে কৌশলে সেই সাধ্বী স্ত্রী বা কুমারীর ধর্ম্ম নষ্ট করে শেষে তাড়িয়ে দেওয়া হবে—তখন বাজারে কশার করাই তার অনন্যগতি হয়ে পড়ে! শুধুই এই নয়, সহরের বড় মানুষেরা অনেকে এমনি লম্পট যে স্ত্রী ও রক্ষিত মেয়েমানুষ-ভোগেও সন্তুষ্ট নন, তাতেও সেই নরাধম রাক্ষসদের কাম-ক্ষুধাও নিবৃত্তি হয় না—শেষে আত্মীয়া যুবতীরাও তার ভোগে লাগে।–এতে কত সতী আত্মহত্যা করে, বিষ খেয়ে এই মহাপাপীদের হাত এড়িয়েছে। আমরা বেশ জানি, অনেক বড়মানুষের বাড়ী মাসে একটি করে প্রাণহত্যা হয় ও রক্তকম্বলের শিকড়, চিতের ডাল ও করবীর ছালের নুন-তেলের মত উঠনো বরাদ্দ আছে। যেখানে হিন্দুধর্মের অধিক ভড়ং, যেখানে দলাদলির অধিক ঘোঁট ও ভদ্দরলোকের অধিক কুৎসা, প্রায় সেখানেই ভিতর বাগে উদোম এলো, কিন্তু বাইরে পাদে গেরো! //
===========
১) প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে কালীপ্রসন্ন সিংহ এগুলা লিখেছিলেন। বলাই বাহুল্য, এগুলা তার মতো মানুষও স্বনামে লিখতে সাহস করেন নাই। ‘হুতোমপ্যাঁচা’ ছদ্মনামে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। হ্যাঁ, উপরের অংশটুকু ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘ থেকে নেয়া।
২) যাদের কারণে কালীপ্রসন্ন সিংহ ছদ্মনামে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ‘পেতাত্মা’গুলো আজো বেঁচে আছে–ফেসবুকে তারা প্রায়ই হুমকি দেয়–পারলে আসল নামে লেখেন, পারলে নাম ছবি ঠিকানা দেন, পারলে সামনে আসেন… ছদ্মনাম নিয়ে এদের বহুত চুলকানি…
৩) তখনকার দিনের কোলকাতা শহরটা কীভাবে একটা ‘বেশ্যাসহর’ হয়ে পড়েছিল, তার স্পষ্ট বিবরণ আছে এখানে। এছাড়া কীভাবে বেশ্যাদের সংখ্যা বাড়তেছিল, তাও স্পষ্ট। এছাড়া তাদের স্ত্রীরা কেন বহুগামী হত, তারও কিছু কারণ বুঝতে পারার কথা।
৪) সবচেয়ে মজার ব্যাপার–অন্দরমহলে স্ত্রী, বাইরের মহলে রক্ষিতা, পাড়ার দশ-বারো ঘর বেশ্যা ভোগ করেও তখনকার পুরুষেরা সন্তুষ্ট হত না। (সব পুরুষ এক না।) তারপরে তার নজর দিত নিজেদের আত্মীয়া যুবতীদের দিকে… সেইসব পুরুষদের রক্তবীজেরা আজো জেলায়-জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায় পতিতালয় খোলার পক্ষে…আজো পতিতাবৃত্তি পেশাটা চালু রাখার পক্ষে উকলাতি করে যাচ্ছে… ধর্ষণ ঠেকাতে যখন এরা পতিতাবৃত্তির পক্ষে কথা বলে, তখন শুনতে খারাপ লাগলেও প্রশ্নটা না করে পারি না–এদের ঘরে-ঘরে পতিতালয় আছে বলেই কি তারা ঘরের বাইরে এখনো “ধর্ষক” হয়ে ওঠে নি?
৫) কালীপ্রসন্ন সিংহের ভাগ্য ভালো যে, তার জানাশোনা ওই ‘আত্মীয়া’ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। হয়তো অকালে মারা না গেলে আরো গভীরে জানাশোনা হতো–জানতে পারতেন ভাই কীভাবে বোনকে ধর্ষণ করছে, বাপ কীভাবে কন্যাকে ধর্ষণ করছে… (ওহ সরি, ভুলে গেছিলাম, যোগ করে দিচ্ছি–সব ভাই এক না… সব বাবা এক না… সব পুরুষ এক নয়…)
Leave a Reply