এ এক অদ্ভুদ দ্বন্দ্ব!
কোথাও উল্লেখ নাই যে বড় হুজুর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার উম্মতদের দাবী–যেহেতু কোরান তার ওপর নাজির হয়েছিল, তাই তিনি অটোমেটিক মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। অথবা যদি বলা হয়–বড় হুজুর দাসী মারিয়াকে বিয়ে করেছিলেন, এমন দলিল নাই, তাহলে তারা বলবে–যেহেতু বড় হুজুর মারিয়াকে সুদে পেট বানিয়ে দিয়েছিলেন, তাই তেনার সাথে মারিয়ার অটোমেটিক বিয়ে হয়ে গেছে।
২) তর্কের খাতিরে যদি প্রশ্ন তোলা হয়–হুয়ায়ুন আজাদ নারীবাদী ছিলেন কি না–তাহলে অনেকেই মতামত দিবেন যে–তিনি নারী ও দ্বিতীয় লিঙ্গের মতো নারীবাদী বই লিখেছেন, অতএব তিনি নারীবাদী। নারীবাদ বিষয়ে প্রথমেই হুমায়ুন আজাদকে টানতে বাধ্য হই, কারণ নারীবাদের এত সহজ-সরল সংজ্ঞা এর আগে আর কোথাও পাই নাই, পাইলেও মনে ধরে নাই। নারী বইতে তিনি বলেছেন (অথবা অনুবাদ করেছেন)–নারী-পুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারে যিনি বিশ্বাস করেন, তিনিই নারীবাদী।–এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য–মানুষকে নারী আর পুরুষে–দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ভাগটা না করে যদি এভাবে প্রশ্ন রাখা হয় হয়–মানুষে-মানুষের সাম্য ও সমান অধিকারে যিনি বিশ্বাস করেন, তাকে কী বলে? (এখানে মানুষ বলতে নারী, পুরুষ, শিশু–সবাইকে বোঝানো হয়েছে। আরো সামনে আগাতে আগাতে জীবজগতের সমস্ত পশু-পাখিসহ প্রাণীদের সাম্য ও অধিকারের কথা যোগ করা যেতে পারে।)
৩) বউ প্রায়ই বলে যে আমার সাথে কোনো মেয়ে সংসার করতে পারবে না…বেশিদিন টিকবে না… অবশ্য এটা আমি নিজেই বলি–আমি যে সংসারী না, সেটা বোরখাওয়ালীই যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। ফেসবুকে নারীবাদ নিয়ে যতই হাউকাউ করি না কেন, বাস্তবে ততটাই পুরুষতান্ত্রিক। বউয়েরও তাই মত। তারে দাসীর মত খাটাই। এমন দিনও গেছে–দুইহাতে টাইপ করছি, আর বউকে বলছি–খেতে পারছি না, তুমি ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দাও। সে বাধ্য হয়ে তা-ও করছে।
হিসাব করে দেখলাম শাহবাগ আন্দোলনের আগে নারীবাদ-সাম্যবাদ বা পলিটিক্যাল কোনো ব্যাপারে আমার একটা লাইনও লেখা নাই। আগ্রহই ছিল না ওসব ব্যাপারে। সবাই বলত–খালি ধর্ম নিয়া পোস্টাই কেন! নিজেদের অবস্থান ডিফেন্ড করার জন্য তখন প্রায়ই বলতাম যে, নাস্তিকতা হলো জাস্ট প্রথাগত ভগবানেশ্বরাল্যাতে অনাস্থা–জাস্ট এই অবস্থান থেকেই ধর্ম পুন্দাইতাম। এর বেশি কিছু না। এখন যেমন শুয়ারের বাচ্চা-কুত্তার বাচ্চা টাইপের নাস্তিকদের কথা বলি, তখন মূলত তাই ছিলাম। এখনো হয়তো আছি–মাঝে মাঝে নারীবাদ সাম্যবাদ রাজনীতি নিয়ে একটু হাউকাউ করি বিধায় ধর্ম পুন্দানো আগের মতো হচ্ছে না। আগেই নারীবাদ নিয়ে বললাম–যতই হাউকাউ করি না কেন, আসল কথা বউই বলে দিছে। সাম্যবাদ নিয়াও যা ভাবি বা বলি–বাস্তবে, একখান পুঁজিবাদী আইফোন আছে হাতে। (তবে গরীব পুঁজিবাদী বইলা আইফোনটা অনেক পুরানো মডেলের আর সেকেন্ডহ্যান্ড।) এছাড়া ভিতরে ভিতরে এখনো আগের মতোই শুয়ারের বাচ্চা-কুত্তার বাচ্চা টাইপের পিওর নাস্তিকই আছি।
৪) ধর্মের বেলায় অনেক নাস্তিক বলে থাকেন যে–যেহেতু ধর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, তাই তারা ধর্মের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ ঈশ্বরে অবিশ্বাস–এই হিসাবে শুধু নাস্তিক না হয়ে অনেকে তাদের নাস্তিক হওয়ার পেছনে ‘মানবতা’ বা ‘মানববাদ’-এর কথা উল্লেখ করেন। এখানে উল্লেখ্য–যারা শুধুমাত্র নাস্তিক, তাদের নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই, কারণ তারা যে হিসাবে নাস্তিক (শুধু ঈশ্বরে অবিশ্বাস), সেই হিসাবে পাল্লার মতো শুধু ধর্ম পুদান্দো শুয়ারের বাচ্চা- কুত্তার বাচ্চা টাইপ নাস্তিক… লোভ-স্বার্থের দিক দিয়ে এরা আস্তিকদের সাথে ওই ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস বাদে আর কোনো পার্থক্য নাই।
এবার নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন–আপনি নিজে কি শুয়ারের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চাদের মত নাস্তিক, নাকি মানববাদী নাস্তিক? আর মানববাদী নাস্তিক মানে আপনি জাস্ট ধর্ম পুন্দানিতে সীমাবদ্ধ নন, মাঝে মাঝে হলেও মানবতার কথা বলেন, নারীবাদী সাজেন, মানববাদী সাজেন–এই আরকি…
৫) যারা নারীবাদী, তারা নারী-পুরুষের সাম্য ও সমান অধিকারের কথা বলেন, কেন জানি মানুষে-মানুষের সাম্য ও সমান অধিকারের কথা বলতে লজ্জা পান। কমিউনিস্ট ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে? আচ্ছা, কমিউনিস্ট শব্দটা পলিটিক্যাল-পলিটিক্যাল শোনায়… তাহলে নজরুলের মতো–গাহি সাম্যের গান… ওরকম সাম্যের গান করেন নাকি? ওই সাম্যে কি শুধু নারী-পুরুষ? সব মানুষের সাম্যের কথা বলতে চান না? কেন?
৬) আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য কোথায়, সেটা আমরা জানি না। কারণ গন্তব্য যদি নির্দিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সভ্যতার বিকাশ থেমে যেতে পারে ওখানে। তবুও আমাদের বর্তমান নজেলে আমরা মানববাদকে আপাতত একটা লক্ষ্য হিসাবে ধরে আগাচ্ছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে–মানববাদী হতে হলে কি কম্যুনিজম বা সাম্যবাদ পার হয়েই আসতে হবে?
৭) আগেও বলছি, আবারো বলছি–কার্ল মার্ক্স নতুন কোনো কিছু বলেন নাই। অন্তত সেরকম দাবী তিনি বা এঙ্গেলস করেনও নাই। অতীতের সমাজ ব্যবস্থা নিয়া কিছু গবেষণা হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে তারা সেরকম একটা আইডিয়া আবার নতুন করে চালু করা যায় কি না, সেটা নিয়ে বই লিখেছেন বলে জানি। (পুরা জিনিস আমার পড়া নাই।) এইবার সেই আইডিয়ারে কেউ কেউ নিজের মত করে রাষ্ট্রে এপ্লাই করার চেষ্টা করছে, কেউ জোরাজুরি করছে, কেউ মানুষ পর্যন্ত হত্যা করছে। (এই জিনিসগুলাও আমার তেমন একটা জানা নাই।) কিন্তু এই মানুষ হত্যার কথা যখন আসে, তখন মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি ভাবি–যে সাম্য সমাজের কথা বলা, সেখানে তো রাষ্ট্র বা সীমানা থাকারই কথা না… তাহলে ব্যাপারটা তখনই সম্ভব যখন প্রতিটা মানুষ নিজের থেকে এগিয়ে আসবে। সেটা কি আদৌ সম্ভব! তবে ভাবতে ভালো লাগে…
৮) এইবার কিছু পুরানো পয়েন্ট–শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিরতণের জন্য সাহায্য চাইলে এগুলা মাথায় আসছিল।
ফেসবুকে একটা কোলাজ মাঝে মাঝে দেখি, কার যেন কথাটা–এরকম–ক্ষুধার্তদের মুখে অন্ন তুলে দিলে আমাকে ভালো মানুষ বলো, কিন্তু যদি প্রশ্ন করি ওদের খাবার নেই কেন, তাহলে কমিউনিস্ট বলে গালি দাও।
শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ, বা কারো চিকিৎসার অন্য অর্থ সংগ্রহ, বা অমুকের রক্ত লাগবে টাইপের পোস্ট দেখলে, বা পথশিশুদের নিয়ে কারো কাজ দেখলে আমার ওই কোলাজ আর কথাগুলার কথাই মনে পড়ে। এ-ও ভাবি–এই যে মানুষের বিপদে আমরা খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা নিয়ে এগিয়ে আসতে চাই, এই চাওয়াটাই প্রমাণ করে আমাদের অনেকের মধ্যে আদিম সাম্য সমাজের বীজ এখনো আছে। কিন্তু একটা রাষ্ট্রীয় সমাজব্যবস্থায় ওই ব্যক্তিগত ভাবে এগিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রতিটা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো রাষ্ট্র পূরণ করতে পারলে তখনই চিন্তাশীল মানুষগুলোর পক্ষে সৃষ্টিশীল কিছু করায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয়া সম্ভব।
ব্যক্তিগত ভাবে ফেসবুকে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হাউকাউ করতে ভালো লাগে না। নিজের মতো চিন্তা করতে চাই, নিজের মতো লিখতে চাই, বা জীবনটাকে নিজের মতো হেসে-খেলে উপভোগ করতে চাই… কিন্তু বেশিরভাগ সময় যদি অমুকে না খেয়ে আছে, তমুকের চিকিৎসা হচ্ছে না–এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয়, তাহলে কেমনে কী!
বর্তমানে স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবতা হলো আপাতত রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাদ দিয়ে শুধু সীমানাবিহীন সমাজব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আর দেশে যতই জনসংখ্যা বা অন্যান্য সমস্যা থাকুক না কেন, শুধু সম্পদের সুষম বন্টন হলেই প্রতিটা নাগরিক ন্যূনতম সুযোগসুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু হচ্ছে উলটা। কিছু লোক আরো সম্পদশালী হচ্ছে, আর বাকিরা দিন দিন আরো গরীব–জীবনের মান নেমে যাচ্ছে নিচে। এটার সমাধান কী?
Leave a Reply