লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ফয়সল আরেফিন দীপন ও নাজিমুদ্দিন সামাদ সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
বাইবেলের ওপরোক্ত বর্ণনানুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, মূসা তার পরিকল্পিত পরমেশ্বরকে কখনও প্রত্যক্ষদর্শন করেননি; কারণ মূসার পরমেশ্বর দর্শনাতীত এক অতিপ্রাকৃত সত্তা। বিধায়, যে-পরমেশ্বরকে স্বয়ং মূসা প্রত্যক্ষদর্শনে অপারগ, সেই পরমেশ্বরকে ইস্রায়েলের জনগণের নিকট প্রত্যক্ষ-প্রদর্শনের দায়বদ্ধতাও তার নেই। অবশেষে বিষয়টি এভাবে প্রতিপাদনের মাধ্যমে প্রতারক মূসা স্বীয় কাঁধ থেকে অসম্ভব এক দায়িত্বের বোঝা অনায়াসে অপসারণ করতে সক্ষম হন।
অপরদিকে বাইবেলীয় মূসার দর্শনাতীত পরমেশ্বর এবং মুহম্মদের দাবিকৃত আরবীয় ঈশ্বর ‘আল্লাহ’ একই পরম সত্তা, বিষয়টি এমন প্রমাণ করতে মুহম্মদ বাইবেলীয় বর্ণনার অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে স্বীয় প্রবর্তিত আল-কুরআনে বাইবেলের অনুরূপ বর্ণনা যুক্ত করেছেন। তাই এ বিষয়ে উভয় ধর্মগ্রন্থের বর্ণনায় মূসার পরমেশ্বর এবং মুহম্মদের দাবিকৃত ঈশ্বর আল্লাহ’র সাদৃশ্যমূলক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়; যেমন — উভয় ধর্মের ঈশ্বরকে কোনও মানুষ প্রত্যক্ষদর্শনে অপারগ। তবে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষদর্শনের অসম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে মূসা ও মুহম্মদের প্রণীত নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সাদৃশ্য লক্ষিত হলেও বিকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে উভয় ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে দর্শনীয়তার ব্যবধান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে মুহম্মদ ও তার প্রণীত আল-কুরআন। যেমন, আল্লাহকে প্রত্যক্ষদর্শনের ক্ষমতা প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
দৃষ্টি তাঁহাকে অবধারণ করিতে পারে না; কিন্তু তিনি অবধারণ করেন সকল দৃষ্টি এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত। [সূরা আন্‘আম: ১০৩]
তবে এ আয়াতের ‘দৃষ্টি’ বিষয়ক আলোচনায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আয়াতটির উৎস সম্পর্কে কিছু পর্যালোচনা করা যাক।
মজার বিষয় হলো যে, উক্ত আয়াতটি আল-কুরআনে স্থান পেলেও মূলত তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া মুহম্মদি হাদিস। আয়তটি যে স্বয়ং মুহম্মদ প্রণয়ন করেছেন, তা আয়াতটির বর্ণনাদৃষ্টেই বোঝা যায়। আয়াতটি যদি স্বয়ং আল্লাহ ব্যক্ত করতেন, তাহলে তার বর্ণনা হত এরকম: “দৃষ্টি আমাকে অবধারণ করিতে পারে না; কিন্তু আমি অবধারণ করি সকল দৃষ্টি এবং আমিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত।” আয়াতে ‘তাঁহাকে’ ও ‘তিনি’ সর্বনামের পরিবর্তে ‘আমাকে’ ও ‘আমি’ সর্বনাম ব্যবহৃত হত। কিন্তু বর্ণনাটি স্বয়ং মুহম্মদের হওয়ায় ‘আমাকে’ ও ‘আমি’ সর্বনামের পরিবর্তে ‘তাঁহাকে’ ও ‘তিনি’ সর্বনাম আবশ্যকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া আল-কুরআনে ঐশী বর্ণনার ক্ষেত্রে যতটা নির্ভুল ও কৌশলী বর্ণনা কাম্য ছিল, স্বয়ং নিরক্ষর মুহম্মদ বর্ণনাটি ব্যক্ত করায় তার পক্ষে ততটা নির্ভুল ও কৌশলী বর্ণনা প্রদান সম্ভব হয়নি। তাই তার বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার প্রমাণ উক্ত আয়াতের পরবর্তী আয়াতে পুনরায় আমাদের গোচরীভূত হয়। নিজের বাণীকে আল্লাহর বাণী হিসাবে চালিয়ে দেয়ার উত্তম দৃষ্টান্ত রয়েছে যে আয়াতে। আয়াতটি নিম্নরূপ:
তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ অবশ্যই আসিয়াছে। সুতরাং কেহ উহা দেখিলে উহা দ্বারা সে নিজেই লাভবান হইবে; আর কেহ না দেখিলে তাহাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। আমি তোমাদের সংরক্ষক নই। [সূরা আন্‘আম: ১০৪]
উক্ত আয়াতের শেষাংশে মুহম্মদ নিজের সম্বন্ধে বলেছেন ‘আমি তোমাদের সংরক্ষক নই।’ এখানে ‘আমি’ সর্বনাম ব্যবহার করে মুহম্মদ নিজের অবস্থান নিজেই ব্যক্ত করেছেন। বাণীটি যে স্পষ্টতই মুহম্মদের নিজের, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। যদি উক্ত আয়াতটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হত, সেক্ষেত্রে আয়াতের শেষাংশে ‘আমি’ ও ‘তোমাদের’ সর্বনাম ব্যবহারের পরিবর্তে ‘তুমি’ ও ‘তাদের’ সর্বনাম ব্যবহৃত হত। যেমন — ‘তুমি তাদের সংরক্ষক নও’ অথবা ‘মুহম্মদ তোমাদের সংরক্ষক নয়।’ তবে ধর্মব্যবসায়ী প্রবঞ্চক আলেম সমাজ মুহম্মদের ঐশী প্রতারণা আড়াল করতে উক্ত আয়াতের শেষাংশে ব্যবহৃত ‘আমি’ সর্বনামের চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন। যেমন এ বিষয়ে তাফহীমুল কুরআনে সূরা আন্‘আমের ৬৯ নম্বর টীকায় বিবৃত চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ:
“এ বাক্যটি আল্লাহর কালাম হলেও নবীর পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। কুরআন মজীদে বক্তার লক্ষ্য ও সম্বোধন বারবার পরিবর্তিত হয়। কখনো নবীকে সম্বোধন করা হয়, কখনো মু’মিনদেরকে, কখনো আহলি কিতাবদেরকে, কখনো কাফের ও মুশরিকদেরকে, কখনো কুরাইশদেরকে, কখনো আরববাসীদেরকে আবার কখনো সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করা হয়। অথচ আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র মানব জাতির হেদায়াত। অনুরূপভাবে সম্বোধনকারী ও বক্তাও বারবার পরিবর্তিত হয়। কোথাও বক্তা হন আল্লাহ্ নিজেই, কোথাও অহী বহনকারী ফেরেশতা, কোথাও ফেরেশতাদের দল, কোথাও নবী আবার ঈমানদাররা। অথচ এসব অবস্থায় সমস্ত কালামই একমাত্র আল্লাহরই কালাম হয়ে থাকে।”
উক্ত টীকা দৃষ্টে এটা বোঝা যায়, আল-কুরআনে ঐশী বর্ণনার যে-ত্রুটি স্বয়ং মুহম্মদ এড়াতে সক্ষম হননি; সেই ত্রুটি মুহম্মদের সচতুর অনুসারী তার চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যায় আড়াল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। যদিও তাতে সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই সুচতুর ব্যাখ্যাকারগণ যতই চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করুক না কেন, সূরা আন্‘আমের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর আয়াতের ধারাবাহিক পাঠ বিশ্লেষণ থেকে এ সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হওয়া যায় যে, উক্ত আয়াত দু’টি মুহম্মদের একান্ত নিজস্ব বাণী।
(চলবে)
Leave a Reply