যা বুঝলাম–সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সবচেয়ে বড় গুণ, মানে যে কারণে উনাকে সবার এত পছন্দ–উনি এত বছর রাজনীতি করার পরেও উনার সম্পত্তি বাড়ে নি। একটা ব্যাপার মাথায় আসছে না–মানুষ রাজনীতি করে কি নিজের সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য? তাহলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সম্পত্তি না বাড়ার বিষয়টা এত হাইলাইটেড হচ্ছে কেন? রাজনীতিবিদরা দেশ ও দশের সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখবেন, তার বিনিময়ে তাদের বেতনের ব্যবস্থা আছে–যা দিয়ে তাদের সংসার চলবে–এটাই তো স্বাভাবিক। নাকি বছর বছর সম্পত্তি বাড়বে–সেটা স্বাভাবিক? কোনটা হওয়া উচিত, কোনটা অনুচিত?
২) আসল ব্যাপার হচ্ছে–সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মূলত বাম ঘরানার মানুষ। সাধ্যমত উনি উনার আদর্শ মেনে চলেছেন, আর সে কারণেই উনার সম্পত্তি বাড়ে নি। কিন্তু উনার এই বাম আদর্শের ব্যাপারটা সবাই লুকিয়ে রাখছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে–আলোচনায় আসছে না। না এলেও দল-মত নির্বিশেষে উনি সবার পছন্দের তালিকায় ছিলেন। আবারও বলছি–কেউ স্বীকার করুক আর না করুক–উনি নিজের যে জায়গাটা রাজনীতির অঙ্গনে তৈরী করে নিতে পেরেছেন, সেটা উনার বাম মতাদর্শের জন্যই, যা তিনি কাজে কর্মেও করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশে বাম মতাদর্শের বাইরে আর কোনো মতাদর্শের আর কোনো রাজনীতিবিদ কি আছেন যিনি ক্ষমতায় থাকার পরেও তার সম্পত্তি বাড়ে নাই?
৩) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এখানেও উনার বাম মতাদর্শ। একজন শাসকের কাছে দল-মত নির্বিশেষে সবাই সমান, সবাই সন্তানতুল্য হয়ে যায়, তখন সবাইকে সমান চোখে দেখেন, সবার জন্যই তিনি সমানভাবে কাজ করতে চান–এই সাম্যের ব্যাপারটা শুধু বাম মতাদর্শেই সম্ভব। কেউ যখন সব মানুষকে সমানভাবে দেখতে যাবে, নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সবার সমান অধিকারের কথা বলবে তখনই লোভী-স্বার্থপর লোকগুলো কমিউনিস্ট বা বাম ট্যাগ দেবে, যা আমাদের মত লোভী-স্বার্থপর সমাজের লোকেরা গালি হিসাবে দেখে থাকে।
৪) গণতন্ত্রে দেশের আইনকানুনের দিকটা দেখার জন্য জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এছাড়া জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক দিকগুলোর সুষম বণ্টনের জন্যে যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন পদের জন্য চাকুরে বাছাই করে নেয়া হয়। এগুলো হয় জনগণেরই ট্যাক্সের টাকায়। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটা গণতান্ত্রিক দেশেই ওই জনপ্রতিনিধি নির্বাচন বাদে বাকি কাজ চলে মূলত কমবেশি সমাজতন্ত্রের নিয়মে। আদিম সাম্যসমাজগুলো ভেঙে যখন রাষ্ট্র গঠিত হলো, তখন রাষ্ট্র ব্যাপারটা গোত্রের চেয়ে অনেকগুণ বড় একটা প্রতিষ্ঠান–এইটুকুই শুধু নতুন–বাদবাকি নিয়মের বেলায় মানুষ সেই সাম্যসমাজের নিয়মের বাইরে খুব একটা নতুনত্বের পরিচয় দিতে পারে নি।
৫) সমস্যাটা হয়েছে তখনই, যখন রাজনীতিবিদ আর আর সরকারী চাকুরেরা নিজেদের কাজটা ঠিকমতো না করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। অর্থাত তারা জনগণের টাকাটা দেশ ও জনগণের উন্নতির স্বার্থে ব্যবহার না করে নিজেদের সম্পত্তি বাড়িয়েছে। এই যে স্বার্থ আর লোভ–বাম মতাদর্শ আর যাই হোক, এগুলোর শিক্ষা দেয় না, বরং এগুলো ত্যাগের শিক্ষা দেয়। যারা এই শিক্ষাটা কাজেকর্মে দেখাতে পেরেছেন, শেষ পর্যন্ত তারাই দল-মত নির্বিশেষে সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হতে পেরেছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাদেরই একজন।
৬) কার্ল মার্ক্স নতুন কিছু বলেন নাই। উনি শুধু দেখিয়েছেন আদিম সাম্য সমাজ যা করে দেখিয়েছে, সেটা বর্বরতার মধ্যযুগ পার হয়ে এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলো আরো সুন্দর ভাবে করে দেখাতে পারে–কিছু নমুনা তিনি তার লেখায় দেখিয়েছেন। আধুনিক বিজ্ঞান চাইলে সেটা আরো উন্নত রূপ দিতে পারে। এই যুগে এগুলো স্বপ্নের মতো মনে হলেও মানুষের ইতিহাস কিন্তু মিথ্যা বলে না। কোনো এককালে হয়তো আবার সম্ভব হবে! সম্ভব বলেই তার একটা উদাহরণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম–অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও নিজের বেলায় তিনি তা অনেকখানি করে দেখিয়েছেন।
Leave a Reply