লিখেছেন গোলাপ
“যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।”
কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমরের বেশ কিছু শর্তে রাজি হয়ে স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন উমরা পালন না করেই মদিনা প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রায় সমস্ত অনুসারী কী কারণেঅত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন; তাঁদের সেই অত্যন্ত হতাশাজনক পরিস্থিতিতে আবু জানদাল বিন আমর নামের যে-ব্যক্তিটি ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে এই সুহায়েল বিন আমরের সম্পর্ক কী ছিল; আবু জানদাল ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের যে-অনুরোধ করেছিলেন, কী কারণে তা বাস্তবায়নের আইনগত কোনো অধিকারই মুহাম্মদের ছিল না; চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই কুরাইশদের কাছে প্রতিশ্রুত শর্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুহাম্মদ কুরাইশদের কাছে আবু-জানদাল-কে ফেরত পাঠিয়েছিলেন দাবিটি কী কারণে এক্কেবারেই “নো সেন্স ও ননসেন্স”; আবু জানদাল সেখানে আসার পর সুহায়েল তাকে মারধর করে মক্কায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন, এই উপাখ্যানটিকে ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা “মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের যথেচ্ছ অকথ্য অত্যাচারের উদাহরণ” হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় কী ধরনের কলা-কৌশল অবলম্বন করেন, ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসের আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, তৎকালীন ক্বাবা শরীফের মধ্যে ছিল ৩৬০ টি বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের দেব ও দেবী মূর্তি। সেই একই ঘরের ভেতরে বসে তৎকালীন আরবে সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষরা উপাসনা করতেন সহ-অবস্থানের মাধ্যমে। মুহাম্মদের প্রচারণার পূর্বে “শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মমত অবলম্বন-পালন ও প্রচার”-এর কারণে মক্কাবাসী কুরাইশ ও অন্যান্য অবিশ্বাসীরা কাউকে কখনো কোনো অবমাননা করতেন, কিংবা কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজের ধর্ম ও দেব-দেবীকে ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন ও দেব-দেবীর পূজা করলে তাঁরা তাঁদের প্রতি অত্যাচারকরতেন, এমন ইতিহাস জানা যায় না। মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুয়ালিদ-এর চাচাত ভাই ওয়ারাকা বিন নওফল ছিলেন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান, সে কারণে মক্কাবাসী কোনো কুরাইশ ও অন্যান্য অবিশ্বাসীরা ওয়ারাকা বিন নওফল-কে অসম্মান করতেন, এমন উদাহরণ কোথাও নেই; তৎকালীন আরবের কিছু কুরাইশ ছিলেন ধর্মান্তরিত একেশ্বরবাদী “হানিফ সম্প্রদায়”-এর সদস্য, যার মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদের কিছু পরিবার সদস্য ও, কিন্তু সে কারণে তাঁদের কোনো পরিবার সদস্য কিংবা কোনো মক্কাবাসী কুরাইশ তাঁদেরকে কোনোরূপ অবমাননা বা অসম্মান করতেন, এমন ইতিহাসও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না [“নৃশংস যাত্রার সূচনা (পর্ব: ৩২)]! এহেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরম দৃষ্টান্তের অধিকারী সেই একই কুরাইশ ও অন্যান্য অবিশ্বাসী জনগোষ্ঠী মুহাম্মদ এবং তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে কী কারণে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন, কেন তাঁরা মুহাম্মদ ও তাঁর ভাবাদর্শে আকৃষ্ট ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের প্রতি ছিলেন বিরক্ত – ইত্যাদি বিষয়ের আংশিক আলোচনা “আবু-লাহাব তত্ত্ব (পর্ব:১২)”, ও “তারা বলে: এ ভূখণ্ডে আমরা ছিলাম অসহায় (পর্ব: ৪১)“ পর্বে করা হয়েছে।
সুহায়েল বিন আমর যখন তাঁর পুত্র আবু জানদাল-কে কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলেন, তখন উমর ইবনে খাত্তাব লাফ দিয়ে উঠে আবু জানদাল এর পাশে হেঁটে যান।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনার পুনরারম্ভ: [1] [2] [3]
পূর্ব প্রকাশিতের (পর্ব: ১২০) পর:
‘– উমর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান ও আবু জানদালের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলেন, “ধৈর্য ধারণ করো, কারণ তারা শুধুই মুশরিক, তাদের রক্তে (তাবারী: ‘তাদের যে কোনো একজনের রক্তে’) কুকুরের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই,” এবং তিনি তাঁর তরবারির হাতলটি তার নিকটে নিয়ে আসেন। উমর প্রায়ই বলতেন, “আমি আশা করেছিলাম যে, সে ঐ তরবারিটি নেবে ও সেটি দিয়ে তার পিতাকে হত্যা করবে;কিন্তু মানুষটি তার পিতাকে খুন করা হতে বিরত থাকে ও এইভাবে ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে।”’
আল-ওয়াকিদিরি (৭৪৮-৮২২ খ্রিষ্টাব্দ) অতিরিক্ত বর্ণনা:
‘–উমর বলেন, “আমি লাফ দিয়ে আবু জানদালের নিকট আসি ও তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাই।” সুহায়েল বিন আমর তাকে ধাক্কা দেয়, উমর বলেন, “হে আবু জানদাল, ধৈর্য ধারণ করো, তারা অবশ্যই অবিশ্বাসী ও তাদের যে কোনো জনের রক্তে কুকুরের রক্ত। যা সুনিশ্চিত, তা হলো এই যে, সে যেমন একজন মানুষ, তুমিও একজন মানুষ, কিন্তু তোমার কাছে আছে তরবারি।”
উমর প্রত্যাশা করেছিলেন যে, আবু জানদাল যেন সেই তরবারিটি নেয় ও তা দিয়ে তার পিতাকে আঘাত করে।কিন্তু ঐ লোকটি তার পিতাকে তা করা থেকে সংযত হয়। উমর বলেন, “হে আবু জানদাল, অবশ্যই একজন লোক আল্লাহর খাতিরে তার পিতাকে খুন করতে পারে। আল্লাহর কসম, যদি আমাদের পিতারা আমাদের আক্রমণ করে, আমরা আল্লাহর নামে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, একজনের খাতিরে আর একজন।” আবু জানদাল উমরের নিকটবর্তী হয় ও বলে, “তুমি কেন তাকে খুন করলে না?” উমর জবাবে বলে, “আল্লাহর নবী আমাকে তা করতে নিষেধ করেছিলেন।” আবু জানদাল বলে, “আল্লাহর নবীর প্রতি তোমার আনুগত্য কি আমার চেয়েও বেশি?”
উমর ও তার সাথে অবস্থিত আল্লাহর নবীর অনুসারীরা বলে, “হে আল্লাহর নবী, আপনি কি আমাদের বলেননি যে, আপনি পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করবেন, কাবা ঘরের চাবিটি গ্রহণ করবেন ও আরাফাতে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সেই লোকদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন? কিন্তু এখন পর্যন্ত না আমাদের কুরবানির পশুগুলো, না আমরা কাবা ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারলাম।” আল্লাহর নবী বলেন,
“আমি কি বলেছিলাম যে, তোমাদের এই যাত্রাটিতেই আমি তা করবো?” উমর বলে, “না।” আল্লাহর নবী বলেন, “তোমরা অবশ্যই তাতে প্রবেশ করবে! আমি কাবা ঘরের চাবিটি গ্রহণ করবো ও মক্কার ভেতরে আমার ও তোমাদের মাথার চুল মুণ্ডন করবো। অতঃপর আমি আরাফাতে উপস্থিত লোকদের সাথে গিয়ে দাঁড়াবো।”
অতঃপর আল্লাহর নবী উমরের কাছে আসেন ও বলেন, “তুমি কি ওহুদ-এর ঐ দিনটির কথা ভুলে গিয়েছ, যখন তুমি কারও জন্য অপেক্ষা না করে ওপরে উঠে যাচ্ছিলে, আর আমি চিৎকার করে তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করে তোমার আখেরাতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম? তুমি কি আল-আহযাব এর ঐ দিনটির কথা ভুলে গিয়েছ, যখন তারা ওপর ও নিচ থেকে তোমাদের কাছে এসেছিল ও তোমাদের মনে হয়েছিল যে, তোমাদের হৃৎপিণ্ডটি কণ্ঠের কাছে এসে হাজির হয়েছে? তুমি কি সেই দিনের কথা ভুলে গিয়েছ?” আল্লাহর নবী তাদেরকে ঐ ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়া শুরু করেন: তোমরা কি ভুলে গিয়েছ ঐ দিনের কথা? মুসলমানরা বলে, “আল্লাহ ও তার নবীর সহায়, আমরা তা ভুলে গিয়েছিলাম ও আপনি আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই আল্লাহ ও তার কার্যকলাপের বিষয়ে আপনি আমাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানসম্পন্ন।”‘
– অনুবাদ, টাইটেল, ও [**] যোগ – লেখক।
ইমাম বুখারীর (৮১০-৮৭০ সাল) বর্ণনা:
এই প্রসঙ্গে ইমাম বুখারীর বর্ণনা (৩:৫০:৮৯১) মুহাম্মদ ইবনে ইশাক, আল-তাবারী ও আল-ওয়াকিদির ওপরে বর্ণিত বর্ণনারই অনুরূপ; পার্থক্য হলো এই যে, মুশরিকদের বিরুদ্ধে উমর ইবনে খাত্তাবের অমানুষিক ঘৃণা (‘তাদের রক্তে কুকুরের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই’) ও আবু জানদাল বিন সুহায়েল যেন তাঁর জন্মদাতা পিতাকে খুনকরে এই অভিপ্রায়ে উমর যে তাঁর তরবারি সমেত আবু জানদালের পাশে গিয়েছিলেন, এ বিষয়ের কোনো উল্লেখই ইমাম বুখারী করেননি। [4]
>>> মুহাম্মদ ইবনে ইশাক, আল তাবারী ও আল ওয়াকিদির ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, যখন সুহায়েল বিন আমর তাঁর পুত্র আবু জানদালকে নিয়ে কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন, তখন মুহাম্মদের প্রিয় অনুসারী উমর ইবনে খাত্তাব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান ও কুরাইশদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে তাঁর তরবারি নিয়ে আবু জানদালের কাছে যান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আবু জানদাল যেন তাঁর সেই তরবারিটি নেন ও তা দিয়ে তাঁর পিতাকে খুন করেন। মুহাম্মদের আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার পর কুরাইশদের এই ধর্মান্তরিত একান্ত পরিবার সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও নিকট-আত্মীয়রা মক্কায় ফেলে আসা তাঁদের পরিবার সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও নিকট-আত্মীয়দের প্রতি কীরূপ অমানুষিক ঘৃণা পোষণ করতেন, তার বিস্তারিত আলোচনা বদর যুদ্ধ অধ্যায়ে (পর্ব: ৩০-৪৩) করা হয়েছে। এই সেই উমর ইবনে খাত্তাব, যিনি বদর যুদ্ধে ধৃত কুরাইশদের কী করা হবে, সে বিষয়ে মুহাম্মদকে পরামর্শ দিয়েছিলেন:
“আপনি তাদের অমুক অমুক-কে আমার হাতে সোপর্দ করবেন যাতে আমি তাদের কল্লা কাটতে পারি; আপনার উচিত হামজার ভাই [আল-আব্বাস]-কে তার কাছে সোপর্দ করা, যাতে সে তার ভাইয়ের কল্লা কাটতে পারে এবং আকিল-কে আলীর কাছে সোপর্দ করা, যাতে সে তার ভাইয়ের কল্লা কাটতে পারে। তাতে আল্লাহ জানবে যে, আমাদের অন্তরে অবিশ্বাসীদের জন্য কোনোরূপ প্রশ্রয় নেই।” [বিস্তারিত: বন্দীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত -কি ছিল”আল্লাহর” পছন্দ?” (পর্ব: ৩৬)]
এই সেই উমর ইবনে খাত্তাব যিনি বদর যুদ্ধে আবু হুদেইফা বিন ওতবা নামের এক মুহাম্মদ অনুসারীকে তাঁর ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন, আমাদেরকে খুন করতে হবে আমাদের পিতাকে, পুত্রকে, ভাইকে এবং পরিবার-পরিজনদেরকে কিন্তু আব্বাসকে [মুহাম্মদের চাচা] দিতে হবে ছেড়ে?” উত্থাপনের কারণে তাঁকে খুন করার হুমকি প্রদর্শন করেছিলেন [বিস্তারিত: “লুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও খুন বনাম সহিষ্ণুতা” (পর্ব: ৩১)]
আদি উৎসের সকল ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় যে-বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো, হুদাইবিয়া সন্ধির এই পর্যায়ে উমর ইবনে খাত্তাব সহ মুহাম্মদের প্রায় সমস্ত অনুসারী মুহাম্মদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। আর তার কারণটিও অত্যন্ত স্পষ্ট, “মুহাম্মদের প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া।” যখন তাঁরা মুহাম্মদকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তখন মুহাম্মদ দাবি করেন যে, তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি যে তাঁদের এই যাত্রায়ই সত্য হবে, তা তিনি বলেননি। অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে নিরীহ বাণিজ্য ফেরত কুরাইশ কাফেলার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে তাঁদের খুন-বন্দী ও সম্পদ লুট করার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী হলো আক্রান্ত সেই কুরাইশরা (পর্ব: ২৮-২৯); বনি কেইনুকা গোত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী যাদেরকে তিনি উচ্ছেদ করেছেন, তাঁরা (পর্ব: ৫১); ওহুদ যুদ্ধের চরম ব্যর্থতার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী হলো তাঁর অনুসারীদের দুর্বল ‘ইমান’ (পর্ব: ৫৪-৭১); ওহুদ যুদ্ধের পর বনি নাদির গোত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী হলো যাদেরকে তিনি উচ্ছেদ করেছেন, সেই বনি নাদির গোত্র (পর্ব: ৫২ ও ৭৫); খন্দক যুদ্ধের চরম ব্যর্থতার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী হলো তাঁর অনুসারীদের ‘ইমানের’ দুর্বলতা (পর্ব: ৭৭-৮৬); খন্দক যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বনি কুরাইজা গোত্রের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে এক এক করে গলা কেটে খুন করে তাঁদের বউ-বাচ্চা ও সম্পদ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য যেমন তিনি দায়ী নন, দায়ী হলো আক্রান্ত বনি কুরাইজা গোত্রের বউ-বাচ্চা ও যাদেরকে তিনি খুন করেছেন, তাঁরা (পর্ব: ৮৭-৯৫); সেই একই ধারাবাহিকতায় “কাবা ঘরের চাবি কাঠি তাঁর হাতে” স্বপ্ন-দর্শনের ঘোষণা দিয়ে ১৪০০ অনুসারী জড়ো করে মক্কায় আসার পর তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ার জন্যও তেমনি তিনি কোনোভাবেই দায়ী নন, দায়ী হলো তাঁর অনুসারীরা, “তাঁরা তাঁকে ভুল বুঝেছেন!” স্বঘোষিত আখেরি নবী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ সর্বদাই তাঁর সমস্ত ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর নিজস্ব কর্মের দায়বদ্ধতা (Accountability) কখনো স্বীকার করেননি!
অতঃপর মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, ওহুদ যুদ্ধে তাঁদের কী হাল হয়েছিল, “আর তোমরা ওপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পেছন দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলে না কারো প্রতি, অথচ রসূল ডাকছিলেন তোমাদিগকে তোমাদের পেছন দিক থেকে (কুরান: ৩:১৫৩)” [বিস্তারিত: ‘নবী গৌরব ধূলিসাৎ!’ (পর্ব: ৬৯) পর্বে]। তিনি তাঁর অনুসারীদের আরও স্মরণ করিয়ে দেন যে, খন্দক (আল-আহযাব) যুদ্ধে তাঁদের কী হাল হয়েছিল, “যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কণ্ঠাগত হয়েছিল (কুরান: ৩৩:১০)” [বিস্তারিত: “মুহাম্মদের উৎকোচ!” (পর্ব: ৮১)]
উল্লেখ্য, আদি উৎসের সকল ‘সিরাত (মুহাম্মদের জীবনী)’ লেখকদের বর্ণিত যায়েদ বিন হারিথার নেতৃত্বে অমানুষিক নৃশংসতায় উম্মে কিরফা হত্যাকাণ্ডের (পর্ব:১১০) বর্ণনা,উরওয়া বিন মাসুদ-কে দেয়া আবু বকরের সুনির্দিষ্ট(”আল-লাত এর ভগাঙ্কুর/দুধ চোষ!”) অশ্রাব্য-গালি বর্ষণের বর্ণনা (পর্ব:১১৫), আবু জানদাল বিন সুহায়েল যে সুহায়েল বিন আমরেরই পুত্র সন্তান ছিলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বর্ণনা (পর্ব: ১২০) কুরাইশদের প্রতি উমর ইবনে খাত্তাবের ওপরে বর্ণিত অমানুষিক ঘৃণা (‘তাদের রক্তে কুকুরের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নেই’) ও পুত্র আবু জানদাল বিন সুহায়েল যেন তাঁর জন্মদাতা পিতাকে হত্যা করে, এই উদ্দেশ্যে তরবারি সমেত উমর যে আবু জানদাল বিন সুহায়েলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন – ইত্যাদি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও বিস্তারিত (vivid and detailed) উপাখ্যানগুলো ‘হাদিস’ গ্রন্থের বিশিষ্ট লেখকরা উল্লেখই করেননি। সিরাত ও হাদিস গ্রন্থ পাঠের সময় এই বিশেষ প্যাটার্ন-টি প্রায় সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়।
প্রশ্ন হলো: কী কারণে ‘সিরাত ও হাদিস’ লেখকদের বর্ণনার এই পার্থক্য?
এই প্রসঙ্গের আলোচনায় ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা মূলত: যে দু’টি দাবি প্রায় সব ক্ষেত্রেই করে থাকেন, তা হলো,
১) “সিরাত লেখকরা যথাযথ ‘ইসনাদ’ অনুসরণ করেন নাই”:
অর্থাৎ, ‘সিরাত’ এর লেখকগণ ‘হাদিস’ গ্রন্থের লেখকগণের মত সাবধানতা অবলম্বন করে অব্যবহিত পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা কোনো নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা সমসাময়িক ব্যক্তিদের কাছ থেকে মুহাম্মদের নবী জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনার মৌখিক বর্ণনা সংগ্রহ করে তা তাঁদের অব্যবহিত (Immeduate) পরের প্রজন্মের লোকদের কাছে মৌখিকভাবে বর্ণনার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে সেই ঘটনাটির বর্ণনা এক প্রজন্মের লোকদের কাছ থেকে অব্যবহিত পরের প্রজন্মের লোকদের কাছে পৌঁছানোর পদ্ধতি (‘ইসনাদ’) যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি। তাই সিরাত লেখকদের এই সব বর্ণনা ‘অ-সহি (not authentic) ও অগ্রহণযোগ্য’।
২) “ইহুদিদের কাছ থেকে সংগৃহীত”:
অর্থাৎ, ‘সিরাত’ লেখকরা তাঁদের এই সব বর্ণনার অনেকটাই তৎকালীন ইহুদিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন, বিশেষ করে মুহাম্মদ ইবনে ইশাক। তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়।
>> প্রথমতঃ যে বিষয়টি আমরা নিশ্চিতরূপেজানি, তা হলো:
আদি উৎসের পূর্ণাঙ্গ (Complete) ‘সিরাত’ গ্রন্থগুলো রচিত হয়েছে মুহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় ১১০- ১৪০ বছরের মধ্যে, আর ‘হাদিস’ গ্রন্থগুলো রচিত হয়েছে তারও প্রায় একশত বছরের ও অধিক পরে, মুহাম্মদের মৃত্যুর ২০০ বছরেরও অধিক পরে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা সমসাময়িক লোকদের কাছ থেকে তাঁদের অব্যবহিত পরের প্রজন্মের লোকেরা (যাদের অনেকেই ছিলেন তাঁদেরই সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, কিংবা পরিচিত-জন – ‘দ্বিতীয় প্রজন্ম’) মুহাম্মদের জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনার যে-মৌখিক বর্ণনা সংগ্রহ করে তৃতীয় প্রজন্মের লোকদের শুনিয়েছেন, সেই সব দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের লোকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তৃতীয় প্রজন্মের লেখকগণ রচনা করেছেন সিরাত গ্রন্থ। মুখে মুখে প্রচারিত সেই একই ঘটনার বর্ণনা পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রজন্মের লোকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রজন্মের লেখকগণ রচনা করেছেন হাদিস গ্রন্থ। ষষ্ঠ প্রজন্মের লেখকের রচিত মুখে মুখে প্রচারিত কোনো বিশেষ ঘটনার বর্ণনা, তৃতীয় প্রজন্মের লেখকদের রচিত সেই একই ঘটনার বর্ণনার চেয়ে কম গ্রহণযোগ্য এমন দাবি অযৌক্তিক। আর “ইহুদিদের কাছ থেকে সংগৃহীত” দাবিটি যদি শতভাগ সত্যও হয়, তথাপি বিজিত ও অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর (ইহুদি ও অন্যান্য) লোকদের কাছ থেকে সংগ্রহীত কোনো বিশেষ ঘটনার বর্ণনা, অত্যাচারী ও বিজয়ী জনগোষ্ঠীর (ইসলাম-বিশ্বাসী) কাছ থেকে সংগ্রহীত সেই একই ঘটনার বর্ণনার চেয়ে কম গ্রহণযোগ্য, বিজয়ী দল অনুসারীদের এমন দাবি নিঃসন্দেহে অভিসন্ধিমূলক।
>> আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমরা নিশ্চিতরূপে জানি, তা হলো:
ইসলামের একান্ত প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যকীয় শর্ত অনুযায়ী কোনো ইসলাম-বিশ্বাসীর পক্ষেই মুহাম্মদের কোনোরূপ “নেতিবাচক চরিত্র” কল্পনা করাও অসম্ভব! আদি উৎসের ‘সিরাত’ লেখকদের এ সকল বর্ণনা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের শৌর্যবীর্য ও ক্ষমতার উপাখ্যান হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের পক্ষে ধারণা করাও সম্ভব ছিল না যে, তাঁদের লিখিত এই ঘটনাগুলো শত শত বছর পরে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য দলিল হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিপাদ্য হবে। কিন্তু সিরাত পরবর্তী যুগের অধিকাংশ লেখকরা যুগে যুগে ‘সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে’ মুহাম্মদের জীবন ইতিহাসের যে কোনো নেতিবাচক চরিত্রের বর্ণনাকে বিভিন্ন অজুহাতে “অ-সহি” আখ্যা দিয়েছেন, অথবা বিভিন্ন অজুহাতে তার বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করেছেন; আজকের অধিকাংশ ইসলাম-বিশ্বাসীরাও এই ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম নয়। মুহাম্মদকে “জগতের শ্রেষ্ঠ মানব” হিসাবে প্রতিষ্ঠা ও নিজের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় তথাকথিত মডারেট মুসলমানদের এটি এক অত্যন্ত সহজাত ও অত্যাবশ্যকীয় প্রবৃত্তি [বিস্তারিত:“সিরাত রাসুল আল্লাহ (পর্ব:৪৪)” ও “জ্ঞান তত্ত্ব (পর্ব:১০)“ পর্বে]। সিরাত রচনার একশত বছরেরও অধিক পরের প্রজন্মের বিশিষ্ট হাদিস বর্ণনাকারী ও গ্রন্থকাররা এই একই সহজাত ও অত্যাবশ্যকীয় প্রবৃত্তির অধিকারী ছিলেন না, এমন দাবি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
সত্য হলো, কী কারণে হাদিস গ্রন্থের বিশিষ্ট লেখকগণ সিরাত গ্রন্থের বিশিষ্ট লেখকদের এই সব প্রাণবন্ত বর্ণনাযুক্ত উপাখ্যানের অধিকাংশেরই কোনো উল্লেখই করেননি, তা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব নয়। তথাপি যৌক্তিকভাবেই যা অত্যন্ত স্বাভাবিক, তা হলো, যে-কারণে বর্তমান ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা মুহাম্মদের যাবতীয় নেতিবাচক চরিত্রকে যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেন, যে কারণে তাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত সহি হাদিস-রূপে স্বীকৃত হাদিসগুলোকে ‘অ-সহি’ আখ্যা দেন, যে-কারণে তাঁরা সম্পূর্ণ হাদিস গ্রন্থকেই অস্বীকার করে ‘শুধু কুরান (Quran only)’ বিশ্বাসী মুসলমান সাজেন, সেই একই কারণে ‘সিরাত’ রচনার এক শত বছরের বেশি পরে লিখিত হাদিস বর্ণনাকারী ও গ্রন্থকাররাও ইসলামের ইতিহাসের ঐসব অমানবিক অধ্যায়গুলো উল্লেখ করেননি। আজকের ইসলাম বিশ্বাসীদের মত তাঁরাও ছিলেন অসহায়।
ইসলামী ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রায় প্রতিটি ইসলাম বিশ্বাসী প্রকৃত ইতিহাস জেনে বা না জেনে ইতিহাসের এ সকল অমানবিক অধ্যায়গুলো যাবতীয় চতুরতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে এসেছেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় বাংলা অনুবাদের সাথে মূল ইংরেজি অনুবাদের প্রাসঙ্গিক অংশটিও সংযুক্ত করছি। – অনুবাদ, টাইটেল ও [**] যোগ – লেখক।]
The Narrative of Muhammad Ibne Ishaq:
‘Umar jumped up and walked alongside Abu Jandal saying, ‘Be patient for they are only polytheists; the blood of one of them (Tabari: ‘any of them’) is but the blood of a dog,’ and he brought the hilt of his sword close up to him. ‘Umar used to say, ‘I hoped that he would take the sword and kill his father with it, but the man spared his father and so the matter ended.’ [1]
The Narrative of Al-Waqidi:
‘–Umar said, “I jumped at Abu Jandal and walked at his side.” Suhayl bin Amr pushed him, and Umar says, “Be patient, O Abu Jandal, surely they are disbeleivers and the blood of one of them is the blood of a dog. Surely he is a man and you are a man, but you have a sword.” Umar hoped that Abu Jandal would take the sword and strike his father. But the man withheld from his father. Umar said, “O Abu Jandal, surely a man may kill his father for God. By God, if our fathers attacked us we would surely fight them in God’s name, man for man.” He said: Abu Jandal approached Umar and said, “Why do you not kill him?” Umar replied, “The messenger of God forbade me.” Abu Jandal said, “Are you more righteous in your obedience to the Messeneger of God than I?” — [3]
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[1]“সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৫০৫
[2] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৮, ইংরেজী অনুবাদ: Michael Fishbein, University of California, Los Angeles, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-7914-3150—9 (pbk), পৃষ্ঠা (Leiden) ১৫৪৮
[3] অনুরূপ বর্ণনা (Parallel): “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক: আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬; ভলুম ২, পৃষ্ঠা ৬০৮-৬০৯ http://www.britannica.com/biography/al-Waqidi
ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ২৯৯-৩০০
[4] সহি বুখারী: ভলিউম ৩, বই ৫০, নম্বর ৮৯১
অনেক বড় হাদিস, এই পর্বের প্রাসঙ্গিক অংশ:
‘—- Umar bin Al-Khattab said, “I went to the Prophet and said, ‘Aren’t you truly the Apostle of Allah?’ The Prophet said, ‘Yes, indeed.’ I said, ‘Isn’t our Cause just and the cause of the enemy unjust?’ He said, ‘Yes.’ I said, ‘Then why should we be humble in our religion?’ He said, ‘I am Allah’s Apostle and I do not disobey Him, and He will make me victorious.’ I said, ‘Didn’t you tell us that we would go to the Ka’ba and perform Tawaf around it?‘ He said, ‘Yes, but did I tell you that we would visit the Ka’ba this year?’ I said, ‘No.’ He said, ‘So you will visit it and perform Tawaf around it?’ “Umar further said, “I went to Abu Bakr and said, ‘O Abu Bakr! Isn’t he truly Allah’s Prophet?’ He replied, ‘Yes.’ I said, ‘Then why should we be humble in our religion?’ He said, ‘Indeed, he is Allah’s Apostle and he does not disobey his Lord, and He will make him victorious. Adhere to him as, by Allah, he is on the right.’ I said, ‘Was he not telling us that we would go to the Kaba and perform Tawaf around it?’ He said, ‘Yes, but did he tell you that you would go to the Ka’ba this year?’ I said, ‘No.’ He said, “You will go to Ka’ba and perform Tawaf around it.” (Az-Zuhri said, ” ‘Umar said, ‘I performed many good deeds as expiation for the improper questions I asked them.'”)’—-
Leave a Reply