নাস্তিকরা একটা কথা খুব গর্ব করে বলে যে, তারা নাকি বাস্তববাদী। কথাটা বলে তারা আস্তিকদের পরকাল, স্বর্গ-বেহেস্ত, ঈশ্বর–ইত্যাদি অবাস্তব-অবৈজ্ঞানিক বিষয়ে বিশ্বাসের সাথে তুলনা করে। কিন্তু মানুষের লক্ষ্য কি শুধু নাস্তিক হওয়া? নাস্তিকরা শুধু নাস্তিক হয়েই কি সন্তুষ্ট, নাকি আরো সামনে এগিয়ে যেতে চায়?
অনেকেই আছে শুধু নাস্তিক হয়েই পরম তৃপ্তি লাভ করে। মাঝে মাঝে এদেরকে মানকিরবাচ্চা বলি। শেয়াল-কুকুর-শুয়ারের বাচ্চারা যে অর্থ ঈশ্বরে অবিশ্বাসী–এরাও ঠিক তাই। নাস্তিকতার বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না। এই অবস্থানে তারা আসলেই বাস্তববাদী। কারণ ওই নাস্তিকতা ছেড়ে সামনে আগালে সে পথ আর বাস্তব থাকে না–বাস্তবতার দৃষ্টিতে একটা অবাস্তব-স্বপ্নময় পথে এসে দাঁড়াতে হয়…
অনলাইনে আরেকটা কথা বেশ চালু–নাস্তিকতা হলো মানুষ হওয়ার একেবারে প্রথম ধাপ। অনেকে আবার নিজেদেরকে নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী–একজন মুক্তমনা হিসাবে পরিচয় দেয়। কিন্তু ওই অবস্থানে যাওয়া কি আদৌ কারো পক্ষে সম্ভব? কয়জন হতে পেরেছে? স্বার্থ আর লোভ থেকে মুক্ত হওয়া আসলেই সম্ভব? বিন্দুমাত্র লোভ আর স্বার্থের জালে যে এখনো আটকা, সে কী করে মুক্তমনা হবে!
সবাই নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করবে, প্রতিটা মানুষের মধ্যে সাম্য বজায় থাকবে, ধনী-গরীব ভেদাভেদ থাকবে না, জাত-পাতের ভেদাভেদ থাকবে না, ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভাজন করা হবে না–এগুলো আস্তিক তো বটেই, অনেক নাস্তিকদের কাছেও অবাস্তব মনে হবে। এই অর্থে নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী–সর্বোপরি একজন মুক্তমনা হওয়া–এগুলা এখনো স্বপ্নের পর্যায়ে আছে।
বর্তমানে আমরা এসব নিয়ে কথা বলি–অনেক বড় বড় কথাই বলি, কিন্তু যারা বলি তাদের বেশিরভাগেই বাস্তবে এগুলা মেনে চলতে পারছি না। এখনো পুরুষতন্ত্র পুঁজিবাদ ধর্ম লোভ স্বার্থের বেড়াজাল থেকে বেশিরভাগেই সেভাবে বের হয়ে আসতে পারি নাই। এটাই সত্য। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ হওয়ার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে হবে?
মানুষ হয়ে ওঠা যদি একটা চলমান প্রক্রিয়া হয়, এই পথটার যদি কোনো শেষ না থাকে, যদি শুধু নাস্তিকতায় শেয়াল-কুকুর-শুয়ারের বাচ্চারাদের মত আবদ্ধ থাকা হয়, তাহলে মানুষ হয়ে ওঠার পথে আমাদের সম্বল কী? আপাতত নারীবাদ সাম্যবাদ মানববাদ–এগুলাই।
একদিনে বা হুট করেই কেউ নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী হয়ে যাবে? নাস্তিকরা কি একদিন নাস্তিক হতে পারছে? অনলাইনে যেসব নাস্তিক দেখা যায়, বেশিরভাগেই অনেকদিন ধরে ব্লগ-ফেসবুকে নাস্তিকতা বিষয়ে লেখালেখি পড়ে একটু একটু করে এই পথে আসছে। তার আগে যারা নাস্তিক হয়েছে–তারাও পারিবারিক শিক্ষা বা আগের নাস্তিকদের বইপত্র পড়ে একটু একটু করে নিজেদের বদলেছে। হওয়ার পরে আবার নিয়মিত এর চর্চা করে যাচ্ছে…
আবার অনেকে আছে যারা হয়তো ভেতরে ভেতরে নাস্তিক, কিন্তু মুখ ফুটে কখনো এসব ব্যাপারে কিছু বলে না, বা সামাজিকতার দোহাই দিয়ে আস্তিকতার ভান করে–এদেরকে আমরা ‘ভদ্র নাস্তিক’ বলি। চলমান প্রক্রিয়ায় এদের দিয়ে অন্য কারো তেমন কোনো উপকার হয় না। অনেকে আবার শুনি বাস্তবজীবনে খুব নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী… কিন্তু মুখে কিছু বলেন না… যেমন ধরা যাক একজন পুরুষ তার নিজের জীবনে নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী… তিনি সংসারের সব কাজ বউয়ের সাথে ভাগাভাগি করে করেন–এতে হয়তো তার বউয়ের একটু সুবিধা হচ্ছে, কিন্তু আর কারো জীবনে কি কোনো প্রভাব ফেলতে পারছেন?
বলা যায়, ওইসব ‘ভদ্র’ নাস্তিক নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদীরা অন্তত কারো উপকার করতে না পারুক, কারো ক্ষতি তো করছে না। উনাদের ভাবটা এমন–আমি যেভাবেই হোক ভালো হয়ে গেছি, মনে মনে চাই তোমরাও ভালো হও…কিন্তু কেমনে হবে তা নিয়ে কিছু বলব না।–এই ধরনের ভদ্রদের চেয়ে যারা অভদ্র–যারা বাস্তবে এখনো সেভাবে নারীবাদী সাম্যবাদী মানববাদী হয়ে উঠতে পারে নি, কিন্তু সবসময়ে প্রক্রিয়াটা চলমান রাখছে, এসব নিয়ে হাউকাউ করছে, মানুষ হওয়ার চর্চাটা জারি রাখছে, সেই সাথে অন্যদের কানেও ব্যাপারটা ঢুকাতে পারছে–এটা বাস্তবে অনেকবেশি কার্যকরী। এরা মনে করে–এখনো নারীবাদী হয়ে উঠতে পারি নি, এখনো সাম্যবাদী হয়ে উঠতে পারি নি, এখনো মানববাদী হয়ে উঠতে পারি নি, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কারণ এই আইডিয়াগুলো ভালো লাগে, আর এসব নিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলতে আরো ভালো লাগে, স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে…
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা কথা আছে–মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানব সভ্যতায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ওই নারীবাদ সাম্যবাদ মানববাদ… এর চেয়েও বড় যদি কিছু থেকে থাকে, পথ চলতে চলতে সে স্বপ্নের সাথেও একদিন দেখা হবে… স্বপ্ন নিয়ে এপিজে আব্দুল কালাম বলছিলেন, স্বপ্ন তা নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন হচ্ছে তা-ই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।–সুখী মানুষেরা শান্তিতে ঘুমাক; ‘অসুখী’রা নির্ঘুম স্বপ্ন দেখুক আর ‘হাউকাউ’ করুক…
Leave a Reply